ব্রাজিলে আজান নিষিদ্ধ শীর্ষক একটি তথ্য বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে প্রচারিত হয়ে আসছে। এমনকি ফেসবুকে প্রচারিত এই তথ্যের ভিত্তিতে কতিপয় ধর্মীয় বক্তা ওয়াজও করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ফুটবল বিশ্বকাপ ঘিরে পুনরায় তথ্যটির প্রচার লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ব্রাজিলে আজান নিষিদ্ধ শীর্ষক দাবিতে প্রচারিত কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। একই দাবিতে প্রচারিত কিছু ইউটিউব ভিডিও দেখুন এখানে ও এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্রাজিলে আজান দেওয়া নিষিদ্ধ শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয় বরং ব্রাজিলের মসজিদগুলোতে নিয়মিত আজান হচ্ছে, আজান দেয়ায় কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।
ব্রাজিলের বিভিন্ন মসজিদে আজানের প্রমাণ
রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধানে বেশকিছু মসজিদে মাইক্রোফোনে আজান দেয়ার ভিডিও খুঁজে পেয়েছে। নিচে ব্রাজিলের বেশকিছু মসজিদের আজানের ভিডিও প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা হলো।
১. অনুসন্ধানে ব্রাজিলের Foz do Iguaçu শহরে অবস্থিত Mesquita Omar Ibn Al-Khattab মসজিদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে আজানের একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওটি মসজিদে আযান চলাকালে ধারণ করা হয়। ভিডিওটি দেখুন এখানে।
মসজিদটি নিয়ে ব্রাজিলের RPC (rede de televisão) নামের একটি টিভি চ্যানেলের রমজান নিয়ে করা একটি রিপোর্টের ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানেও একটি অংশে মসজিদটিতে আজান হওয়ার দৃশ্য দেখা যায়। প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে।
২. অনুসন্ধানে তুরস্ক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম TRT World এর ইউটিউব চ্যানেলে ‘Ramdan in Brazil: Muslims in Sao Paulo adopt for Ramadan’ শিরোনামে ২০১৭ সালের ১০ জুন প্রকাশিত একটি ভিডিও পাওয়া যায়। রমজান নিয়ে করা উক্ত রিপোর্টের একটি অংশে ব্রাজিলের সাও পাওলোর অন্যতম প্রাচীন মসজিদ Mesquita do Bras (Bras Mosque) এ মাগরিবের আজান দেয়ার দৃশ্য দেখা যায়। রিপোর্টটি দেখুন এখানে।
৩. ব্রাজিলের Santa Catarina রাজ্যের 205 – Pinheirinho, Criciúma – SC তে অবস্থিত Mesquita Palestina নামের অপর একটি মসজিদের আজানের লাইভ ভিডিও আমরা খুঁজে পেয়েছি।
উক্ত মসজিদের খতিব/ইমাম, যার নাম Sheikh Adil Ali, তিনি ফেসবুক লাইভে ২০১৯ সালে একটি মাগরিবের আজান ধারণ করেন। তার লাইভ ভিডিওটি দেখুন– এখানে।
একই মসজিদের আরো একটি প্রকাশ্য আজানের ভিডিও দেখতে পারেন Sheikh Adil Ali এর ইনস্টাগ্রামে– এখানে।
৪. ব্রাজিলের Cuiabá শহরের মসজিদ Mesquita de Cuiabá এর মাগরিবের আজানের একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওটি মসজিদের মিনার থেকে ধারণ করেছেন ইমাম Sheikh Abdussalam Almansori। ভিডিওটি দেখুন– এখানে।
৫. অনুসন্ধানে সাও পাওলোর আরেক মসজিদ Mesquita da Virgem Maria এর ফেসবুক পেজে মাইক্রোফোনে আজানের একটি লাইভ ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। আজানের লাইভ ভিডিওটি দেখুন– এখানে।
৬. ২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে ব্রাজিলের আজান দেওয়া নিষিদ্ধ দাবিটি প্রচার করা হলে, দাবিটিকে মিথ্যা চিহ্নিত করে ব্রাজিলে বসবাসরত এক বাংলাদেশি প্রবাসী ব্রাজিলের সাও পাওলোর ‘Liga da Juventude Islâmica Beneficente do Brasil’ নামের একটি মসজিদের আাজানের ভিডিও ধারণ করে প্রচার করেন। তার ভিডিওটি দেখুন– এখানে।
ভিডিওটি ক্রসচেক করে রিউমর স্ক্যানার টিম নিশ্চিত হয়েছে এটি ব্রাজিলেরই একটি মসজিদের আজানের ভিডিও। গুগল ম্যাপসে যুক্ত করা উক্ত মসজিদের ফটকের ছবির সাথে আলোচিত ভিডিওটিতে দেখানো মসজিদের হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া গেছে।
রিউমর স্ক্যানার টিম উপরোক্ত ভিডিওগুলো ছাড়াও আরো বেশকিছু ভিডিও দেখার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে যে ব্রাজিলে আজানের ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা নেই এবং সেখানকার মসজিদগুলোতে স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিন আজান হচ্ছে।
ব্রাজিলের বিভিন্ন মসজিদ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
রিউমর স্ক্যানার টিম অধিকতর নিশ্চিতের জন্য ব্রাজিলের কয়েকটি মসজিদ কর্তৃপক্ষ, ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও সংস্থার সাথে যোগাযোগ করেছে৷ তাদের মধ্যে অনেকেই আমাদের মেসেজের উত্তর দিয়েছে এবং তারা সবাই নিশ্চিত করেছে যে, ব্রাজিলে আজান নিষিদ্ধ শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা।
১. ব্রাজিলের সাও পাওলোতে অবস্থিত Mesquita do Pari নামের একটি মসজিদের ফেসবুক পেজে অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাদের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার পাওয়া যায়।
উক্ত নাম্বারের হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করে ব্রাজিলে আজান দেয়া নিষিদ্ধ শীর্ষক দাবিটির সত্যতা জানতে চাইলে উক্ত মসজিদের সেক্রেটারি, যার নাম Ana, তিনি আমাদের নিশ্চিত করেন যে, এটি মিথ্যা, এমনকি আমরা এই বিষয় সম্পর্কে জানিও না।
২. ব্রাজিলের আরেক শহর Foz do Iguaçu তে অবস্থিত Mesquita Omar Ibn Al-Khattab নামের একটি মসজিদের ফেসবুক পেজেও তাদের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার পাওয়া যায়।
তাদের হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করে একই কথা জানতে চাইলে তারা এটিকে ভুয়া তথ্য হিসেবে আমাদের নিশ্চিত করে।
৩. ব্রাজিলের সাও পাওলোর Mesquita Abu Baker Assadik এর ফেসবুক পেজে তাদের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার পাওয়া যায়।
প্রাপ্ত হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারের মাধ্যমে সাও পাওলোর এই মসজিদ কর্তৃপক্ষের কাছে ব্রাজিলে আজান নিষিদ্ধ সত্য কি না জানতে চাইলে তারা জানায়, No, prohibization of Adhan here is fake.
৪. পরবর্তীতে ইসলামিক সেন্টার ব্রাজিল বা Centro Islâmico no Brasil নামে ব্রাজিলের ইসলাম ধর্মীয় একটি সংস্থার ফেসবুকে পেজে অনুসন্ধানে তাদের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার পাওয়া যায়।
তাদের সাথে যোগাযোগ করলে Islamic Center in Brazil রিউমর স্ক্যানারকে জানায়, ব্রাজিলে আজান নিষিদ্ধ এমন কোন তথ্য তাদের তথ্য তাদের জানা নেই, এটি সম্ভবত মিথ্যা।
৪. ব্রাজিলের ইসলাম ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, ইমাম এবং শিক্ষক Sheikh Rodrigo Rodriguez এর ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করে ব্রাজিলে আজান নিষিদ্ধ কি না জানতে চাইলে তিনিও এটিকে মিথ্যা বলে নিশ্চিত করেছেন।
অর্থাৎ, ব্রাজিলের বিভিন্ন মসজিদের আজানের ভিডিও এবং বিভিন্ন মসজিদ কর্তৃপক্ষ,ইসলামিক ব্যাক্তিত্ব/সংস্থার বক্তব্য অনুযায়ী নিশ্চিত হওয়া যায় যে ব্রাজিলে আজানে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।
সুতরাং, ব্রাজিলে আজান দেয়া নিষিদ্ধ শীর্ষক দাবিটি সম্পূর্ণ গুজব।
তথ্যসূত্র
- Azan video of 6 Brazilian Mosque
- Statement from 5 Brazilian mosque authorities.