সম্প্রতি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে “১৫ রমজান শুক্রবার পৃথিবীতে বিকট শব্দ ঘটবে” শীর্ষক একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে। আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
ইউটিউবে প্রচারিত এমন কিছু ভিডিও দেখুন এখানে ও এখানে। আর্কাইভ এখানে ও এখানে।
টিকটকে প্রচারিত এমন দাবির ভিডিও দেখুন এখানে, এখানে। আর্কাইভ এখানে ও এখানে।
হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে করা পোস্টগুলোতে যা দাবি করা হচ্ছে
“বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১৫ রমজান শুক্রবারে পৃথিবীতে আসতে পারে এক বিকট শব্দ। যার ফলে ৭০ হাজার মানুষ বধির, ৭০ হাজার মানুষ বাকরূদ্ধ ,৭০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করতে পারেন।”
এ প্রসঙ্গে যে হাদিসটি প্রচার করা হচ্ছে
ফিরোজ দায়লামি বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোন এক রমজানে আওয়াজ আসবে।’
সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! রমজানের শুরুতে? নাকি মাঝামাঝি সময়ে? নাকি শেষ দিকে’? নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “না, বরং রমজানের মাঝামাঝি সময়ে। ঠিক মধ্য রমজানের রাতে। শুক্রবার রাতে আকাশ থেকে একটি শব্দ আসবে। সেই শব্দের প্রচণ্ডতায় সত্তর হাজার মানুষ সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলবে আর সত্তর হাজার বধির হয়ে যাবে।”
সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার উম্মতের মধ্যে কারা সেদিন নিরাপদ থাকবে?
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “যারা নিজ নিজ ঘরে অবস্থানরত থাকবে, সিজদায় লুটিয়ে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং উচ্চ শব্দে আল্লাহু আকবর বলবে।
পরে আরও একটি শব্দ আসবে। প্রথম শব্দটি হবে জিবরাইল এর, দ্বিতীয়টি হবে শয়তানের।
(ঘটনার পরম্পরা এরূপ)
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত অর্থাৎ ১৫ রমজান শুক্রবারে পৃথিবীতে বিকট শব্দ আসার ফলে ৭০ হাজার মানুষ বধির, ৭০ হাজার মানুষ বাকরূদ্ধ এবং ৭০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করতে পারে শীর্ষক যে দাবিটি করা হচ্ছে তা সঠিক নয় বরং যে হাদিসটি প্রচার করার মাধ্যমে উক্ত দাবি করা হচ্ছে সেটি একটি জাল ও বানোয়াট হাদিস।
হাদিসটির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে জানতে রিউমর স্ক্যানার টিম সৌদি আরবের মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের লিসান্স ও জুবাইল দাওয়াহ সেন্টারের দাঈ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীলের সাথে যোগাযোগ করে। তিনি রিউমর স্ক্যানারকে হাদিসটি জাল বলে নিশ্চিত করার পাশাপাশি উক্ত হাদিস নিয়ে ২০২০ সালের ২১ মার্চ তাঁর নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া একটি পোস্ট শেয়ার করেন। যেখানে তিনি হাদিসটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন।
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল তার পোস্টটিতে লিখেছেন, ইমাম মাহদির আগমনের পূর্বে কোন এক রমজান মাসের মাঝামাঝিতে আকাশ থেকে বিকট আওয়াজ আসা তারপর সত্তর হাজার মানুষ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, সত্তর হাজার মানুষ বধির হয়ে যাওয়ার হাদিস অত্যন্ত দুর্বল মতান্তরে বানোয়াট ও বাতিল।
হাদিসটি সম্পর্কে মুহাদ্দিস বা হাদিস বিশারদদের মতামত উল্লেখ করে তিনি লিখেন,
- শাইখ আলবানী বলেন, উল্লেখিত হাদিসটি موضوع বা বানোয়াট।
- ইবনুল জাওযী তার আল মাউযুআত বা বানোয়াট হাদিস সংকলন গ্রন্থে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। (৩/১৯১) । তিনি বলেন: “هذا حديث لا يصح। অর্থাৎ এ হাদিসটি সহিহ নয়।
কারণ এর সনদে আব্দুল ওয়াহাব নামক একজন বর্ণনাকারী আছে, তার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ শক্ত আপত্তি করেছেন। যেমন:
ক. উকাইলী বলেন: عبد الوهاب ليس بشيء “আব্দুল ওয়াহাব কিছুই নয়।” (এ বাক্যটি দ্বারা বর্ণনাকারীর প্রতি কঠোর সমালোচনা বুঝায়।)
খ. ইবনে হিব্বান বলেন: كان يسرق الحديث ؛ لا يحل الاحتجاج به “সে হাদিস চুরি করত। তার বর্ণিত হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করা বৈধ নয়।”
গ. দারাকুতনী বলেন: منكر الحديث বা মুনকারুল হাদিস। এছাড়াও সনদে আরও সমস্যা আছে। (শাইখ আলবানী রহ. এর সিলসিলা যঈফার ৬০৭৮ ও ৬০৭৯ নং হাদিস পর্যালোচনা থেকে সংক্ষেপিত)।
- এই হাদিসটিকে বাতিল উল্লেখ করে ইমাম যাহাবী বলেন, এ হাদিসটি বাতিল। (তারতীবুল মাউযুআত, ২৭৮)
- হাইসামী বলেন, এই হাদিসের বর্ণনা সূত্রে আব্দুল ওহাব ইবনুয যাহহাক নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছে যে মুহাদ্দিসীনদের দৃষ্টিতে মাতরূক বা পরিত্যাজ্য। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৭/৩১৩
ইমাম ইবনুল কাইয়েম বলেন, “অগ্রিম তারিখ নির্ধারণ করে বিভিন্ন ঘটনার ঘটার বেশ কিছু হাদিস পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলো সহিহ নয়।” সে সব হাদিসের মধ্যে একটি হল, “অর্ধ রমজানের জুমার রাতে একটি আওয়াজ হবে। এতে সত্তর হাজার মানুষ বেহুশ হয়ে পড়ে যাবে….সত্তর হাজার মানুষ বোবা হয়ে যাবে…..।” [আল মানারুল মুনীফ, পৃষ্ঠা নম্বর ৯৬]
সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি বিশিষ্ট ফকিহ শাইখ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায রহ. উক্ত হাদিসটি উল্লেখ করে বলেছেন,
“এই হাদিসের বিশুদ্ধতার কোন ভিত্তি নেই বরং তা মিথ্যা এবং বানোয়াট। মুসলিমরা বহু বছর দেখেছে যে, শুক্রবারের রাত মধ্য রমজানে পড়েছিল, কিন্তু উল্লেখিত বিকট আওয়াজ ইত্যাদি কোন কিছুই ঘটেনি আলহামদুলিল্লাহ।”
পরবর্তীতে অনুসন্ধানে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্কলার মুখতার আহমেদের এ প্রসঙ্গে করা একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।
ভিডিওটিতে মুখতার আহমাদ উক্ত হাদিসটিকে বানোয়াট উল্লেখ করে যে দলিলগুলো তুলে ধরেছেন, সেগুলোর সঙ্গে আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীলের দলিলগুলোর মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
এছাড়া মুখতার আহমাদ বলেন, হাদিসটিতে যে রমজান মাসের কথা বলা হচ্ছে, যেটি শুরু হবে শুক্রবারে ও মধ্য রমজান হবে শুক্রবারে। সেটি আসলে কোন দেশের, কোন সময়ের কথা বলা হচ্ছে? আমরা জানি, আরব বিশ্বে রমজান শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবারে। অর্থাৎ, বুধবার রাতে তারা সেহরি খেয়েছেন, তারাবি পড়েছেন। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে আমরা দেখি আমরা বৃহস্পতিবার রাতে সেহরি খেয়েছি, তারাবি পড়েছি এবং শুক্রবার থেকে রোজা রেখেছি৷ তাহলে আসলে কোন সময়ের কথা আমরা বলছি? সমগ্র বিশ্বে তো রোজা শুরু হয়েছে আরও আগে। তাহলে এখানে কোন সময়ের কথা বলা হচ্ছে?
আলোচিত হাদিসটিতে উল্লেখিত বিকট আওয়াজ ও ভূমিকম্প প্রসঙ্গে মুখতার আহমাদ রাসুল (সা.) এর একটি হাদিস উল্লেখ করে বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার এই উম্মত একটি রহমতপ্রাপ্ত উম্মাত। আল্লাহ তায়ালা অন্যান্য জাতিগুলোকে যেভাবে ধ্বংস করে দিয়েছেন, বিকট আওয়াজের মাধ্যমে, ভূমিকম্পের মাধ্যমে, এদেরকে এভাবে ধ্বংস করে দিবেন না৷ তবে এই বিপদগুলো তাদের আসবে’৷ বিপরীতে আলোচিত হাদিসটিতে যে বিকট আওয়াজের কথা বলা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ বাতিল এবং বানোয়াট বক্তব্য। এগুলোর উপর আমাদের বিশ্বাস করা ঠিক হবে না।
ইমাম মাহদীর আগমন সম্পর্কে মুখতার আহমাদ বলেন, আলোচিত হাদিসটি দিয়ে ইমাম মাহদীর আগমন সম্পর্কে বলা হচ্ছে। কিন্তু ইমাম মাহদী হচ্ছে কিয়ামতের আলামতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ছোট এবং সর্বশেষ আলামত। এরপর আর ছোট আলামত ঘটবে না। বড় আলামত প্রকাশ পাবে। যেটি ঈসা (আ.) এর আগমনের মাধ্যমে আমরা শুরু হবে বলে জানি৷ এখনই তো ছোট আলামত সব শেষ হয়নি। ৫০ টি ছোট আলামত আছে। বড় আলামত তাহলে কখন আসবে? কিভাবে আসবে? ইমাম মাহদীর আগমনের পূর্বে পৃথিবীর যেমন থাকবে বলে হাদিসে উল্লেখ আছে, পৃথিবী কি এখন তেমন আছে? পাশাপাশি ইমাম মাহদী নিজেও জানবেন না যে তিনি ইমাম মাহদী হবেন! অন্যরা তাকে নেতা বানাবেন তারপর প্রমাণিত ও প্রকাশিত হবে যে তিনি ইমাম মাহদী। এখন যা প্রচার হচ্ছে, এগুলো সবই কি বানোয়াট কথা নয়? আসলে এগুলো সবই বানোয়াট কথা।
এছাড়া আলোচিত হাদিসটির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে জানতে রিউমর স্ক্যানার টিম হাদিস বিষয়ক বাংলা ভাষার ওয়েবসাইট Hadith BD তে যোগাযোগ করলে তাদের পক্ষ থেকেও উক্ত হাদিসটি জাল বলে রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করা হয়।
উল্লেখ্য, আলোচিত এ হাদিসটির বিশুদ্ধতার বিষয়ে অন্যান্য আলেম যেমন, ঢাকার মারকাযুল কুরআন মাদ্রাসার শিক্ষক ইউসুফ আল ওবায়দীর পোস্ট দেখুন এখানে, ইসলামিক স্কলার আরিফ বিন হাবিবের পোস্ট দেখুন এখানে।
এছাড়া ইতোপূর্বে একটি ওয়াজে ঢাকার মুগদা মদিনাবাগের বাইতুল ওয়াদুদ জামে মসজিদের খতিব সাদিকুর রহমান আজহারী ১৫ রমজান শুক্রবারে বিকট আওয়াজ হবে শীর্ষক আলোচনা করেন। তবে পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাদিসটি নিয়ে আলোচনা শুরু হলে তিনি তার ফেসবুক পেইজে লিখেন, “যে হাদিসগুলো আমার আলোচনায় বলা হয়ে থাকে সেগুলোর ব্যাপারে অবশ্যই আরো ভালো তাহকিক করে বলা উচিত। কিয়ামতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কিতাবুল ফিতানের একটি হাদিস খুব ভালোভাবে তাহকিক করা ছাড়াই আমার আলোচনায় অনেকে শুনেছেন। এই হাদিসের ব্যাপারে সর্বোপরি কথা হলো: ১৫ ই রমাদান শুক্রবার বিকট আওয়াজ হওয়া সংক্রান্ত হাদিসটি গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়। ইতিপূর্বে বহু রমজান শুক্রবার দ্বারা শুরু এবং ১৫ রমজান শুক্রবার হয়েছে। অথচ বিকট শব্দ হয়নি। হাদিসটির বর্ণনাকারীদের কেউ মুনকার, দুর্বল (১)ইবনে লাহিয়াহ,(২)মুহাম্মাদ ইবনে সাবেত আল বুনানি, কেউ অত্যন্ত দুর্বল(৩)হারেস আল হামদানি, কেউ আবার একেবারেই পরিত্যাজ্য,(৪) আব্দুল ওয়াহাব ইবনে জাহহাক। তাই সনদের মানদণ্ডে উক্ত হাদিসটি ‘যয়িফ জিদ্দান’ তথা নিতান্তই দুর্বল। যা গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসগণ উক্ত হাদিসকে জাল/বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বলেছেন। যেমন, ইমাম উকাইলী রহ: বলেছেন, এই হাদীসটির নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী হতে কোনো ভিত্তি নেই। অনুরূপ কোনভাবেই এটি টিকে না। (আয যোআফা আল কাবীর ৫২/৩)।…সুতরাং উক্ত ভিত্তিহীন হাদিসে বিশ্বাসী না হয়ে তা প্রচার থেকে বিরত থেকে বরাবরের ন্যায় বেশি বেশি আল্লাহর আনুগত্যতার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফিক দান করুন।”
মূলত, সম্প্রতি একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে যে, ‘১৫ রমজান শুক্রবার(বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত) রাতে পৃথিবীতে আসতে পারে এক বিকট শব্দ। যার ফলে ৭০ হাজার মানুষ বধির, ৭০ হাজার মানুষ বাকরূদ্ধ ,৭০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করতে পারেন। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, যে হাদিসটিকে উদ্ধৃত করে আলোচ্য দাবিটি করা হচ্ছে সে হাদিসটি কোনো বিশুদ্ধ হাদিস নয়। এ হাদিসটি সম্পর্কে হাদিস বিশারদগণ বলছেন, এটি একটি মিথ্যা, বানোয়াট হাদিস। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এই হাদিসটির কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নাই।অর্থাৎ, ১৫ রমজান বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে (শুক্রবার) পৃথিবীতে বিকট শব্দ হওয়ার দাবিতে যে হাদিসটি প্রচার করা হচ্ছে; সেটির গ্রহণযোগ্যতা নেই।
সুতরাং, ১৫ রমজান (৭ এপ্রিল) শুক্রবার পৃথিবীতে বিকট শব্দ হবে দাবিতে প্রচারিত দাবিটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল ফেসবুক পোস্ট
- Mokhter Ahmad Facebook Post
- Contact with Hadith BD