পঞ্চমের ইংরেজি বই: এনসিটিবির সাইটের সাথে স্কুলের বইয়ের ছবিতে গরমিল

বাংলাদেশে ২০২৩ এবং চলতি বছর (২০২৪) প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের একাধিক শ্রেণিতে (প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম) নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বা পাঠ্যক্রম চালু করেছে সরকার। ২০২৫ সালে পঞ্চম শ্রেণিতেও এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। শিক্ষা কারিকুলামে পরিবর্তন আসার ফলে সাধারণত সংশ্লিষ্ট শ্রেণির বইগুলোতেও পরিবর্তন আসে। পঞ্চম শ্রেণিতে এ বছর যেহেতু শিক্ষা কারিকুলাম বাস্তবায়ন হয়নি, তাই স্বাভাবিকভাবেই এই শ্রেণির বইতেও পরিবর্তন আসার কথা নয়। কিন্তু এই শ্রেণির ‘ইংরেজি বইয়ে পরিবর্তন এসেছে’ বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগ ছড়িয়ে পড়া লক্ষ্য করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।  

গত ২৪ জানুয়ারি কতিপয় ফেসবুক পোস্টে (, ) প্রাথমিকের পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের একাধিক ছবি পোস্ট করা হয়।   

পোস্টগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ইংরেজি বইয়ের তিনটা পৃষ্ঠার ছবি দুইটি বই থেকে তুলে পোস্টগুলোতে যুক্ত করা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, একটি বইয়ের শিশুদের মধ্যে ছেলেদের পরনে টি-শার্ট ও প্যান্ট এবং মেয়েদের পরনে ফ্রক রয়েছে। তবে অন্য বইয়ের একই পৃষ্ঠায় একই ছেলের পরনে পাঞ্জাবি ও টুপি এবং মেয়েদের পরনে হিজাব রয়েছে। একইভাবে বাকি দুই পৃষ্ঠার ছবিগুলোতেও পোশাক সম্পর্কিত সমজাতীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। 

পোস্টের ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, “৫ম শ্রেণির বইয়ের টেক্সটে কোনো পরিবর্তন না আনলেও ইংরেজি বইয়ের কিছু ছবিতে এই সুন্দর পরিবর্তনটা চোখে পড়লো।”

ইংরেজি
Screenshot: Facebook 

কিন্তু বইগুলো কোন সালের সংস্করণ তা এই পোস্টগুলো থেকে স্পষ্ট হওয়া যায়নি। 

পরদিন (২৫ জানুয়ারি) আরো কিছু পোস্ট (, ) ফেসবুকে এসেছে, যাতে একই পৃষ্ঠার ছবি যুক্ত থাকতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। এসব পোস্টের ক্যাপশনে এই ছবিগুলোর বিষয়ে আরো স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়েছে।

ক্যাপশন থেকে জানা যাচ্ছে, বইয়ের ছবি দুইটির একটি এক বছর আগের অর্থাৎ ২০২৩ সালের পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যবইয়ের। অন্য ছবিটি চলতি (২০২৪) বছরের একই শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের। 

দাবি করা হচ্ছে, চলতি বছরের বইয়ের লেখায় কোনো পরিবর্তন না হলেও বিবর্তন হয়েছে বইয়ের ছবিতে, বিশেষ করে হিজাব আর টুপিতে। টি-শার্ট পরা ছেলে দুই’টাকে পাঞ্জাবি পরানো হয়েছে, মাথায় টুপি দেয়া হয়েছে। ফ্রক পরা মেয়ে দুইটাকে ফুলহাতা কাপড় পরানো হয়েছে। 

Screenshot: Facebook 

এ সংক্রান্ত পোস্টগুলোতে উল্লিখিত তথ্যগুলো সঠিক নয় দাবি করে ২৬ জানুয়ারি আরো কিছু পোস্ট নজরে এসেছে আমাদের। 

এনায়েত উল্লাহ নামে এক ব্যক্তি তার পোস্টে বলছেন, “৫ম শ্রেনীর ইংরেজি বই নিয়ে একটা ভুল বুঝাবুঝি চলছে। অনেকেই এই বইয়ের একই লেখায় দুই ধরনের ইলাস্ট্রেশন দেখিয়ে একটা ২০২৩ সালের আরেকটি ২০২৪ সালের বলে দাবী করছেন। সরকার কিভাবে মৌলবাদীদের চাপে বাচ্চাদের গতবছরের ছবিতে হিজাব টুপি পরিয়ে দিয়েছে বলে বিস্তর গালাগালি করছে।”

তার দাবি, “মূলত দুইটা ছবিই এই বছরের, ২০২৪ সালের শিক্ষাবর্ষের। যেই ছবিতে হিজাব টুপি নাই, সেটা জেনারেল লাইনের বাংলা এবং ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের জন্য। অন্য যেই বইতে হিজাব এবং টুপি পরা ছবি আছে, সেটি এবতাদিয়া মিডিয়ামের ছাত্রছাত্রীদের জন্য।”

Screenshot: Facebook 

অর্থাৎ, ফেসবুকে পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের দুইটি সংস্করণের ছবি নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা চলছে তার সারসংক্ষেপ এটাই যে, একদল বলছেন, গত বছরের বইয়ের সাথে চলতি বছরের বইয়ের ভেতরের কিছু ছবির মিল নেই। আরেক দল বলছেন, এই দাবিটি সঠিক নয়। দুটোই এই বছরেরই বই, যার একটি প্রাথমিক স্তরের (যেখানে হিজাব, টুপি বা ঘোমটা নেই ছবিতে), অন্যটি ইবতেদায়ি স্তরের (যেখানে হিজাব, টুপি বা ঘোমটা আছে ছবিতে)।

রিউমর স্ক্যানার টিম পুরো বিষয়টি নিশ্চিত হতে অনুসন্ধান শুরু করে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর ওয়েবসাইটে প্রতি বছরই সে বছরের সকল শ্রেণির সকল মাধ্যমের বইগুলোর পিডিএফ সংস্করণ প্রকাশ করা হয়। চলতি বছরও (২০২৪) তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক স্তরের এ বছরের বইটির পিডিএফ সংস্করণ থেকে দেখা যাচ্ছে, বইতে শিশুদের পোশাকে কোনো পরিবর্তন নেই। ২০২৩ সালের প্রাথমিক স্তরের বইয়ের ছবির সাথে হুবহু মিল পাওয়া যাচ্ছে এই বইয়ের। 

Screenshot collage: Rumor Scanner

একইভাবে ২০২৪ সালের ইবতেদায়ি স্তরের পঞ্চম শ্রেণির বইয়ের পিডিএফ সংস্করণ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, সেখানে থাকা ছবিগুলোতে শিশুদের পোশাকে ইসলামিক চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছে। অর্থাৎ, ছেলেদের পাঞ্জাবি-টুপি এবং মেয়েদের হিজাব পরতে দেখা যাচ্ছে। ২০২৩ সালের একই স্তরের বইয়ের পিডিএফ সংস্করণেও একই ছবি পেয়েছি আমরা। 

Screenshot collage: Rumor Scanner

অর্থাৎ, এনসিটিবির ওয়েবসাইটের বইয়ের পিডিএফ সংস্করণ থেকে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, যারা “দুইটা ছবিই ২০২৪ সালের এবং যে ছবিতে হিজাব টুপি নাই, তা প্রাথমিক স্তরের এবং যে বইতে হিজাব এবং টুপি পরা ছবি আছে, সেটি এবতেদায়ি স্তরের” বলে দাবি করছিলেন তাদের দাবিই সঠিক। 

কিন্তু এই অনুসন্ধান আমরা এখানেই শেষ করিনি। রিউমর স্ক্যানার টিম সরেজমিনে দেশের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে চলতি বছরের প্রাথমিক স্তরের পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি বই সংগ্রহ করেছে। 

Screenshot collage: Rumor Scanner

২০২৪ সালে বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের কাছে বিতরণের জন্য ছাপাকৃত এই বইয়ের ১০ (৩য় ইউনিট), ১৩ (৩য় ইউনিট), ১৪ (৪র্থ ইউনিট) এবং ১৬ (৪র্থ ইউনিট) নং পৃষ্ঠায় থাকা ছবিগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এনসিটিবির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ২০২৩ এবং ২০২৪ সালের বইয়ের একই পৃষ্ঠার ছবিগুলোর সাথে উক্ত পৃষ্ঠার ছবিগুলোর মিল নেই। ছবিগুলোতে মেয়েদের হিজাব, নারীদের ঘোমটা, ছেলেদের পাঞ্জাবি-টুপি পরিহিত দেখা যায়। 

Screenshot collage: Rumor Scanner 

এই বইতে ছাপাজনিত ত্রুটির কারণে ছবি পরিবর্তন হয়ে থাকতে পারে এই আশঙ্কায় রিউমর স্ক্যানার টিম দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বইয়ের সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠাগুলোর ছবি সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়। আমরা চাঁদপুর, যশোর, কুমিল্লা, ঢাকা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের একাধিক স্কুলের শিক্ষক এবং অভিভাবকদের কাছ থেকে বইটির ছবি সংগ্রহ করে একই ফলাফল অর্থাৎ ছবিগুলোতে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। 

প্রাথমিক স্তরের স্কুলগুলোতে এই পরিবর্তন দেখা গেলেও ইবতেদায়ি স্তরের বইয়ে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আমরা ভোলার একটি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা থেকে ইংরেজি বই সংগ্রহ করে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে থাকা বইয়ের ছবির সাথে অমিল পাইনি। 

অর্থাৎ, এনসিটিবি ২০২৪ সালের দাবিতে প্রাথমিক স্তরের ইংরেজির যে বইটি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে তার চারটি পৃষ্ঠার ছবির সাথে দেশের স্কুলগুলোতে বিতরণ করা বইয়ের উক্ত চার পৃষ্ঠার ছবির মিল নেই। 

পঞ্চম শ্রেণিতে এ বছর নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বাস্তবায়ন না হলেও কেন এই শ্রেণির বইতে পরিবর্তন – এমন প্রশ্ন রেখেছিলাম এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলামের কাছে। তার কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না পেয়ে প্রতিষ্ঠানটির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) প্রফেসর মোঃ মোখলেস উর রহমানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম আমরা। জনাব মোখলেস রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, “স্যার (চেয়ারম্যান) আমাকে আপনার পাঠানো বিষয়টি দেখিয়েছেন। আমি যা ব্যাখ্যা দেওয়ার স্যারকে দিয়েছি। স্যারের বক্তব্যই আমার বক্তব্য।” আমরা পরবর্তীতে একাধিকবার এনসিটিবির চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। কিন্তু তার পক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। 

সুতরাং, পঞ্চম শ্রেণিতে এ বছর নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বাস্তবায়ন না হলেও বিতরণ করা প্রাথমিক স্তরের ইংরেজি বইয়ের চারটি পৃষ্ঠায় থাকা ছবিতে পরিবর্তন হয়েছে। তবে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বইয়ের ছবিতে এই পরিবর্তন নেই। ওয়েবসাইটের সাথে মাঠ পর্যায়ের বইয়ের এই গরমিলের কারণ নিয়ে এনসিটিবি কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তথ্যসূত্র 

আরও পড়ুন

spot_img