গত ২৯ আগস্ট জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের সংঘর্ষ এবং পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার পর, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের নিজ দলের কার্যালয়ের সামনে সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতির সময় গণঅধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীদের ওপর যৌথবাহিনীর লাঠিচার্জের ঘটনা ঘটে। এসময় নুরুল হক নুরসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। ঘটনার পর লাল বা মেরুন রঙের টি-শার্ট পরিহিত এক ব্যক্তির সিঁড়িতে বসে থাকা একজনকে মারধরের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিওটি নুরুল হক নুরকে মারার দৃশ্য হিসেবে ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়।

ভিডিওতে মারধরের শিকার ব্যক্তি নুরুল হক নুর উল্লেখ করে সংবাদ প্রচার করেছে যুগান্তর, এটিএন বাংলা (ইউটিউব), দেশ রূপান্তর, কালবেলা (ইউটিউব) দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস এবং বার্তা২৪।

গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান আল মামুনও একই দাবি করেছেন।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন দাবির পোস্ট এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
এক্সে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভাইরাল ভিডিওতে লাল বা মেরুন রঙের টি-শার্ট পরিহিত ব্যক্তি যাকে পেটাচ্ছিলেন তিনি নুরুল হক নুর নন। টি-শার্ট পরিহিত ওই ব্যক্তির হাতে মারধরের শিকার ব্যক্তি ছিলেন ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা আখতারুজ্জামান সম্রাট। এছাড়া, টি-শার্ট পরিহিত ওই ব্যক্তি পুলিশের সদস্য বলেও জানা গেছে।
বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে, নুরুল হক নুরের নিজ দলীয় কার্যালয়ের সামনে সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতির শুরু থেকে যৌথবাহিনীর হামলায় আহত হয়ে তার লুটিয়ে পড়ে হাসপাতালে যাওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন লাইভ ও ভিডিও ফুটেজ (১, ২, ৩, ৪) বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, সিঁড়িতে বসা অবস্থায় লাল বা মেরুন রঙের টি-শার্ট পরিহিত ব্যক্তির হাতে মারধরের শিকার হওয়া ব্যক্তি নুরুল হক নুর নন। ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, যৌথবাহিনীর অতর্কিত লাঠিচার্জে আহত হয়ে নুরুল হক নুর রাস্তাতেই লুটিয়ে পড়েন। তাৎক্ষণিকভাবে তার দলের বিভিন্ন নেতাকর্মী তার কাছে ছুটে আসেন এবং তাকে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর রিকশায় তুলে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতি থেকে হামলায় গুরুতর আহত হয়ে নুরুল হক নুরের লুটিয়ে পড়ার কোনো মুহূর্তেই তাকে সিঁড়িতে বসা অবস্থায় দেখা যায়নি।
সিঁড়িতে বসে থাকা ব্যক্তিকে লাল বা মেরুন টি-শার্ট পরিহিত এক ব্যক্তির মারধরের ৮ সেকেন্ডের ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। ভিডিওটি খুবই অস্পষ্ট এবং ঘোলা হওয়ায় ওই ফুটেজ থেকে কাকে মারা হচ্ছে তা স্পষ্ট বোঝা যায় না। পরবর্তীতে একই স্থানে ওই ব্যক্তিকে মারধরের বিভিন্ন কোণের আরও একাধিক ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে ওই ব্যক্তির মুখ স্পষ্ট দেখা যায় এবং নিশ্চিত হওয়া যায় তিনি নুরুল হক নুর নন।
অনুসন্ধানে, M TV নামের একটি ফেসবুক পেজে একই ঘটনায় ভিন্ন কোণ থেকে ধারণকৃত একটি ভিডিও ফুটেজ খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওটির ক্যাপশনে মারধরের শিকার ব্যক্তিকে শরীয়তপুর-২ আসনের গনঅধিকার মনোনীত প্রার্থী আক্তারুজ্জামান সম্রাট বলে উল্লেখ করা হয়। উক্ত তথ্যের সূত্র ধরে
আক্তারুজ্জামান সম্রাটের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের সন্ধান পায় রিউমর স্ক্যানার। উক্ত অ্যাকাউন্টের বায়োতে ব্যক্তির পরিচয় হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক বলে উল্লেখ রয়েছে। পরবর্তীতে উক্ত ফেসবুক অ্যাকাউন্টটির একাধিক পোস্ট পর্যবেক্ষণ করে M TV নামক ফেসবুক পেজে প্রচারিত ভিডিওটি ছাড়াও একই ঘটনায় ভিন্ন কোণ থেকে ধারণকৃত আরেকটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওর ক্যাপশনেও মারধরের শিকার ব্যক্তি সম্রাট বলে উল্লেখ করা হয়। যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যে, মারধরের শিকার এই ব্যক্তি ছাত্র অধিকার পরিষদ নেতা আক্তারুজ্জামান সম্রাট।
এদিকে লাল বা মেরুন টি-শার্ট পরিহিত ওই ব্যক্তির পরিচয় নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রশ্ন জাগে। পরিচয় অজ্ঞাত থাকায় বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার দেখা যায় এবং বিভিন্ন ব্যক্তিকে ওই ব্যক্তি হিসেবে প্রচার করা হয়।
রিউমর স্ক্যানার টিম ওই ব্যক্তির পরিচয় জানার চেষ্টা শুরু করে। প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ওই ব্যক্তি পুলিশের কেউ কিনা তা যাচাই করার চেষ্টা করা হয়। আখতারুজ্জামান সম্রাটকে পেটানোর স্থানের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ওই ব্যক্তি এবং একজন পুলিশ মিলে সম্রাটকে বেধড়ক মারধর করছেন। কিছুক্ষণ পর আরেকজন পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারীকে নিরাপদে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে ভিডিওতে দেখা যায়, লাল বা মেরুন টি-শার্ট পরিহিত ওই ব্যক্তি পেছন থেকে ওই নারীকে মারার চেষ্টা করেন। এতে উপস্থিত সেনাসদস্য ও পুলিশ সদস্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে জেরা করেন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি নিজেকে পুলিশ সদস্য দাবি করে পরিচয় দেন এবং পরে তাকে পাশে সরিয়ে নেওয়া হয়।
সংঘর্ষের ঘটনার বিভিন্ন ভিডিও বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, ওই ব্যক্তি পুলিশের সাথে অভিযানে সক্রিয় ছিলেন। এনটিভির লাইভ ফুটেজে তাকে ‘পুলিশ’ লেখা হেলমেট পরে থাকতে দেখা যায়। আরেক ভিডিওতে দেখা যায় তিনি আরেক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে মিলে অন্য একজনকে মারধর করছেন। এসব ফুটেজ বিশ্লেষণে ওই ব্যক্তি সিভিল ড্রেসে থাকা পুলিশ সদস্যই হতে পারেন বলে প্রতীয়মান হয়।
৩০ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম টি-শার্ট পরিহিত ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন, ‘এটা তদন্ত করা হবে। আমি যতটুকু জানি উনি হচ্ছেন একজন পুলিশ কনস্টেবল, উনি ডিউটিতেই ছিলেন। বাকিটা আপনারা ডিএমপির কাছ থেকে জানতে পারবেন।’
মূলধারার গণমাধ্যম সমকাল নিশ্চিত করেছে, টি-শার্ট পরিহিত ওই ব্যক্তি রাজধানীর পল্টন থানার পুলিশ কনস্টেবল মিজানুর রহমান। তিনি ওই থানার ওসির গাড়িচালক।
উল্লিখিত তথ্যপ্রমাণ থেকে এটি বলা যায় যে, লাল বা মেরুন টি-শার্ট পরিহিত ওই ব্যক্তি একজন পুলিশ সদস্য এবং ভাইরাল ভিডিওতে তিনি যাকে মারধর করেছেন তিনি হলেন ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা আখতারুজ্জামান সম্রাট।
সুতরাং, প্রচারিত ভিডিওতে লাল বা মেরুন টি-শার্ট পরিহিত যুবকের হামলার শিকার হওয়া ব্যক্তি নুরুল হক নুর শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Facebook Post- M TV
- Facebook Post- Dainik Destiny
- Facebook Post- NTV
- Facebook Post- Dhaka Tribune
- Facebook Account- ইঞ্জি আখতারুজ্জামান সম্রাট মাঝি
- Samakal- লাল টি–শার্ট পরা সেই ব্যক্তি সম্পর্কে যা জানা গেল
- Live videos of the incident