সম্প্রতি “আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত রাস আল খাইমাহ ২১ তম হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় ৫২ দেশের শত প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের হাফেজ মোঃ ওয়াসিম আইয়ুব ওয়াসিফ প্রথম স্থান অর্জন করেছেন” শীর্ষক একটি দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে।
ফেসবুক পেইজে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
একই প্রতিযোগিতায় ৫২টি দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশী হাফেজের দ্বিতীয় স্থান অর্জনের দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদন দেখুন দৈনিক ইনকিলাব।
ইউটিউবে প্রচারিত এমন কিছু ভিডিও দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে। আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে।
টিকটকে প্রচারিত এমন কিছু ভিডিও দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে। আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, আরব আমিরাতে আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি হাফেজ মোঃ ওয়াসিম আইয়ুব ওয়াসিফের ৫২ দেশের শত প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে বা হারিয়ে প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেননি বরং উক্ত কোরআন প্রতিযোগিতায় ৫২ টি দেশের চৌদ্দশ প্রতিযোগী বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত হয়ে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে এবং প্রতিটি বিভাগের জন্য আলাদাভাবে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঘোষণাও করা হয়েছে। তার মধ্যে ওয়াসিফ একটি বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন। একই বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছেন মুসআব মীর কামাল। এছাড়া একই প্রতিযোগিতায় হাদীস বিভাগেও প্রথম স্থান অর্জন করেছেন আব্দুল সবুর শরীফ হোসাইন নামে আরেকজন বাংলাদেশি।
কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রতিযোগিতাটির আয়োজক সংস্থা রাস আল খাইমাহ ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেইজ ‘مؤسسة رأس الخيمة للقرآن الكريم وعلومه’ এ গত ১৯ ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া আরব আমিরাত ভিত্তিক গণমাধ্যম AlIttihad এর একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
গণমাধ্যমটিতে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘Completion of the final qualifiers for the Holy Quran Award in Ras Al Khaimah’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, রাস আল খাইমাহ ফাউন্ডেশনের কোরআন প্রতিযোগিতার ২১ তম এই আসরে ৫২ টি দেশ থেকে আরব আমিরাতের ৪০১ জন সহ মোট চৌদ্দশ প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। এই প্রতিযোগিতাটি চলে ১২ জানুয়ারি থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
পরবর্তীতে রাস আল খাইমাহ ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেইজেই গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ‘الفائزون من الذكور’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত আরেকটি পোস্ট থেকে প্রতিযোগিতাটির ২১ তম আসরে বিভিন্ন বিভাগে বিজয়ীদের নাম খুঁজে পাওয়া যায়।
বিজয়ীদের এই তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পোস্টটিতে মোট ১০ টি বিভাগে বিজয়ীদের তালিকা নাম সহ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম বিভাগটি হলো পুরো কুরআন মুখস্ত প্রতিযোগিতা।
এই বিভাগেই প্রথম হয়েছেন বাংলাদেশি হাফেজ মুহাম্মদ ওয়াসিফ রিয়াদউদ্দীন। দ্বিতীয় হয়েছেন আরেক বাংলাদেশি হাফেজ মুসআব মীর কামাল। এই বিভাগে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম হয়েছেন মিশরের তিন প্রতিযোগী।
প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় বিভাগটি কোরআনের ২০ পারা মুখস্ত বিভাগ৷ এই বিভাগে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জন করেন যথাক্রমে সোমালিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও উগান্ডার প্রতিযোগী।
প্রতিযোগিতার তৃতীয় বিভাগটি কোরআনের ১০ পারা মুখস্ত বিভাগ৷ এই বিভাগে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জন করেন যথাক্রমে মিশর, আফগানিস্তান ও ভারতের প্রতিযোগী।
প্রতিযোগিতার চতুর্থ বিভাগটি কোরআনের ২০ পারা মুখস্ত বিভাগ৷ এই বিভাগে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জন করেন যথাক্রমে আফগানিস্তান, মালি ও জর্দানের প্রতিযোগী।
প্রতিযোগিতার পঞ্চম বিভাগটি ছিল কোরআনের ২ পারা মুখস্ত বিভাগ৷ এই বিভাগে কেবল সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিযোগীদের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল।
প্রতিযোগিতার এরপরের বিভাগটি ইমাম, মসজিদের মুয়াজ্জিন ও সাধারণ মুখস্তকারীদের। এই বিভাগে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জন করেন যথাক্রমে ক্যামেরুন, মিশর ও মরক্কোর প্রতিযোগী। এই বিভাগে পঞ্চম স্থান অর্জন করেন বাংলাদেশের প্রতিযোগী মুহাম্মদ আব্দুল রহমান।
রাস আল খাইমাহ ফাউন্ডেশনের কোরআন প্রতিযোগিতা ছাড়াও হাদিস ভিত্তিকও তিনটি বিভাগে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে the Hadith competition, the category of guidance boys বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন বাংলাদেশের প্রতিযোগী আব্দুর সবুর শরীফ হোসাইন।
হাদিস ভিত্তিক এই বিভাগ দুইটি ছাড়াও ‘Winners of the Holy Hadith competition, Buds of Faith category’ নামে আরও আরেকটি বিভাগ ছিল৷ তবে এই বিভাগের বিজয়ীদের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি ছিল না। বরং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জন করেন যথাক্রমে মালি, ফিলিস্তিন ও সিরিয়ার প্রতিযোগীরা।
প্রতিযোগিতার সবশেষ বিভাগ ছিল নওমুসলিমদের নিয়ে৷ এই বিভাগে প্রথম, দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন উগান্ডার দুই প্রতিযোগী ও তৃতীয় স্থান অর্জন করেন ঘানার এক প্রতিযোগী।
অর্থাৎ, আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত রাস আল খাইমাহ ফাউন্ডেশনের কোরআন প্রতিযোগিতার ২১ তম আসরে ৫২ দেশের শত প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের হাফেজ মোঃ ওয়াসিম আইয়ুব ওয়াসিফ প্রথম স্থান অর্জন করেননি বরং প্রতিযোগিতার প্রথম বিভাগ পুরো কোরআন মুখস্তের অংশে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন।
এছাড়া আলোচিত কোরআন প্রতিযোগিতায় স্ব স্ব বিভাগ ভিত্তিক কতজন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেছেন সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য আয়োজক সংস্থা সূত্রে জানা যায়নি।
উল্লেখ্য, একই প্রতিযোগিতায় নারীরাও ১৪ টি বিভিন্ন বিভাগে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে এখানে বিজয়ীদের তালিকায় কোনো বাংলাদেশি প্রতিযোগীর নাম পাওয়া যায়নি।
মূলত, চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আরব আমিরাতে রাস আল খাইমাহ ফাউন্ডেশনের কোরআন প্রতিযোগিতার ২১ তম আসর অনুষ্ঠিত হয়। এই আসরে ৫২ টি দেশ থেকে আরব আমিরাতের ৪০১ জন সহ মোট চৌদ্দশ প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে মো: ওয়াসিফ রিয়াদ উদ্দীন পুরো কোরআন মুখস্ত বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন। এই বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন আরেক বাংলাদেশি হাফেজ মুসআব মীর কামাল।তার বিভাগটি ছাড়াও প্রতিযোগিতার প্রতিটি বিভাগেই পৃথক পৃথকভাবে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই বিষয়টিকেই দাবি করা হচ্ছে যে, আরব আমিরাতে আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি হাফেজ মোঃ ওয়াসিম আইয়ুব ওয়াসিফের ৫২ দেশের শত প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে বা হারিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন। আবার একই প্রতিযোগিতার ফলাফল নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ করা হয় যে, ৫২টি দেশকে পেছনে ফেলে আরব আমিরাতে হেফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশি হাফেজ মুসআব মীর কামাল।
প্রসঙ্গত, ইতোপূর্বে ‘সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বিশ্বের ১১১টি দেশের মধ্যে/ দেশের সাথে/ দেশকে পেছনে ফেলে/ দেশকে হারিয়ে বাংলাদেশের হাফেজ সালেহ আহমদ তাকরিম তৃতীয় স্থান অর্জন করেছেন’ শীর্ষক দাবিতে একইভাবে অনুরূপ তথ্য ছড়িয়ে পড়লে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে তা আংশিক মিথ্যা হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
সুতরাং, আরব আমিরাতে আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি হাফেজ মোঃ ওয়াসিম আইয়ুব ওয়াসিফের ৫২ দেশের শত প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অর্জন করার তথটি আংশিক মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Al Ittihad: Completion of the final qualifiers for the Holy Quran Award in Ras Al Khaimah
- Ras Al Khaimah Facebook: ‘الفائزون من الذكور
- ‘Ras Al Khaimah Facebook Page: ‘مؤسسة رأس الخيمة للقرآن الكريم وعلومه