*#62# ডায়াল করে জানা যায় কে গোপনে কল রেকর্ড করছে?

সম্প্রতি “আপনার ফোনে *#62# ডায়াল করে দেখুন যদি ফরওয়ার্ড লেখা উঠে,তাহলে বুঝবেন কেউ গোপনে আপনার কথা রেকর্ড করে রাখছে,সে যার সাথেই কথা বলেন না কেনো!!আর সেটা রিমুভ করার জন্য ডায়াল করতে হবে ##002#” শীর্ষক শিরোনামে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, *#62# ডায়াল করে গোপনে কল রেকর্ড করা হচ্ছে কি না তা জানা যাওয়ার দাবিটি সঠিক নয় বরং কোডটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের তাদের ফোনের কল ফরোয়ার্ডিং সেটিংস সম্পর্কে জানতে সহায়তা করে।

কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে Gadgethack নামের একটি ওয়েবসাইটে ২০২১ সালের ১৯ মার্চ “Dial These Secret Codes to See if Someone Is Hijacking Calls & Texts on Your iPhone” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, *#62# কোডটি একটি সেটিংস ইন্টারোগেশন কোড। যখন কোনো নাম্বার ব্যবহারকারী তার ফোনের কল বা ম্যাসেজ রিসিভ করতে না পারে তখন সেই কল বা ম্যাসেজটি কোথায় যায় এই কোডটি (*#62#) ডায়াল করে তা দেখা যায়।

প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা যায়, এই কোড ডায়ালের পর ভয়েস কল ফরোয়ার্ডিং, ডাটা কল অর্থাৎ ইন্টারনেট ফোন ফরোয়ার্ডিং, এসএমএস কল ফরোয়ার্ডিংয়ে যদি কারো নাম্বার তালিকাভুক্ত থাকে তাহলে কল বা ম্যাসেজগুলো সেখানে যায়। কিন্তু আবার, এখানে নাম্বার হিসেবে মোবাইল ব্যবহারকারীর ভয়েস মেইলবক্সের নাম্বারও থাকতে পারে।

এই প্রতিবেদনটি থেকে কল ফরোয়ার্ড ও ভয়েস মেইলবক্স সম্পর্কে জানা যায়।

 এর মধ্যে কল ফরোয়ার্ড সম্পর্কে  বিখ্যাত ইংরেজি অভিধান Merriam-Webster বলছে, কল ফরোয়ার্ড হলো এমন একটি সেবা, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারী তার টেলিফোন বা ফোনে আসা কলকে ভিন্ন আরেকটি নাম্বারে ফরোয়ার্ড করে দিতে পারে। 

এছাড়া Dictionary.com নামের আরেকটি অভিধান অনুযায়ী, কল ফরোয়ার্ড হচ্ছে এমন একটি পরিষেবা, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা তার ফোনে আসা সকল কলকে অন্য আরেকটি নাম্বারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাঠিয়ে দিতে পারে।

অর্থাৎ কল ফরোয়ার্ডিং হলো এমন একটি পরিষেবা, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা তার ফোনে আসা কলকে অন্য আরেকটি নাম্বারে পাঠিয়ে দিতে পারে। 

কল ফরোয়ার্ডিংয়ের এই সংজ্ঞা থেকে বুঝা যায়, কল ফরোয়ার্ডের বিষয়টি পুরোটাই নাম্বার ব্যবহারকারীর উপর নির্ভর  করে৷

অপরদিকে ভয়েস মেইলবক্স সম্পর্কে ইংরেজি অভিধান Merriam-Webster বলছে, এটি একটি ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, যেখানে ব্যবহারকারীর বার্তাগুলো সংরক্ষণ করা হয় এবং পরবর্তীতে গ্রাহককে শোনানোর উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত হয়।

এছাড়া ভয়েস মেইল সম্পর্কে বাংলাদেশে মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান Airtel তাদের ওয়েবসাইটে জানায়, ভয়েস মেইল হচ্ছে কলের উত্তর ও গন্তব্য ঠিক করে দেওয়ার একটি মিথস্ক্রিয়ামূলক কম্পিউটারাইজড সিস্টেম। এই সিস্টেমটি বার্তা রেকর্ড ও শ্রবণের জন্য কাজ করে।

পাশাপাশি ওয়েবসাইটটি থেকে আরও জানা যায়, এই ভয়েস মেইল সার্ভিস স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এছাড়া ভয়েস মেইল সার্ভিস কিভাবে চালু ও বন্ধ  করতে হবে সে সম্পর্কিত তথ্যও ওয়েবসাইটটিতে উল্লেখ করে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, এয়ারটেলের ভয়েস মেইলের নাম্বার হচ্ছে 8121।

প্রতিবেদনে পাওয়া এই তথ্যগুলোর অধিকতর সত্যতা অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার টিম বিষয়টি নিজেরা যাচাই করে দেখে। 

এজন্য রিউমর স্ক্যানার টিম একটি এয়ারটেলের সিম থেকে *#62# কোডটি ডায়াল করে। 

ডায়াল করার পর দেখা যায়, কল ফরোয়ার্ডিংয়ের ক্ষেত্রে ভয়েস কলটি এয়ারটেলের ভয়েস মেইলের নাম্বার 8121 এ ফরোয়ার্ড করা৷ অর্থাৎ, এয়ারটেল ব্যবহারকারী কোনো গ্রাহক যদি তার ফোনে আসা কল না ধরে সেক্ষেত্রে সেটি এয়ারটেলের ভয়েস মেইল নাম্বার 8121 নাম্বারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফরোয়ার্ড হয়ে যায়। 

এছাড়া একই সিমের কল ফরোয়ার্ডিং সম্পর্কিত তথ্য অনুসন্ধান করে দেখা যায়, এই সিমের গ্রাহক যদি ব্যস্ত থাকে, ফোনের উত্তর না পাওয়া যায় বা সিমের গ্রাহককে যদি পাওয়া না যায় সেক্ষেত্রেও ঐ সিমের কলগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে এয়ারটেলের ভয়েস মেইল নাম্বার 8121 এ ফরোয়ার্ড হয়ে যায়৷

পাশাপাশি গ্রাহক চাইলে এই ভয়েস মেইলের নাম্বারটি নিজের মতো করে পরিবর্তনও করে নিতে পারেন৷ 

এই পর্যন্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, কল ফরোয়ার্ড ও ভয়েস মেইলের সঙ্গে গোপনে আপনার কথা রেকর্ড করে রাখার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এই বিষয়টি পুরোটাই মোবাইল ফোনে সিম ব্যবহারকারী ও সিমের সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে৷ 

পরবর্তীতে কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে আমেরিকান ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান USA Today এর ওয়েবসাইটে ২০২০ সালের ২৩ জুলাই”Fact check: Dialing this viral code will show call forwarding status, not a phone tap” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, এই ধরণের কোডগুলো হচ্ছে ইন্টারোগেশন কোড। যা মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের তাদের ফোনের কল ফরোয়ার্ডিং সেটিংস সম্পর্কে জানতে সহায়তা করে।

প্রতিবেদনটিতে অ্যাপলের সিনিয়র পাবলিকেশন ম্যানেজার অ্যালেক্স ক্রিসনারকে উদ্ধৃত করে আরও বলা হয়, কল ফরোয়ার্ডিং সেটিংসের সাথে ফোন রেকর্ডের বিষয়টি পুরোটাই অযৌক্তিক।

পাশাপাশি একই বিষয়ে গুগলের নিরাপত্তা বিষয়ক কমিউনিকেশন্স ম্যানেজার স্কট ওয়েস্টওভারকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, এগুলো কল ফরোয়ার্ডিং ছাড়া আর কিছুই না। 

এছাড়া প্রতিবেদনটিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গোপনে রেকর্ড রাখার বিষয়টি মুছে দিতে ডায়াল করার ##002# কোডটি সম্পর্কে বলা হয়, এই কোডটি দিয়ে কল ফরোয়ার্ডের সেটিংসটি বন্ধ করে দেওয়া যায়। 

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানেও এই বক্তব্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।

অর্থাৎ, *#62# ডায়ালের মাধ্যমে কারো কথা গোপনে রেকর্ড করে রাখলে সেটি সম্পর্কে জানা যাবে দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি মূলত মোবাইল ফোনের কল ফরোয়ার্ডিং সেটিংস। যা মূলত ব্যবহারকারীরা তার ফোনে আসা কলকে অন্য আরেকটি নাম্বারে পাঠিয়ে দিতে ব্যবহার করে। পাশাপাশি ব্যবহারকারী চাইলে ##002# কোড দ্বারা এই কল ফরোয়ার্ডিং সেটিংসটি বন্ধ করে দিতে পারেন। এই কোডের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কারো কথা গোপনে রেকর্ড করে রাখলে সেটি সম্পর্কে জানতে পারার কোনো সম্পর্ক নেই৷  

মূলত, *#62# কোডটি একটি ইন্টারোগেশন কোড। যা মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের তাদের ফোনের কল ফরোয়ার্ডিং সেটিংস সম্পর্কে জানতে সহায়তা করে। কল ফরোয়ার্ড হচ্ছে এমন একটি পরিষেবা, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা তার ফোনে আসা সকল কলকে অন্য আরেকটি নাম্বারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাঠিয়ে দিতে পারে। কল ফরোয়ার্ডিং সম্পর্কিত এই কোডের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কারো কথা গোপনে রেকর্ড করে রাখলে সেটি সম্পর্কে জানতে পারার কোনো সম্পর্ক নেই৷ পাশাপাশি ব্যবহারকারী চাইলে ##002# কোড দ্বারা এই কল ফরোয়ার্ডিং সেটিংসটি বন্ধ করে দিতে পারেন। তবে এই বিষয়টিই বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কোডটি ডায়াল করে যদি ফরওয়ার্ড লেখা উঠে,তাহলে গোপনে কল রেকর্ড করে রাখার  দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।

সুতরাং, *#62# ডায়াল করে গোপনে কল রেকর্ড করা হচ্ছে কি না তা জানা যাওয়ার দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img