কলকাতা ও বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয় মূলধারার গণমাধ্যম যথাক্রমে আনন্দবাজার এবং প্রথম আলো’তে “মায়ের খোঁজে নিষিদ্ধ পল্লীতে বিভূতিভূষণ” শীর্ষক শিরোনামে একটি তথ্য (প্রতিবেদনে) প্রকাশ করা হয়েছে।
গণমাধ্যম দুটিতে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন ‘আনন্দবাজার‘ (১৯ নভেম্বর ২০১৬) এবং ‘প্রথম আলো‘ (৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২)। প্রতিবেদন দুটির আর্কাইভ ভার্সন দেখুন যথাক্রমে এখানে এবং এখানে।
পরবর্তীতে আনন্দবাজার এবং প্রথম আলো’র প্রতিবেদন থেকে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
আনন্দবাজারের সূত্র দিয়ে প্রথম আলো’র প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, “বিভূতিভূষণের মা তো তাঁর শৈশবেই মারা গিয়েছিলেন। অল্প বয়সে মাকে হারিয়ে বরাবরই ছিলেন ভালোবাসার কাঙাল। পাঁচ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে কলকাতায় আসেন তিনি। টাকার অভাবে তাঁর দরিদ্র বাবা কিছুতেই ভালো কোনো বাড়ি ভাড়া পাচ্ছিলেন না। ফলে শহরের একপাশে কিছুটা অনুন্নত জায়গায় ঘর ভাড়া নিলেন তাঁর পিতা। তাঁদের ঘর থেকে নিকট দূরত্বে ছিল নিষিদ্ধ এক পল্লি। তো এই পল্লির এক নারী একদিন চলতি পথে দেখলেন ছোট্ট বিভূতিভূষণকে। মা–হারা বিভূতির মায়াবী চেহারা ওই নারীর মন গলিয়ে দিল, শিশুটির জন্য খুব দরদ হলো তাঁর। প্রায়ই এসে তিনি বিভূতির সঙ্গে খেলতেন, মাঝেমধ্যে খাইয়ে-নাইয়েও দিতেন।”
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, অল্প বয়সে মাকে হারাননি বিভূতিভূষণ, এছাড়াও “মায়ের” খোঁজে নিষিদ্ধ পল্লিতে যাননি বিভূতিভূষণ বরং পূর্বপরিচিত “এক নারীর” খোঁজে সেই নারীর বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি (যা ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ পল্লিতে পরিণত হয়েছে সেটা তিনি জানতেন না) এবং বিভূতিভূষণের মা তার (বিভূতিভূষণের) যুবক বয়সেই মারা যান।
বিভূতিভূষণের অল্প বয়সে মা’কে হারানোর দাবি অনুসন্ধান
অনুসন্ধানে, গুগল বুকস এ “এবং বৃত্তের বাইরে” নামক পত্রিকায় “পরলোক চর্চায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়” শীর্ষক একটি প্রবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, “প্রথম স্ত্রী গৌরীদেবীর মৃত্যু তাঁর কাছে ছিল প্রবল মানসিক আঘাত। কেবলমাত্র গৌরীদেবীই নন সে সময়েই অনতিকাল পরে ইছামতীতে ডুবে মৃত্যু হয়েছিল বিভূতিভূষণের বোন ‘মনি’-র। বি.এ পড়ার সময় গৌরীদেবীর সাথে বিবাহ। স্ত্রী ও বোনের মৃত্যুর ঠিক এক বছরের মাথায় চলে যান মা ‘মৃণালিনী দেবী’।”
অর্থাৎ, বি এ পড়ার সময়ে বিয়ে হয় গৌরীদেবীর সাথে। বিয়ের একবছর পর গৌরীদেবী মারা যান। তারও একবছর পরে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা মৃণালিনী দেবী মারা যায়। মোটকথা, বিভূতিভূষণের বি এ পড়ার ২ বছর পর তার মা মারা যান। ভারতীয় কন্টেন্ট প্ল্যাটফর্ম মমস্প্রেসো বাংলা এর এক তথ্য অনুযায়ী, ১৯১৯-সালে, গৌরী দেবীর সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। সে অনুযায়ী বিভূতিভূষণের মা মারা যান ১৯২১ সালে বা তার কাছাকাছি সময়ে অর্থাৎ যখন বিভূতিভূষণের বয়স প্রায় ২৭ এর কাছাকাছি।
পাশাপাশি, আনন্দবাজারের সাবেক সাংবাদিক ও লেখক কিশলয় ঠাকুর রচিত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনী “পথের কবি” গ্রন্থের ৬৭ নম্বর পৃষ্ঠায় বিভূতিভূষণের প্রবেশিকা পরীক্ষার সময়েও (১৯১৪ সালে) তার মায়ের জীবিত থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে।
এমনকি আলোচিত দাবিদুটির সমজাতীয় ঘটনা নিয়ে বিভূতিভুষণের লেখা “হিঙের কচুরি”র গল্পে নায়ক কিশোর বামুন যখন কলকাতায় আসেন সে সময় তার মায়ের (জীবিত) কথা উল্লেখ রয়েছে।
“মায়ের খোঁজে” নিষিদ্ধ পল্লীতে বিভূতিভূষণ; দাবি অনুসন্ধান
অনুসন্ধানে “বিভূতিভূষণ কর্তৃক মায়ের খোঁজে নিষিদ্ধ পল্লীতে যাওয়ার” এরকম কোনো ঘটনা তার জীবনী গ্রন্থ কিংবা জীবনী সম্পর্কিত কোনো লেখায়-ও বিষয়টি পাওয়া যায়না। তবে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহপাঠী, বন্ধু এবং একই মেসের বাসিন্দা নীরদচন্দ্র চৌধুরী তার “দাই হ্যান্ড গ্রেট অ্যানার্ক” প্রমাণ্য গ্রন্থে “বন্ধু বিভূতিভূষণ” নামে তাদের মধ্যকার কিছু স্মৃতি ও বিভূতিভুষণের কথা উল্লেখ করেছেন।
সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, “তাঁহার বয়স চারি-পাঁচ, তাঁহার পিতৃদেব তাঁহাকে কলিকাতায় আনিয়া, শহরের এক কুখ্যাত স্থানে, বস্তিতে ঘর ভাড়া করিয়াছিলেন। তাঁহাদিগের বাড়ির নিকটেই একটি উত্তম বাড়ি ছিল, সেইখানে এক রক্ষিতা থাকিত। সে শিশু বিভূতিভূষণকে ডাকিয়া কথা বলিত, খেলিত। …. শিশু বিভূতিভূষণ ওই স্ত্রীলোকের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হইয়া পড়িল। ….. গল্পটি হইল এই তাঁহার ওই গৃহ এবং অঞ্চলটি বেশ মনে ছিল, এবং ওই মহিলাকে একবার দেখিবার অদম্য ইচ্ছা সংবরণ করিতে না পারিয়া, তিনি ওইস্থলে গিয়াছিলেন। ইতিমধ্যে ওই স্থলটি একটি বেশ্যালয়ে পরিণত হইয়াছিল।”
আনন্দবাজার বিভূতিভুষণের বন্ধু নীরদচন্দ্র চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে আলোচিত প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও নীরদচন্দ্র তার লেখায় মহিলাকে বিভূতিভুষণের কথিত “মা” বলে সম্বোধন করেননি। এছাড়াও নীরদচন্দ্র আরো উল্লেখ করেছেন “ইতিমধ্যে ওই স্থলটি একটি বেশ্যালয়ে পরিণত হইয়াছিল”, অর্থাৎ বিভূতিভুষণের ছোটবেলায় জায়গাটি নিষিদ্ধ পল্লী ছিলোনা।
তাই, মহিলাটিকে “মা” সম্বোধণ করে প্রকাশ করা প্রতিবেদন সঠিক নয়। বিভূতিভূষণ, তার বন্ধু নীরদচন্দ্র কিংবা বিভূতিভূষণের জীবনীকার কিশলয় ঠাকুর; কেউ-ই মহিলাটিকে বিভূতিভূষণ এর “মা” বলে সম্বোধন করেনি। এই দাবির (মা সম্বোধণ) স্বপক্ষে কোনো প্রমাণও পাওয়া যায়না।
আলোচিত প্রতিবেদনে যা যা ভুল
- অল্প বয়সে মাকে হারাননি বিভূতিভূষণ
- মা নয়, পূর্বপরিচিত এক নারীর খোঁজে নিষিদ্ধ পল্লিতে গিয়েছিলেন তিনি
- বিভূতিভূষণের ছোটবেলা থেকেই জায়গাটি নিষিদ্ধ পল্লিতে ছিলোনা
“মায়ের খোঁজে” নিষিদ্ধ পল্লীতে বিভূতিভূষণ; দাবির উৎস
অনুসন্ধানে, বিভূতিভুষণের লেখা “হিঙের কচুরি” নামক একটি গল্প পাওয়া যায়। এতে গল্পের নায়কের ( বামুন) নিজের বাড়ির কাছে নিষিদ্ধ পল্লীর একটি ঘটনা উল্লেখ রয়েছে। নিষিদ্ধ পল্লীর এক নারী (কুসুম) এর সাথে বামুনের খুব সখ্যতা হয় (স্নেহের)। নীরদচন্দ্রের বর্ণনার সাথে এই গল্পের কাহিনী সংযুক্ত করে প্রচার করা হচ্ছে।
“হিঙের কচুরি” কী হুবহু বিভূতিভূষণের জীবনের সাথে হুবহু মিলে যায়?
“হিঙের কচুরি”র কাহিনীর সাথে নীরদচন্দ্র বর্ণিত বিভূতিভুষণের জীবনের ঘটনা কিছুটা মিল থাকলেও পুরোপুরি মিল পাওয়া যায়না। নীরদচন্দ্র চৌধুরী তার “দাই হ্যান্ড গ্রেট অ্যানার্ক” প্রমাণ্য গ্রন্থে “বন্ধু বিভূতিভূষণ” প্রবন্ধ অনুযায়ী নিষিদ্ধ পল্লিতে গিয়ে তিনি মহিলাটির দেখা পাননি তবে “হিঙের কচুরি” গল্পের শেষে গল্পের নায়ক মহিলাটির দেখা পান।
মূলত, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহপাঠী, বন্ধু এবং একই মেসের বাসিন্দা নীরদচন্দ্র চৌধুরীর “দাই হ্যান্ড গ্রেট অ্যানার্ক” প্রমাণ্য গ্রন্থের “বন্ধু বিভূতিভূষণ” নামক একটি প্রবন্ধকে উদ্ধৃত করলেও প্রতিবেদনে বিভূতিভূষণের লিখিত (প্রায় সমজাতীয় কাহিনী) নিয়ে “হিঙের কচুরি” গল্পের নায়কের জীবনীর বেশকিছু ঘটনাকে সংযুক্ত করে বিভূতিভূষণের সত্যিকার জীবনে ঘটে যাওয়া কাহিনী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, পিতামাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে বিভূতিভূষণ সবচেয়ে বড় ছিলেন ছিলেন। বিভূতিভূষণের অল্প বয়সে মাকে হারানোর দাবি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন আনন্দবাজারের অপর এক লেখক ময়ূখ নস্কর। বিভূতিভূষণের অল্প বয়সে মাকে না হারালেও তিনি যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র তখন মৃত্যু হয় তার পিতা মহানন্দের। বিভূতিভুষণের লেখা গল্প “হিঙের কচুরি” অনুযায়ী ১৯৭০ সালে উত্তম-কুমার সাবিত্রী চ্যাটার্জি অভিনীত “নিশি পদ্ম” সিনেমা নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে একই কাহিনীর উপর ভিত্তি করে শক্তি সামন্তের পরিচালিত ‘অমর প্রেম’ সিনেমা-ও নির্মাণ করা হয়।
এছাড়াও, বিভূতিভুষণের রচিত গল্প ‘বিপদ’-এ একজন পতিতা (হাজু– কাল্পনিক চরিত্র) কে নিয়ে লেখা। পাশাপাশি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা ‘পথের পাঁচালী”র জন্য ইন্দিরা ঠাকরুণের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নির্মাতা সত্যজিৎ রায় কলকাতার নিষিদ্ধ পল্লী থেকে চুনীবালা দেবী নামক একজন পুরাতন নাট্যাভিনেত্রীকে খুঁজে বের করেন।
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে বিভূতিভূষণের জন্মগ্রহণের (১২ সেপ্টেম্বর) মাসে দৈনিক প্রথম আলো গত ৩০ সেপ্টেম্বর তাকে নিয়ে আনন্দবাজারের ৬ বছর আগের এই প্রতিবেদনটি কিছুটা পরিবর্তিত রূপে প্রকাশ করে ।
সুতরাং, বিভূতিভূষণের মা তার যুবক বয়সে মারা যান, ছোটবেলায় নয়। এছাড়াও পূর্বপরিচিত এক নারীকে খোঁজ করার বিষয়টিকে “মায়ের খোঁজে” নিষিদ্ধ পল্লিতে গিয়েছিলেন দাবি করা হচ্ছে; যা মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- রকমারি: Kishloy Tagore Books – কিশলয় ঠাকুর এর বই
- গুগল বুকস: EBONG BRITTER BAIRE
- Dailysangram: গল্পকার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- Inscript archive- ছয় আনা গ্রন্থাবলী সিরিজেই কলমে ছবি আঁকা শুরু পথের পাঁচালী, আরণ্যকের স্রষ্টার
- Newsonly24- উপন্যাসের মতো ঘটনাবহূল জীবন ছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের