রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার আস্তানায় গত ৫ সেপ্টেম্বরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ঐদিন জুমার নামাজের পর ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে একদল লোক এই হামলা চালায়। এক পর্যায়ে নুরুল হকের লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তিনি ২৩ আগস্ট বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় মারা যান। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, ছবিটি সত্তরের দশকে (১৯৭৪-৭৫ সালে) তুলা নুরুল হক (নুরাল পাগলা) এর ছবি।

এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
এরূপ দাবিতে ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
এরূপ দাবিতে টিকটকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ছবিটি সাম্প্রতিক সময়ের রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের নুরাল পাগলার ছবি নয়। প্রকৃতপক্ষে, ঢাকার নূরা পাগলা নামে ভিন্ন এক ব্যক্তির ছবিকে আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে ‘ক্যামেরাল্যাবস’ নামক প্ল্যটফর্মে আলোচিত ছবিটি ১৯৭৪-৭৫ সালে ফটোগ্রাফার ‘এড ভ্যান ড্যার এল্সকেন’ এর ধারণকৃত ঢাকার এক ফকিরের ছবি দাবিতে পাওয়া যায়। তবে প্ল্যাটফর্মটিতে ছবির ব্যক্তির পরিচয়ের বিষয়ে কোনো বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
পরবর্তী অনুসন্ধানে জ্যৈষ্ঠ সাংবাদিক ‘আনোয়ার পারভেজ হালিম’ এর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এ বিষয়ে গত ৬ সেপ্টেম্বরে প্রচারিত একটি পোস্ট পাওয়া যায়। পোস্টটিতে সংবাদপত্র বিচিত্রার ছবি ও রাজবাড়ীর নুরাল পাগলার ছবির সাথে আলোচিত ছবিরও সংযুক্তি পাওয়া যায়।
পোস্টটির ক্যাপশনে বলা হয়, “বিচিত্রার নূরা পাগলা এবং গোয়ালন্দের নূরাল পাগলা এক নয় | রাজবাড়ির গোয়ালন্দে নূরাল পাগলার মাজারে হামলা, কবর থেকে লাশ তুলে পুড়িয়ে ফেলার পর অনেকেই দেখছি বিচিত্রার একটি পুরোনো প্রচ্ছদ পোস্ট করেছেন। বিচিত্রা নূরা পাগলা ও পপ গায়ক আজম খানকে নিয়ে ১৯৭৩ সালে একটি কাভার স্টোরি করেছিল। পোস্টদাতাদের দাবি, বিচিত্রার সেই নূরা পাগলা আর গোয়ালন্দের নূরাল পাগলা একই ব্যক্তি। তাদের এই দাবি সঠিক নয়। মিথ্যা। বিচিত্রার নূরা পাগলা ছিলেন শিক্ষিত। মুক্তিযোদ্ধা। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী (সূত্র: সৈয়দ তারিক)। যুদ্ধফেরত নূরা মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়াতেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে হাইকোর্টের মাজারে। আধ্যাত্মিক গান করতেন।.. ২০০৮ সালের দিকে সর্বশেষ জেনেছিলাম, নূরা পাগলা অসুস্থ। গুলশানের শাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সম্ভবত ওই সময়ে বা তার কিছু পরে তিনি মারা যান।..” উল্লেখ্য, পোস্টটিতে বিচিত্রার নূরা পাগলা বলতে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবির ব্যক্তিকে বুঝানো হয়।
পাশাপাশি, ‘আনোয়ার পারভেজ হালিম’ এর পোস্টটি উদ্ধৃত করে একাধিক মূলধারার গণমাধ্যমেও প্রতিবেদন প্রকাশ হতে দেখা যায়।
এছাড়াও, অনুসন্ধানে লেখক, গবেষক ও শিক্ষক ‘সাহাদাত পারভেজ’ এর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গত ৬ সেপ্টেম্বরে প্রচারিত একটি পোস্ট পাওয়া যায়। পোস্টটিতে ঢাকার নূরা পাগলাকে নিয়ে ১৯৭৩ সালের ১০ আগস্টে বিচিত্রায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের স্ক্রিনশটের সংযুক্তি পাওয়া যায়। পোস্টের ক্যাপশনে তিনি লিখেন, তিনি নূরা পাগলাকে চিনতেন। তার পোস্টে সংযুক্ত বিচিত্রার প্রতিবেদনে ঢাকার নূরা পাগলার একাধিক ছবিরও সংযুক্তি পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে নূরা পাগলা সম্পর্কে বলা হয়, “নূরা পাগলার বয়স আশির ওপরে। অথচ পেশীবহুল পেটানো শরীর দেখে মনে হবে কোনোক্রমেই ষাট পেরোয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি বৃটিশ আর্মিতে ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ করেছেন। বসরার কথা তার এখনো মনে আছে।…তার আসল নাম কেউ জানে না। তিনি নিজেও জানেন না তার স্ত্রী পুত্র কে কোথায় আছে। বাড়ি নোয়াখালীতে। অনেক বছর বাড়ির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। লোকে যা টাকা পয়সা দেয় তাতেই খাওয়াটা হয়ে যায়।..”
এছাড়াও, বিচিত্রায় নূরা পাগলাকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয়ে আরো একাধিক ফেসবুক পোস্ট পাওয়া যায়।
১৯৭৩ সালে প্রকাশিত বিচিত্রার প্রতিবেদনে বলা হয় ঢাকার নূরা পাগলার বয়স ৮০, তবে দেখতে লাগে ৬০ বছরের মতো। অর্থাৎ, এ হিসেবে ঢাকার নূরা পাগলার জন্ম ১৮৯৩ সাল থেকে ১৯১৩ সালের ভেতর বা কাছাকাছি সময়ে।
অপরদিকে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলাকে নিয়ে মূলধারার গণমাধ্যম দৈনিক আমাদের সময়, ঢাকা পোস্টসহ একাধিক গণমাধ্যমে প্রচারিত খবরে বলা হয়, রাজবাড়ীর নুরাল পাগলার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর৷ অর্থাৎ, এ হিসেবে রাজবাড়ীর নুরাল পাগলার জন্ম ১৯৪০ সালের দিকে। অর্থাৎ, ঢাকার নূরা পাগলা বলে উল্লিখিত ব্যক্তি ও রাজবাড়ীর নুরাল পাগলার বয়স ও জন্মতারিখে বড় রকমের পার্থক্য দেখা যায়।

এছাড়াও, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবি ও গণমাধ্যমে প্রচারিত রাজবাড়ীর নুরাল পাগলার ছবির তুলনা করলে শারীরিক গড়ন, চুল ও মুখমণ্ডলের আকৃতিতে বৈসাদৃশ্য দেখা যায় যা থেকে বুঝা যায় দুইজন আলাদা ব্যক্তি।
উল্লেখ্য, ঢাকার নূরা পাগলাকে চেনা উপরোল্লিখিত লেখক, গবেষক ও শিক্ষক ‘সাহাদাত পারভেজ’ও তার ফেসবুক পোস্টটির মন্তব্য বিভাগে একজনের রিপ্লাইয়ে বলেন, তার মনে হচ্ছে ঢাকার নূরা পাগলা ও রাজবাড়ীর নুরাল পাগলা দুজন ভিন্ন ব্যক্তি।
এছাড়াও, ‘আশিকুর রহমান’ নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ঢাকার নূরা পাগলার বিষয়ে ২০২৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে প্রচারিত একটি পোস্ট পাওয়া যায়। নূরা পাগলার সাথে তার পরিবারের ভালো সম্পর্ক ছিল বলেও তিনি দাবি করেন। তার পোস্টে তিনি আরও বলেন, “২০০৭-৮ এর দিকে নুরা পাগলা এন্তেকাল করেন এন্তেকাল এর সময় ওনার বয়স ছিল ৯০-৯৫ বছর। ওনাকে ওনার কথা মতো ওনার বসত ঘরের ভিতরেই সমাধী করা হয়। কিন্তু বিদেশে যে ছেলে দুজন ছিলো তারা দেশে এসে ঘর থেকে তুলে কবরস্থানে নিয়ে আবার মাটি দেয়। একে একে ৬ মাস পর পর তাকে ৭ বার কবর থেকে তোলা হয়েছিলো। কিন্তু তার দেহ পুরো অক্ষত ছিলো। পরে তাকে আবার তার ঘরের ভিতর ই সমাধী করা হয়। ও পরে মাজার শরীফ করা হয়। ওনার মাজার শরীফ বর্তমান এ ঢাকা রামপুরা টিভি সেন্টারের পিছনে অবস্থীত। সেখানে তার বিসাল বাউন্ডারি করা বাড়ি ও মাজার শরীফ রয়েছে। প্রতি বছর ওখানে ওনার নামে ওরশ শরীফ হয় ও বৈশাখ মাসে একটি বাৎসরিক ওরশ শরীফ করেন। নুরা পাগলা মারা জাওয়ার আগে ওনার মেজো ছেলে খাজা নিজাম উদ্দিন ওরফে (খাজা পাগলা) কে ওনার গদিতে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। ওনার পরে ওনার ছেলে বহু বছর ওনার গদি চালিয়েছেন। ২০২০ সালে নুরা পাগলার মেজো ছেলে খাজা নিজাম উদ্দিন ওরফে (খাজা পাগলা) ও মারা জান।”
‘আশিকুর রহমান’ এর পোস্টে উল্লিখিত নূরা পাগলার বয়স অনুসারে নূরা পাগলার জন্ম ১৯১২-১৭ সালে যা বিচিত্রা সংবাদপত্রে উল্লিখিত বয়সের পরিসরের বা রেঞ্জের কাছাকাছি থাকলেও রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের নুরাল পাগলার জন্মসালের চাইতে বেশ আগে বলে প্রতীয়মান হয়।
এছাড়াও, উপরোল্লিখিত তথ্যপ্রমাণ থেকে এ স্পষ্ট যে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবির ব্যক্তি ও রাজবাড়ীর নুরাল পাগলার শরীরের গড়ন, আকৃতি, অবস্থান, ও বয়সের পার্থক্য রয়েছে যা প্রমাণ করে দুজন প্রকৃতপক্ষে আলাদা ব্যক্তি।
সুতরাং, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের নুরাল পাগলার ছবি দাবিতে ঢাকার নূরা পাগলা নামে ভিন্ন এক ব্যক্তির ছবি প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Cameralabs – Факир, Дакка, Бангладеш (1974–1975), фотограф Эд ван дер Элскен
- Anwar Parvez Halim – Facebook Post
- Shahadat Parvez – Facebook Post
- Dhaka Post – নুরাল পাগলার দরবারে হামলার ঘটনায় আদালতে ৮ জনের স্বীকারোক্তি
- Jugantor – কে এই নুরু পাগলা? | Nurul Pagla | Rajbari | Jugantor
- ATN Bangla – কে এই নুরা পাগলা, পরিচয়ে মিলল ভয়াবহ তথ্য
- আশিকুর রহমান – Facebook Post