বস্তাবন্দি লাশ নয়, ফারদিনের ভাসমান মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিলো

সম্প্রতি, “নিখোঁজের তিন দিন পর বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিনের লাশ বস্তাবন্দি অবস্থায় শীতলক্ষ্যা নদী হতে উদ্ধার করা হয়েছিলো” শীর্ষক একটি দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিনের লাশ বস্তাবন্দি অবস্থায় শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়নি বরং স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিনের ভাসমান লাশ উদ্ধার করেছিল নৌ পুলিশ।

কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে, মূলধারার গণমাধ্যম ‘বণিক বার্তা’ এর অনলাইন সংস্করণে গত ০৭ নভেম্বর ‘তিনদিন পর শীতলক্ষ্যায় মিলল বুয়েট শিক্ষার্থীর মরদেহ‘ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিখোঁজের তিনদিন পর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের মৃতদেহ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। ৭ নভেম্বর বিকেলে নদীর বনানি ঘাট থেকে ভাসমান অবস্থায় লাশটি উদ্ধার করা হয়।

উক্ত বিষয়টি নিয়ে মূলধারার গণমাধ্যম এনটিভি, ইত্তেফাক, সমকাল, বাংলাদেশ প্রতিদিন, আমাদের সময়, নিউজবাংলা২৪, আজকের পত্রিকা, বিডি জার্নাল, ঢাকা ট্রিবিউন, চ্যানলে২৪, ও জাগোনিউজ২৪ এ প্রকাশিত প্রতিবেদনেও শীতলক্ষ্যা নদী হতে ফারদিনের ভাসমান লাশ উদ্ধারের তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়।

এছাড়া বিষয়টি অধিকতর নিশ্চিতের জন্য উক্ত বিষয় নিয়ে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার এবং বিডিনিউজ২৪সহ মূলধারার প্রায় ৪০ টি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যাচাই করে রিউমর স্ক্যানার। উক্ত অনুসন্ধানে কোনো গণমাধ্যমের প্রতিবেদনেই ‘ফারদিনের বস্তাবন্দি’ মরদেহ উদ্ধার সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে মূলধারার ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যম ‘একাত্তর টেলিভিশন’ এর ইউটিউব চ্যানেলে গত ১৫ ডিসেম্বর ফারদিনের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় প্রশাসনের তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে ডিবি ও পুলিশের সংবাদ সম্মেলনের প্রেক্ষিতে প্রচারিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

উক্ত প্রতিবেদনে প্রতিবেদককে বলতে শোনা যায়, “বস্তাবন্দি অবস্থায় নয়, ভাসতে ভাসতে মরদেহটি এসে ঠেকেছিল নদীর পারে।”

এই কথাগুলো বলাকালে প্রতিবেদনে নদীর তীরে ফারদিনের মরদেহের দুইটি দৃশ্য প্রদর্শন করা হয়।

Photo Collected from Ekattor TV

পরবর্তীতে একাত্তর টেলিভিশনের ক্রাইম রিপোর্টার ইশতিয়াক ইমনের সাথে যোগাযোগ করে নদীর তীরে ফারদিনের মরদেহের দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ছবিগুলো সংগ্রহ করে রিউমর স্ক্যানার টিম।

Photo Collected from Eshtiak Emon

একাত্তর টিভিতে প্রদর্শিত ছবিগুলো ফারদিনের কিনা তা অধিকতর নিশ্চিতে অনুসন্ধান চালায় রিউমর স্ক্যানার টিম। অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে ফারদিনকে নিয়ে গত ১৫ ডিসেম্বর মূলধারার গণমাধ্যম সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সংযুক্ত ফারদিনের বাবার হাতে ছবি দেখতে পাওয়া পাওয়া যায়।

উক্ত ছবির সঙ্গে নদীর তীরে ফারদিনের মরদেহের ছবি দাবিতে একাত্তর টিভিতে প্রকাশিত ছবিগুলোর মিল পাওয়া যায়।

এছাড়া দীর্ঘ অনুসন্ধানের মাধ্যমে রিউমর স্ক্যানার টিম এটি নিশ্চিত হয়েছে যে, ‘শীতলক্ষ্যা নদী হতে ফারদিনের বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়েছিলো’ এমন কোনো তথ্য ফারদিনের পরিবার কিংবা সহপাঠীদের পক্ষ হতে গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কখনোই বলা হয়নি।

মূলত, বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিনের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় তারা বাবা কাজী নূর উদ্দিন রানার করা হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে গত ১৪ ডিসেম্বর ডিবি ও র‌্যাব পৃথক সংবাদ সম্মেলনে জানায় হত্যা নয়, ফারদিন আত্নহত্যা করেছেন বলে তাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। উক্ত সংবাদের প্রেক্ষিতে ফেসবুকে ডিবি ও র‌্যাবের সমালোচনা করে নেটিজেনরা দাবি করেন ‘শীতলক্ষ্যা নদী হতে ফারদিনের বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়েছিলো, এটি আত্মহত্যার ঘটনা হতে পারে না।’ তবে রিউমর স্ক্যানার টিম দীর্ঘ অনুসন্ধানে ফারদিনের লাশ উদ্ধারের সময়ে গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ‘বস্তাবন্দি লাশ’ উদ্ধারের কোনো তথ্য খুঁজে পায়নি বরং লাশ উদ্ধারকালীন ধারণকৃত শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ভাসমান ফারদিনের মরদেহের একাধিক ছবি খুঁজে পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার। তবে অনুসন্ধানের জন্য দৃশ্যমান কিংবা পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ না থাকায় ফারদিনের মৃত্যুর প্রকৃত ঘটনা আত্মহত্যা নাকি হত্যা তা যাচাই করা রিউমর স্ক্যানারের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

উল্লেখ্য, গত ৪ নভেম্বর ঢাকা থেকে নিখোঁজ হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নুর পলাশ। পরদিন নিখোঁজ ফারদিনের বাবা কাজী নূর উদ্দিন রানা রাজধানীর রামপুরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। নিখোঁজের তিন দিন পর অর্থাৎ গত ৭ নভেম্বর  নারায়ণগঞ্জের  সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন বনানীঘাট সংলগ্ন লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিলের পিছনে শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসমান অবস্থায় লাশ উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ নৌ থানা পুলিশ। পরদিন ৮ নভেম্বর ফারদিনের লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা জানায় ‘মরদেহের মাথায় ও বুকে একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাই এটি তাদের কাছে হত্যাকাণ্ড বলে প্রতীয়মান হয়েছে।’ এরপর গত ১০ নভেম্বর ফারদিনের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় ফারদিনের বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরাসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন ফারদিনের বাবা কাজী নূর উদ্দিন রানা। উক্ত মামলায় ওইদিনই বুশরাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত ১৪ ডিসেম্বর ডিবি ও র‌্যাবের পক্ষ থেকে মামলার তদন্ত অগ্রগতি নিয়ে করা সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ‘হত্যা নয় ফারদিন আত্নহত্যা করেছেন বলে তদন্তকারীরা ধারণা করছেন।’ পরবর্তীতে ১৫ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কারী সংস্থা ডিবি জানায়, ফারদিনের মৃত্যুর ঘটনায় তার বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরার কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তবে ফারদিনের মৃত্যু সম্পর্কে দেওয়া তদন্তকারী সংস্থার তথ্যকে প্রত্যাখ্যান করে ফারদিনের বাবা বলেন, আমার ছেলে আত্মহত্যা করতে পারে না, তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

সুতরাং, নিখোঁজের তিন দিন পর বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিনের মরদেহ শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করার ঘটনাকে শীতলক্ষ্যা হতে ‘ফারদিনের বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়েছিলো’ শীর্ষক দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img