সম্প্রতি, ‘দুই মাসের মধ্যে দেশের সব আদালত কক্ষে শেখ মুজিবের ছবি দেওয়ার আদশে করছে হাইকোর্ট’ ক্যাপশনে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে।

উক্ত দাবিতে টিকটকে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
এই প্রতিবেদন লেখা অবধি টিকটকে ভিডিওটি দেখা হয়েছে প্রায় ২ লক্ষ ৬০ হাজার বারেরও বেশি। এছাড়াও ভিডিওটিতে প্রায় ৬ হাজারেরও বেশি পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি ভিডিওটি ৯ শতবারেরও বেশি শেয়ার করা হয়েছে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে দুই মাসের মধ্যে দেশের সব আদালত কক্ষে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টানানোর নির্দেশ দেয়নি হাইকোর্ট এবং সংবিধান লঙ্ঘন এবং স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননার অভিযোগে জাতিসংঘ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র চাওয়ার দাবিটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, ২০১৯ সালে হাইকোর্টের দেওয়া একটি নির্দেশের প্রেক্ষিতে সেসময়ে প্রচার করা সংবাদ প্রতিবেদনের একটি অডিওর অংশ ও সংবাদ পাঠিকার ছবি দিয়ে এবং একটি বানোয়াট পুরুষ কন্ঠ যুক্ত করে দিয়ে আলোচিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে। তাছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে হাইকোর্ট থেকে এরকম কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি। এবং জাতিসংঘ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র চাওয়া হয়েছে এমন তথ্যও নির্ভরযোগ্য সূত্রে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এই বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার। এতে, শুরুতেই একটি মেয়েলি কণ্ঠে বলা হয়, “দুই মাসের মধ্যে দেশের সব আদালত কক্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।”
এরপর পুরুষ কণ্ঠে বলা হয়, “সংবিধান লঙ্ঘন এবং স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা করায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নামে মামলার পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘের লোয়ার ল্যাপস (‘লোয়ার ল্যাপস’ কথাটি অস্পষ্ট)। সেই সাথে শেখ হাসিনার পদত্যাগ পত্র হস্তান্তর করতে না পারলে ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করার কথাও জানিয়েছে জাতিসংঘ।ড. মুহাম্মদ ইউনূসে বিরুদ্ধে মামলা এবং শেখ হাসিনার পুনরায় ক্ষমতা ফিরে পাওয়া নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন শাহাদাত রিফাত।”
এরপর ভিডিওটিতে পুরুষ কন্ঠে বলা হয়, “আবারও সকল রাজনৈতিক দল এবং জনগণের তোপের মুখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ‘রিসেট বাটন’ পুশ করতে গিয়ে দেশ এবং বহির্বিশ্বের জনগণের ক্ষোভের শিকার ড. ইউনূস। সংবিধান লঙ্ঘনের পাশাপাশি স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা।”
আমাদের পর্যবেক্ষণে শুরুতেই থাকা নারী কন্ঠের ভয়েসটি কোনো গণমাধ্যমের প্রেজেন্টারের বলে প্রতীয়মান হয়।
ভিডিওটিতে থাকা নারীর ছবি এবং নারী কন্ঠের বলা তথ্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করলে বেসরকারি ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম বাংলা টিভি এর ‘Bangla TV Europe’ নামক ইউটিউব চ্যানেলে ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট ‘২ মাসের মধ্যে দেশের সব আদালত কক্ষে বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রদর্শনে হাইকোর্টের নির্দেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

উক্ত সংবাদ প্রতিবেদনের নারী সংবাদ পাঠিকার সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটিতে থাকা ছবির নারীর সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়া, আলোচিত ভিডিওটিতে থাকা নারী কন্ঠের অংশটুকু এই সংবাদ প্রতিবেদনের শুরুর ১০ সেকেন্ডর সাথে মিল রয়েছে।
ভিডিও প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেসময় দুই মাসের মধ্যে দেশের সব আদালত কক্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।
আলোচিত ভিডিওটিতে থাকা নারীর ছবিটি ব্যাকগ্রাউন্ড এবং পারিপার্শিক অবস্থা প্রযু্ক্তির সাহায্যে পরিবর্তন করে প্রচার করা হয়েছে।
পরবর্তীতে, এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলো ও জাগোনিউজ২৪ এর ওয়েবসাইটে ২০১৯ সালের ২৯ আগস্টে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন থেকেও একই তথ্য জানা যায়।
সংবাদ প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায়, শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বাংলাদেশের উচ্চ আদালতসহ সব আদালতে সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট এই আদেশ দিয়েছিলেন এবং সেই সময় আদালতের এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে দুই মাসের মধ্যে হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়। এ সংক্রান্ত একটি রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই নির্দেশ দিয়েছিলেন।
অর্থাৎ, এটি নিশ্চিত যে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটিতে থাকা ছবি এবং শুরুর ৯ সেকেন্ড অংশের সংবাদ প্রতিবেদনটি মূলত ২০১৯ সালে হাইকোর্টের দেওয়া একটি নির্দেশনার বিষয়ে একটি সংবাদ প্রতিবেদনের অংশ।
তাছাড়া, প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যম বা নির্ভরযোগ্য সূত্রে হাইকোর্ট থেকে এমন কোনো নির্দেশ দেওয়ার সপক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে, আলোচিত ভিডিওটিতে পুরুষ কন্ঠে বলা তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগ পত্র হস্তান্তর করতে না পারলে ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করার কথা জানিয়েছে জাতিসংঘ’ – এমন কোনো তথ্য মূলধারার গণমাধ্যম বা নির্ভরযোগ্য সূত্রে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া, ‘জাতিসংঘের লোয়ার ল্যাপস’ – নামে কোনো নির্দিষ্ট সংস্থা বা পরিষদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, সম্প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশে দেশের সব আদালত কক্ষে দুই মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রদর্শন এবং জাতিসংঘ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র চাওয়ার দাবিগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Bangla TV Europe : ২ মাসের মধ্যে দেশের সব আদালত কক্ষে বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রদর্শনে হাইকোর্টের নির্দেশ
- Prothom Alo : আদালতকক্ষে জাতির জনকের ছবি টাঙানোর নির্দেশ
- Jagonews24.com : সব আদালতের এজলাস কক্ষে বঙ্গবন্ধুর ছবি টানানোর নির্দেশ