গত ০৯ আগস্ট ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নারী চিকিৎসক মৌমিতা দেবনাথকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ এসেছে। এই ঘটনার বিচার চেয়ে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। দেশটির আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বাংলাদেশেও হয়েছে প্রতিবাদ।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মৌমিতার দেহে ১৫০ গ্রাম বীর্য পাওয়া গেছে একটি দাবি গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
উক্ত দাবি উল্লেখপূর্বক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন ঢাকা পোস্ট এবং ভোরের কাগজ।
ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
টিকটকে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, মৌমিতা দেবনাথের দেহে ১৫০ গ্রাম বীর্য পাওয়ার দাবিটি সঠিক নয় বরং, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মৌমিতার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ জননাঙ্গের সম্মিলিত ওজন ১৫১ গ্রাম হিসেবে উল্লেখ করার বিষয়টি ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে এটি তার দেহ থেকে প্রাপ্ত সিমেন বা বীর্যের ওজন দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য রিউমর স্ক্যানার বিশ্বস্ত সূত্রের মাধ্যমে মৌমিতা দেবনাথের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন সংগ্রহ করেছে।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ভিকটিম অর্থাৎ মৌমিতার শরীরের বিভিন্ন অংশের বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যেখানে দেহের প্রতিটি অংশকে আলাদা সারিতে এবং প্রতিটি অঙ্গকে আলাদা কলামে দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি অঙ্গগুলোর ওজন এবং অবস্থাও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে প্রতিটি অঙ্গের ওজন ‘Wt’ দিয়ে এবং গ্রামকে “gm” দিয়ে সংক্ষেপে লেখা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, হৃদপিণ্ডের ওজন ২১২ গ্রামকে “Wt -212 gm”, যকৃতের ওজন ১১৩৪ গ্রামকে “Wt -1134 gm”, এবং প্লীহার ওজন ৯০ গ্রামকে “Wt -90 gm” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
রিপোর্টের একটি নির্দিষ্ট অংশে ‘বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ জননাঙ্গ (External and Internal Genitalia)’ শিরোনামে বলা হয়েছে: “As noted. White thick viscid liquid present inside endocervical canal, which is collected as noted above. Wt-151 gm.” অর্থাৎ, এন্ডোসার্ভিকাল নালিতে সাদা ঘন আঠালো তরল পাওয়া গেছে, যা উপরে উল্লিখিত পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা হয়েছে। ওজন ১৫১ গ্রাম।
এই তথ্যের ভুল ব্যাখ্যার ফলস্বরূপ মৌমিতার দেহে ১৫০ গ্রাম বীর্য পাওয়ার দাবিটি ছড়িয়ে পড়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে, এখানে ১৫১ গ্রাম ওজন দিয়ে আসলে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ জননাঙ্গের সম্মিলিত ওজন বোঝানো হয়েছে। শুধু ওই সাদা তরলের ওজন বোঝানো হয়নি।
এই বিষয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম নিউজলন্ড্রি ময়নাতদন্ত বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জেনেছে, “Wt-151 gm” আসলে ভিকটিমের যোনির (যোনিপথ, যা বাহ্যিক জননাঙ্গকে জরায়ুর সার্ভিক্সের সাথে সংযুক্ত করে) ওজন বোঝায়, বীর্যের নয়। ময়নাতদন্তের সময় বিভিন্ন অঙ্গের ওজন মেপে রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা পরে ভিসেরা পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই ক্ষেত্রে ১৫১ গ্রাম ওজন যোনির জন্য প্রযোজ্য, বীর্যের জন্য নয়। রিপোর্টে ভিকটিমের দেহ থেকে সংগ্রহ করা অন্যান্য অঙ্গের ওজনও উল্লেখ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভিকটিমের যকৃৎ সংকুচিত অবস্থায় ১১৩৪ গ্রাম ওজনের ছিল, প্লীহা সুস্থ অবস্থায় ৯০ গ্রাম ওজনের ছিল, এবং কিডনিগুলো সংকুচিত অবস্থায় যথাক্রমে ৮২ গ্রাম (ডান) এবং ৮৮ গ্রাম (বাম) ওজনের ছিল। এক বিশেষজ্ঞের মতে, ময়নাতদন্তে পাওয়া পদার্থ শনাক্ত করা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব এবং তারা প্রথমে বীর্য শনাক্ত করে। এরপর ডিএনএ পরীক্ষা করে পুলিশকে সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করতে সহায়তা করেন।
এছাড়া, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ কমিশনার বিনীত কুমার গোয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করেছেন যে, ১৫০ গ্রাম বীর্য পাওয়ার দাবিটি মিথ্যা। ভারতের ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা অল্ট নিউজ সহ একাধিক গণমাধ্যমও (১, ২) এই দাবিটিকে গুজব হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
সুতরাং, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নারী চিকিৎসক মৌমিতা দেবনাথকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় তার দেহ থেকে ১৫০ গ্রাম বীর্য পাওয়া গেছে বলে প্রচারিত দাবিটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Post-mortem report of Moumita Debnath
- ANI – X Post
- Newslaundry – ‘150 mg of semen’? What the Kolkata doctor’s post mortem actually says
- News18 – Kolkata Doctor Rape-Murder: Post-Mortem Report Reveals 150 Gram Is Uterus Weight, Not Semen; DNA Analysis Crucial