অন্তত গত ২৯ আগস্ট সন্ধ্যা থেকে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার হচ্ছে যাতে পুলিশের পোশাক পরা কিছু ব্যক্তিকে নিথর কিছু দেহ ভ্যান গাড়িতে তুলতে দেখা যাচ্ছে। ঘটনাটি কোন স্থানের এবং কত তারিখের তা রিউমর স্ক্যানারের কাছে জানতে চেয়েছিলেন গণমাধ্যম কর্মীসহ অনেকেই। আমরা তাই ভিডিওটির বিষয়ে পরদিন ৩০ আগস্ট সন্ধ্যায় অনুসন্ধান শুরু করি।
ওপেন সোর্সে ভিডিওটির সবচেয়ে পুরোনো আপলোড পাওয়া যায় ২৯ আগস্ট সন্ধ্যার কিছু পরে। দেড় মিনিটের এই ভিডিওটি কে ধারণ করেছেন তা সেদিন ভিডিওটি প্রকাশকারী একাধিক ফেসবুক ব্যবহারকারীর সাথে কথা বলেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রত্যেকেই আমাদের জানাচ্ছিলেন, তাদেরকে মেসেঞ্জারে ভিডিওটি দেওয়া হয়েছে। সেই সূত্রে ভিডিওটি প্রকাশ করেছেন তারা। ভিডিও ধারণকারীকে পাওয়া গেলে সহজেই মূল ভিডিও ফাইল সংগ্রহ করে মেটাডাটা বা ফরেনসিক বিশ্লেষণ করে ভিডিও ধারণের তারিখসহ সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো জানা সম্ভব ছিল। এই পথে সমাধান না আসায় ভিডিওটি বিশ্লেষণের পথে আগায় রিউমর স্ক্যানার। এ সংক্রান্ত ভাইরাল বেশ কিছু পোস্টের কমেন্টে কেউ কেউ দাবি করেন, স্থানটি যাত্রাবাড়ী, কেউ দাবি করেন এটি সাভার বা আশুলিয়ার হতে পারে৷ এই স্থানগুলোর বিষয়ে মন্তব্য আসার যৌক্তিক কারণও ছিল। কারণ এসব স্থানে জুলাই এবং আগস্টের বিভিন্ন সময়ে দফায় দফায় সংঘর্ষের খবর এসেছে গণমাধ্যমে। প্রাথমিকভাবে এসব এলাকার থানা এবং সংঘর্ষস্থলগুলো গুগল ম্যাপের মাধ্যমে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেও আলোচিত ভিডিওটির সাথে মিল পাওয়া যায়নি৷ ভিডিওতে একটি অস্পষ্ট পোস্টারের ছবিও দেখা যাচ্ছিল।
এটির বিষয়ে সন্দেহভাজন এলাকাগুলোর রাজনৈতিক পোস্টারগুলো ওপেন সোর্সে বিভিন্ন কিওয়ার্ডে অনুসন্ধান করেও আলোচিত পোস্টারটির সাথে মিল পাওয়া যায়নি। সেদিন রাত ৯ টার পর রিউমর স্ক্যানারের অফিশিয়াল ফেসবুক গ্রুপে এ বিষয়ে একটি পোস্টের মাধ্যমে ভিডিওটির বিষয়ে কোনো সুনিশ্চিত বা সম্ভাব্য কোনো তথ্য জানা থাকলে আমাদের জানানোর আহ্বান জানানো হয়। রিউমর স্ক্যানারের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেশ কয়েকজন জানান, সাভারের বাইপাইলের আশুলিয়া থানার পাশের দৃশ্য এটি৷ তাদের দাবি, ঘটনাটি ০৫ আগস্টের, শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগ পরবর্তী সময়ের। একই সময়ে সাভারের স্থানীয় সাংবাদিক সাকিব আসলামও জানান যে ঘটনাটি আশুলিয়ার।
এই তথ্যের সূত্রে আশুলিয়া এলাকার রাজনৈতিক পোস্টারগুলোর বিষয়ে ফের অনুসন্ধান শুরু করে রিউমর স্ক্যানার। এক পর্যায়ে পোস্টারটির ব্যক্তির ছবির সাথে স্থানীয় এক ব্যক্তির পোস্টারের মিল পাওয়া যায়। ফেসবুক থেকে পাওয়া এসব পোস্টারে উক্ত ব্যক্তির পরিচয় দেওয়া হয়েছে, আশুলিয়ার ধামসোনা ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার পদপ্রার্থী আবুল হোসেন ভূঁইয়া।
কাছাকাছি সময়ে সাংবাদিক সাকিব আসলামও আশুলিয়া এলাকা থেকে ধারণ করা আলোচিত পোস্টারের আরেকটি ছবি তার এক পোস্টে যুক্ত করেন। যদিও তিনি তা পরে সরিয়ে নেন। তবে রিউমর স্ক্যানার ছবিটি সংরক্ষণ করে সেদিন রাত ১০ টা ৪৭ মিনিটে।
তবে বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে আরো ঘণ্টাখানেক সময় নেওয়া হয়৷ স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করে স্থানটির সুনির্দিষ্ট ঠিকানার বিষয়ে আরো তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করা হয়। স্থানীয় এক ব্যক্তি পোস্টার লাগানো দেয়ালটি তার বাসার বাউন্ডারি দেওয়াল দাবি করে রিউমর স্ক্যানারকে গুগল ম্যাপে স্থানটি চিহ্নিত করে দেন। তবে ম্যাপের ওই অংশটি সর্বশেষ ২০২১ সালে হালনাগাদ হওয়ায় স্থানটির বর্তমান অবস্থার সাথে পুরোপুরি মিল পাওয়া যায়নি। উক্ত ব্যক্তি আমাদের জানান, যে দেয়ালে পোস্টারটি দেখা যাচ্ছে, দেয়ালটিতে আগে প্লাস্টার করা ছিল না। পরে করা হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরে সেদিন (৩১ আগস্ট) রাত ১২ টা ২ মিনিটে রিউমর স্ক্যানারের অফিশিয়াল ফেসবুক গ্রুপে পোস্টের মাধ্যমে বিষয়টি জানানো হয়। একইসাথে গণমাধ্যম কর্মী যারা বিষয়টি জানতে চেয়েছিলেন তাদেরকেও প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণসহ বিষয়টি অবহিত করা হয়।
এ নিয়ে চ্যানেল২৪ প্রথম সংবাদ প্রকাশ করে ৩১ আগস্ট সকাল সাড়ে আটটার পর। গণমাধ্যমটি জানায়, “সম্প্রতি ভ্যানে নিথর দেহের স্তূপের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটি ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে নিহত কয়েকজন ব্যক্তির। যাদের নাম পরিচয় এখনও জানা যায়নি। তবে ভিডিওটি ভাইরাল হবার পর ঘটনাটি কোথায় ঘটেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। পরে ফ্যাক্ট চেক প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার জানায়, ভ্যানে নিথর দেহের স্তূপের ঘটনাটি আশুলিয়া থানা সংলগ্ন এলাকার। শুক্রবার (৩০ আগস্ট) রাতে প্রতিষ্ঠানটি বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।”
চ্যানেল২৪ লিখেছে, “রিউমর স্ক্যানার জানায়, নিথর দেহের স্তূপের বহুল আলোচিত ভিডিওটি আশুলিয়া থানা সংলগ্ন এলাকার ঘটনা। ৫ আগস্ট বিকেলে এই ঘটনা ঘটে। এছাড়া ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকেন এমন দুইজন দাবি করেন, ভিডিওর দেয়ালে যার পোস্টার দেখা যায় তিনি আশুলিয়ার ধামসোনা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার পদপ্রার্থী আবুল হোসেন ভূঁইয়া।”
পরবর্তীতে অন্যান্য গণমাধ্যমেও (ইনডিপেনডেন্ট টিভি, আরটিভি, কালের কণ্ঠ, ভোরের কাগজ, দৈনিক আমাদের সময়, জনকণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, মানবকণ্ঠ, বায়ান্ন টিভি, গ্লোবাল টিভি, সংবাদ প্রকাশ ইত্যাদি) একই সংবাদ এসেছে।
৩১ আগস্ট স্থানীয় একাধিক সাংবাদিক ঘটনাস্থলে গিয়ে বিস্তারিত বিষয় জানিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেন৷ বাংলানিউজ২৪ জানায়, ভিডিওটি আশুলিয়া থানার সামনের ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে ধারণ করা বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, আশুলিয়া প্রেসক্লাবের পেছনের সড়ক দিয়ে থানা রোড অতিক্রম করে এসবি অফিসের দিকে যাওয়ার সময় ডান পাশের দেয়ালটি হুবহু ভিডিওর সাথে মিলে যায়। ওখানে এখনও সেই পোস্টারটি দেয়ালে রয়েছে। মহাসড়ক থেকে থানার দিকে অগ্রসর হয়ে এসবি অফিসের দিকে চৌরাস্তায় এই ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এনটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে নির্বিচার গুলিতে গণহত্যার পর ভ্যানে তোলা কয়েকটি মরদেহের স্তূপের পাশে পুলিশকে হাঁটাহাঁটি করতেও দেখা গেছে। তাদের একজনকে ইতোমধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে। তিনি ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক (তদন্ত) আরাফাত হোসেন। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরে আত্মগোপনে চলে গেছেন তিনিসহ ভিডিওচিত্রে থাকা পুলিশের সদস্যরা। আরাফাতের গ্ৰামের বাড়ি বরিশালে। প্রায় দুই বছর আগে তিনি ঢাকা জেলার গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দেন।
মানবজমিনের সরেজমিন প্রতিবেদনে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা উঠে এসেছে। ৫ আগস্টের কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী মানবজমিনের কাছে দাবি করেন, গত ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পরপর বাইপাইল এলাকার বিজয় মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে বিকেলে উত্তেজিত জনতা আশুলিয়া থানা ঘেরাও করেন। এতে পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। থানার আশপাশে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে থানা ভবনে ঢুকে পড়েন। ঢুকেই তারা থানার গেইট বন্ধ করে দেন। তখন বিকেল সাড়ে ৪টার বাজে। মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে আন্দোলনকারীরা চারদিক থেকে থানা ঘিরে ফেলেন। তারা থানা ভবনে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। কেউ কেউ গেইট ভাঙতে এগিয়ে যান। অবস্থা বেগতিক দেখে আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ এ এফ এম সায়েদ আহমেদ পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র রেডি করতে বলেন। গুলি লোড করতে বলেন। এই কথা শুনে উপস্থিতরা আরও চড়াও হন। আশপাশে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় থানা ভবন থেকে বেরিয়ে এসে ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ সদস্য থানার গেইটে অবস্থান নেন। বিকেল ৪টা বেজে ৪০ মিনিট। ওসি সায়েদ আহমেদ গেইটে এসে উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। তখন আন্দোলনকারীরা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে ওসি পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র হাতে নিয়ে রেডি হতে বলেন। তখন ঘটনাস্থলে থাকা জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রজনতা পুলিশকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তখন ওসি সায়েদ আহমেদ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বলেন, আমরা হেরেছি। আপনারা জিতেছেন। আমাদের মাফ করে দেন। সবাই বাড়ি ফিরে যান। একপর্যায়ে এসআই মালেক, ডিবির ওসি তদন্ত আরাফাত, এসআই আফজালুল, এসআই জলিল ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়েন। গুলিতে থানার গলিতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে যান। মুহুর্মুহু গুলিতে লোকজন দৌড়ে পালিয়ে যান।
সেদিন পরবর্তীতে সেনাবাহিনী এসব পুলিশ সদস্যদের নিরস্ত্র করে আটক করে সেনানিবাসে নিয়ে যায় বলেও দাবি গণমাধ্যমটির।
এদিকে এই ঘটনা তদন্তে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈদ।