আওয়ামী লীগের নামে আসিফ নজরুলের প্রশংসাসূচক এই বক্তব্যটি সম্পাদিত

সম্প্রতি, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল আওয়ামী লীগের প্রশংসা করেছেন দাবিতে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়েছে।

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল আওয়ামী লীগের প্রশংসা করেছেন দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি আসল নয় বরং, ২০২৪ সালের ২৯ অক্টোবর জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের সাথে সাক্ষাৎ শেষে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত একটি ব্রিফিংয়ের ভিডি সম্পাদিত করে আলোচিত অডিওটি যুক্ত করা হয়েছে।

ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে এতে শুরুতেই আসিফ নজরুলের একটি ভিডিও ফুটেজ দেখা যায়। এতে আসিফ নজরুলকে বলতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশে যত দল আছে বড় বড় দল তাদের মধ্যে সবচেয়ে গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত দল। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে সমস্ত গণতান্ত্রিক সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া দল। আওয়ামী লীগ ১৯৭২ সনে সংবিধান প্রতিষ্ঠাকারী দল, যে সংবিধানে ফ্রি এন্ড ফেয়ার ইলেকশনের আকাঙ্খা আছে, যে সংবিধানে সমাবেশের স্বাধীনতার কথা বলা আছে, বাক স্বাধীনতার কথা বলা আছে, আওয়ামী লীগ সেই দল যেই দলের প্রতিষ্ঠা দ্বারা এই স্বাধীনতাগুলো রক্ষা করার কথা বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত করে গেছে।

তবে, ভিডিও ফুটেজটিতে আসিফ নজরুলের মুখের অঙ্গভঙ্গির সাথে অডিওর অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়।

আলোচিত ভিডিওর ভয়েসওভারে বলতে শোনা যায়, দেশের একমাত্র গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও প্রশংসায় ভাসালেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এক সংবাদ গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নিয়ে বিস্তৃত বর্ণনা করেন তবে হঠাৎ করে আসিফ নজরুলের এমন বিভ্রান্তিকর মন্তব্যে থমকে গেছে উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলসহ সমন্বয়করাও। এই বিষয় নিয়ে সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন উল্লেখ করে সারজিস আলমের একটি ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়।

ভিডিও ফুটেজটিতে সারজিস আলমকে বলতে দেখা যায়, এরকভাবে প্রেজেন্ট করা হয়েছে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি করলেন বা এই বিষয়ে রিট করেছেন সারজিস হাসনাত। যেমন মিডিয়াতে এসেছে নিষিদ্ধের কথা, আমাদের রিটের কোনো সিঙ্গেল লাইনে কোনো একটি দল আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের কথা, নিবন্ধন বাতিলের কথা নেই।

ভিডিও ফুটেজটি দেখানোর পর ভয়েসওভার দেওয়া ব্যক্তি দাবি করেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করায় বেশ কিছু মন্তব্য করেছেন আসিফ নজরুল। আসিফ নজরুল বলেছেন দাবি করে বলেন, কোনো দলকে জনগনের মতামত না নিয়ে নিষিদ্ধ করা যায়না, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করলে বাংলা ভাষাকে অসম্মান করা হয়। এটার পক্ষে আমি নই।

এরপর আসিফ নজরুলের আরও একটি ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়। যেখানে আসিফ নজরুলকে বলতে শোনা যায়, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের একটি দাবি উঠেছে হাইকোর্টে, সেই অফিস থেকে এটার প্রতিবাদ করা হয়েছে, এটার বিপক্ষে দাড়িয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে কারি কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধের পক্ষে আমি না । আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগ্রামে এই দলটির অবদান ছিল।

আসিফ নজরুলের ভিডিও ফুটেজ যাচাই ০১

ফুটেজটি থেকে কিছু কী-ফ্রেম রিভার্স ইমেজ সার্চ করে এটিএন নিউজ এর ইউটিউব চ্যানেলে ২০২৪ সালের ২৯ অক্টোবর ‘নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু হয়ে গেছে জানালেন আইন উপদেষ্টা | Asif Nazrul | Election | ATN News’ শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত  একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। যার সাথে আলোচিত দাবির প্রচারিত ভিডিও ফুটেজের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।

ভিডিওটিতে নির্বাচান নিয়ে অন্যান্য প্রসঙ্গে কথা বলা ছাড়াও নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল অংশ নিতে পারবে কি না জানতে চাইলে আসিফ নজরুল বলেন, এটা আমার এখন বলার স্টেজ না, এখন আপনি যদি মনে করেন যারা হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, আরও ৪০-৫০ হাজার মানুষের অঙ্গহানি ঘটিয়েছে, চোখ কেড়ে নিয়েছে। এখনো তারা ঐটার পক্ষে কথা বলে, তাদের নেত্রীর রেকর্ডটা যদি কারেক্ট হয় হয়—২৮৭ জনকে দেখে নেবে এই ধরনের সন্ত্রাসী হুমকি দিচ্ছে অন্য দেশে বসে, যিনি একটা গণহত্যা মামলার আসামী আমার মনে হয় না বাংলাদেশের মানুষ এক্সেপ্ট করবে যে তাদের বিচার ও অনুশোচনা হওয়ার আগে তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি চালাবে কি আবারও হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করার জন্য? তাদের কথা শুনে তো তেমনই মনে হয়। ফলে, এগুলো একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসবে।

তিনি আরও বলেন, এত বড় একটি আন্দোলনকে তারা এখনো বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে, আন্দোলনের নেতাদের কিশোর গ্যাং বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে এবং সুযোগ পেলেই আরও মানুষকে হত্যা ও দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। এই দলের রাজনীতি করার অধিকার থাকা উচিত কি না, সেই প্রশ্নটি বাংলাদেশের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের কাছে রেখে গেলাম।

জানা যায়, ২০২৪ সালের ২৯ অক্টোবর জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের সাথে সাক্ষাৎ শেষে সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে এ মন্তব্য করেন তিনি।

অর্থাৎ, এই ভিডিওতে আসিফ নজরুল আওয়ামী লীগের প্রশংসা করেননি।

সারজিস আলমের ভিডিও ফুটেজ যাচাই 

ফুটেজটির কিছু কি ফ্রেম রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে দীপ্ত টিভির ইউটিউব চ্যানেলে ২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ চেয়ে কোনো রিট করা হয়নি: সারজিস আলম | Awami League Writ | Deepto News’ শীর্ষক শিরোনামেপ্রচারিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওর সাথে আলোচিত ফুটেজের মিল পাওয়া যায়।

ভিডিওতে, সেই সময় আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জন্য কোনো রিট করা হয়নি বলে জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম। গণমাধ্যমে প্রচারিত এমন খবরকে তিনি বিভ্রান্তিকর বলে উল্লেখ করেন।

আসিফ নজরুলের ভিডিও ফুটেজ যাচাই ০২

ভিডিও ফুটেজ থেকে কিছু কী-ফ্রেম রিভার্স ইমেজ সার্চ করে এটিএন নিউজের ইউটিউব চ্যানেলে ২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট ‘কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে আমি না- ড. আসিফ নজরুল । Dr. Asif Nazrul | Law Advisor’ শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। যার সাথে আলোচিত ভিডিওর ফুটেজের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

ভিডিওটিতে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, অনেকে মনে করে যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা দরকার, এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী? এর জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, যখন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার একটি দাবি হাইকোর্টে (রিট) করা হয়, তখন আপনি দেখেছেন আমাদের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে প্রতিবাদ করা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে আমি না। যদি না শক্তভাবে জঙ্গি তৎপরতা, রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা থাকলে সেটি সততার সঙ্গে তদন্ত করে এটি করা যেতে পারে। সাধারণ নিয়ম হিসেবে সংবিধানে সংগঠন করার স্বাধীনতা আছে।

তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগ্রামে এই দলটির অবদান ছিল। গত ১৫ বছরে তারা যা করেছে সেটা তাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে যায় না, সেটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে যায় না। তারা বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্বরতম এক ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল। এই কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যক্তিগত দায় থাকতে পারে। লিডারদের সামষ্টিক দায় থাকতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমি বলছি, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা সমীচীন হবে বলে মনে হয় না।

অর্থাৎ, ভয়েসওভারে করা ব্যক্তির দাবি অনুযায়ী আলোচিত ভিডিওতে ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করলে বাংলা ভাষাকে অসম্মান করা হয়। এটার পক্ষে আমি নই।’ এমন কোনো কথা বলতে আসিফ নজরুলকে দেখা যায়নি।

সুতরাং, ড. আসিফ নজরুল আওয়ামী লীগের প্রশংসা করেছেন দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত ভিডিওটি সম্পাদিত।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img