২০১৯ সালে চীন থেকে যখন কোভিড মহামারি ছড়াতে শুরু করেছিল তখন কেউ কি ভাবতে পেরেছিল, মাত্র আড়াই বছরের ব্যবধানে ৬৪ লাখের বেশি মানুষকে হারিয়ে ফেলবো আমরা? মৃত্যুর এই মিছিল এখনও চলছে। সময়ে সময়ে এখনও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস। কোভিড মহামারি তার অন্তিমদশা দেখানোর আগেই সাম্প্রতিক সময়ে আরেকটি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার খবর এসেছে সংবাদমাধ্যমে। মাঙ্কিপক্স নামের এই ভাইরাস নিয়ে এখনই সতর্ক হতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
মাঙ্কিপক্স কী?
মাঙ্কিপক্সকে এমন একটি বিরল রোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে যা মাঙ্কিপক্স ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে ভাইরাল জোনোসিস নামে অভিহিত করেছে৷ এর মানে এটি এমন এক ভাইরাস যা প্রাণী থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা Centers for Disease Control and Prevention (CDC) বলছে, “১৯৫৮ সালে গবেষণার জন্য রাখা বানরের উপনিবেশগুলোতে পক্স-সদৃশ রোগের দুটি প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। সে সময় এই রোগকে “মাঙ্কিপক্স” নাম দেওয়া হলেও রোগের উৎস অজানা থেকে যায়।”
তবে এখন ইদুরকেই এই ভাইরাস বিস্তারের প্রধান পোষক বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
সিডিসি বলছে, এই ভাইরাস আফ্রিকান ইঁদুর এবং অ-মানব প্রাইমেটে (বানরের মতো) আশ্রয় নিয়ে মানুষে সংক্রমিত হতে পারে।
Screenshot Source: CDC
মানুষের মধ্যে প্রথম মাঙ্কিপক্স শনাক্তের খবর মেলে ১৯৭০ সালে, আফ্রিকার দেশ কঙ্গোতে। সে সময় ৯ মাস বয়সী এক ছেলেশিশু এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এমন এক এলাকায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছিল যেখানে এর বছর দুয়েক আগে (১৯৬৮) গুটিবসন্তের প্রাদুর্ভাব ছিল। এই গুটিবসন্তের সাথে মিলও ছিল মাঙ্কিপক্সের। এরপর থেকে কঙ্গোর বিভিন্ন অঞ্চলে এবং পরবর্তীতে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকায় এই ভাইরাস সংক্রমনের খবর পাওয়া গিয়েছিল। এরপর সময়ে সময়ে বিভিন্ন স্থানেই এই ভাইরাস সংক্রমণের খবর এসেছে বিশ্ব গণমাধ্যমে। সিডিসি বলছে, ২০০৩ সালে প্রথম আফ্রিকার বাইরে যুক্তরাষ্ট্রে এই ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মূলত এই ভাইরাসে আক্রান্ত পোষা প্রাইরি কুকুর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়েছিল।
Screenshot Source: CDC
এই প্রাদুর্ভাবের কারণে সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হয়েছিল ৭০ জনের বেশি মানুষ। ২০১৮ ও ২০১৯ সালেও নাইজেরিয়া, ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরে এই ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া গিয়েছে। গেল বছরের জুলাইতে এবং নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সংক্রমণ নতুন করে ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা এসেছে সংবাদমাধ্যমে।
কীভাবে ছড়ায় মাঙ্কিপক্স?
সিডিসির দেয়া তথ্যমতে, মাঙ্কিপক্স ছড়ানোর একাধিক উপায় রয়েছে। মানুষ থেকে মানুষে সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তির ফুসকড়ি, খোসা বা বডি ফ্লুইডের সরাসরি সংস্পর্শে এটি ছড়াতে পারে। এছাড়া ঘনিষ্ঠ শারীরিক যোগাযোগের সময় (যেমন চুম্বন, আলিঙ্গন বা যৌন মিলন) আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে এটি সংক্রমিত হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির ফুসকুড়ি, খোসা বা বডি ফ্লুইডের সংস্পর্শে ছিল এমন পোশাক থেকেও ভাইরাসটি সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। গর্ভবতীরা প্লাসেন্টার মাধ্যমে তাদের ভ্রূণে ভাইরাস ছড়াতে পারে। মানুষ ছাড়াও প্রাণীর সংস্পর্শেও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার জোর সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে সিডিসি। ফুসকুড়ি সম্পূর্ণরূপে নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত এবং ত্বকের একটি তাজা স্তর তৈরি না হওয়া পর্যন্ত লক্ষণগুলি শুরু হওয়ার সময় থেকে মাঙ্কিপক্স ছড়িয়ে পড়তে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বানর, ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, এমনকি মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগীর ব্যবহৃত বিছানাপত্র থেকেও এই ভাইরাস অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে।
বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) মাঙ্কিপক্স বিষয়ক এক নির্দেশনায় বলেছে, প্রাণীদের মধ্যে ইদুর, কাঠবিড়ালি, খরগোশ এবং বানর থেকে ছড়াতে পারে এই ভাইরাস। তবে এখন পর্যন্ত গৃহপালিত প্রাণি থেকে ভাইরাসটির সংক্রমণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি।

মাঙ্কিপক্সে আক্রান্তের লক্ষণ কী কী?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মাঙ্কিপক্স আক্রান্তদের প্রাথমিক পর্যায়ের উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, গাঁট ও মাংসপেশিতে ব্যথা, লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং দেহে অবসাদের মতো লক্ষণ। আইইডিসিআর বলছে, উপসর্গ হিসেবে জ্বরের মাত্রা ৩৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা ১০০.৪ ফারেনহাইট হতে পারে।
জ্বর শুরু হওয়ার দিন তিনেকের মধ্যে দেহে গুটি বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়। এসব গুটির দেখা মেলে মুখ, হাতের তালু, পায়ের তলা, গলা, কুঁচকি, যৌনাঙ্গ এমনকি পায়ু অঞ্চলেও। সংক্রমণের মাত্রাভেদে ক্ষতের সংখ্যা এক থেকে কয়েক হাজারও হতে পারে। এই গুটির জন্য রোগীর দেহে খুব চুলকানি হয়। পরে গুটি থেকে ক্ষত দেখা দেয়।
Screenshot Source: WHO
গুটিগুলো শুরুতে শুকনো থাকলেও পরবর্তীতে ফ্লুইড বা ফুঁজ দিয়ে ভরে যায়। লক্ষণগুলো দুই থেকে তিন সপ্তাহ স্থায়ী হয়।
সিডিসি জানিয়েছে, মাঙ্কিপক্সের উপসর্গ গুটিবসন্তের উপসর্গের মতোই, তবে হালকা এবং মাঙ্কিপক্স খুব কমই মারাত্মক। মাঙ্কিপক্স চিকেনপক্সের সাথে সম্পর্কিত নয়।
মাঙ্কিপক্স আক্রান্ত হলে সেরে উঠার উপায় কী?
মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগীদের জন্য আলাদা কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে, উপসর্গ বা লক্ষণগুলো সাধারণত কোনো ধরনের চিকিৎসা ছাড়াই সমাধান হয়ে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে জ্বর বা ব্যথার ওষুধ খেয়েও রোগী উপকার পেতে পারে। গুটি বসন্তের টিকা এবং ভাইরাস প্রতিরোধী ওষুধ মাঙ্কিপক্সের উপসর্গ রোধে সাহায্য করতে পারে।
European Medicines Agency (EMA) এ বছরের জানুয়ারিতে একটি অ্যান্টিভাইরাল অনুমোদন দিয়েছে। এটি মূলত গুটিবসন্তের (টেকোভিরিমাট) চিকিত্সার জন্য তৈরি করা হলেও মাঙ্কিপক্সের চিকিত্সার জন্যও এটি কার্যকর বলছে সংস্থাটি। মাঙ্কিপক্সের কারণে প্রচন্ড জ্বর এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল তাদের ক্ষেত্রে টেকোভিরিমাট ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে সিডিসি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আক্রান্ত ব্যক্তির কোনোভাবেই গুটিগুলোতে চুলকানো যাবে না। ক্ষত স্পর্শ করার পূর্বে এবং পরে অবশ্যই হাত ধুয়ে নিতে হবে। গুটিগুলো শুকনো রাখতে হবে এবং ঢেকে রাখা যাবে না। (তবে আক্রান্ত ব্যক্তি ও সুস্থ ব্যক্তি একই কক্ষে থাকলে ঢেকে রাখতে হবে) এন্টিসেপটিক দিয়ে গুটিগুলো পরিস্কার রাখা যেতে পারে। মুখের ভেতর যদি গুটি হয় সেক্ষেত্রে লবণ পানি দিয়ে গড়গড়া করতে হবে। বেকিং সোডা দিয়ে গরম পানিতে গোসল করতে হবে।
সংস্থাটি পরামর্শ দিয়েছে, যারাই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন তারা যেন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করেন, সুষম খাবার খান এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান। যারাই আইসোলেশনে থাকবেন তাদের ক্ষেত্রে মানসিক সুস্থতা জরুরি।

বাসায় যদি কেউ মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে তার জন্য আলাদা কক্ষ, টয়লেট, খাবার প্লেট, গ্লাস, বিছানা, গামছা এবং ইলেকট্রনিক সামগ্রীর ব্যবস্থা করতে হবে। ঘরের জানালা খোলা রাখার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
যদি আলাদা কক্ষে থাকা সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে রোগীকে সবসময় মাস্ক পরে থাকতে হবে। একজন আরেকজনকে স্পর্শ করা যাবে না।
মাঙ্কিপক্সের যে কঙ্গো ধরনটি অপেক্ষাকৃত ভয়ানক ধরা হয়, তাতে মৃত্যুর হার ১০ শতাংশ। আর পশ্চিম আফ্রিকা ধরনটিতে মৃত্যুর হার ১ শতাংশ। মৃত্যু হবেই এমন আশঙ্কা না থাকলেও আইইডিসিআর বলছে, কিছু শারীরিক জটিলতা যেমন, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, কিডনি সমস্যা, ক্যান্সার, এইডস, গর্ভবতী এবং নবজাতকের ক্ষেত্রে এই ভাইরাস মৃত্যু পর্যন্ত পরিণতি ঘটাতে পারে। এর বাইরে এই ভাইরাসে আক্রান্তদের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব হিসেবে ত্বকে দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, মানসিক বিভ্রান্তি এবং চোখে প্রদাহের মতো বেশ কিছু জটিলতার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে সংস্থাটি।
মাঙ্কিপক্সের কি কোনো ভ্যাকসিন আছে?
সিডিসি’র দেওয়া সর্বশেষ তথ্য (৩০ জুন,২০২২) বলছে, মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত JYNNEOS এবং ACAM2000 নামে দুইটি ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা Food and Drug Administration (FDA)। তবে সাম্প্রতিক মাঙ্কিপক্স ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাগুলোয় এই দুইটি ভ্যাকসিন কতটা কার্যকারী হচ্ছে সে ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য জানা যায় নি।

তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গুটিবসন্তের ভ্যাকসিনও মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে ৮৫ শতাংশ কার্যকর।
সাম্প্রতিক সময়ে মাঙ্কিপক্স
মাঙ্কিপক্সের বর্তমান প্রাদুর্ভাবটি ধরা পড়ে গত ৭ মে। সে সময় যুক্তরাজ্য থেকে এক ব্যক্তি নাইজেরিয়া গিয়ে আবার যুক্তরাজ্যে ফিরে আসলে তার শরীরে গুটি দেখা দেয়। তবে নাইজেরিয়া কর্তৃপক্ষ জানায়, আক্রান্ত এই রোগী নাইজেরিয়ায় গিয়ে মাঙ্কিপক্স আক্রান্ত রোগী বা গুটির মতো উপসর্গ আছে এমন কারো সংস্পর্শে ছিলেন না। ১৭ মে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও এই ভাইরাস শনাক্তের খবর আসে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত (২৯ জুলাই) বিশ্বের ৭৯টি দেশ থেকে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্তের খবর এসেছে। আক্রান্তের সংখ্যা ২২ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার মধ্যেই ৭ জন মৃত্যুর খবর এসেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে, এই ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে এমন প্রথম দশটি দেশের মধ্যে রয়েছে যথাক্রমে স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ব্রাজিল, কানাডা, পর্তুগাল এবং ইতালি।

বাংলাদেশের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতেও এই ভাইরাসে এখন পর্যন্ত চারজন আক্রান্তের খবর এসেছে। মাঙ্কিপক্স দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় গত ২৩ জুলাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভাইরাসের বিষয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে।

বাংলাদেশে কি মাঙ্কিপক্স ছড়াতে পারে?
গত ২৩ মে ফেসবুকে বাংলাদেশে প্রথম মাঙ্কিপক্স রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে একটি তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, যে ডাক্তারের বরাতে বিষয়টি প্রচার করা হয়েছে তিনি নিজেই বিষয়টি মিথ্যা বলে নিশ্চিত করেছেন। (এ সম্পর্কে রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদন পড়ুন এখানে) পরবর্তীতে গত মে মাসে মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের কারণে জুনমাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনা বিষয়ক তথ্য ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত কোনো রোগী শনাক্ত না হলেও সারাবিশ্বে মাঙ্কিপক্স ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে মে মাসের শেষদিকে দেশের সকল আন্তজার্তিক বিমানবন্দর এবং স্থলবন্দরসৃূহে বিশেষ সতর্কতা জারি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
প্রথম আলো পত্রিকায় গত ২৪ জুলাই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মাঙ্কিপক্সের ভীতি অপেক্ষাকৃত কম বলে অভিমত দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম। এর পেছনে তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেন তিনি। এগুলো হলো, বাংলাদেশের আগাম সতর্কতা, পুরুষ সমকামী গোষ্ঠীর কম সংখ্যা এবং ভারতে এ রোগের সংখ্যার কম উপস্থিতি।

মাঙ্কিপক্স কি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে?
New England Journal of Medicine এ গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক গবেষণার বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম NDTV জানিয়েছে, “মাঙ্কিপক্সে সংক্রামিত লোকদের ৯৮ শতাংশই সমকামী বা উভকামী পুরুষ এবং ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে যৌন কার্যকলাপের মাধ্যমে এই ভাইরাস সংক্রমণ হয়েছিল।” এমন পরিস্থিতিতে সমকামিতায় লাগাম টানার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বিবিসির বরাত দিয়ে Bdnews24 এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “এটা পরিষ্কার যে মাঙ্কিপক্স আরেকটি কোভিড নয়, আর ঘটনা এমন নয় যে এর বিস্তার রোধে আরেকটি লকডাউন ঘনিয়ে আসছে। তবে মাঙ্কিপক্সের এই প্রাদুর্ভাব অস্বাভাবিক এবং অপ্রত্যাশিত। বিশেষজ্ঞদেরও অবাক করেছে। আর যখন কোনো ভাইরাস আচরণ পরিবর্তন করে, তখন তা উদ্বেগের কারণ হয়েই দাঁড়ায়। “
মাঙ্কিপক্স একটি ডিএনএ ভাইরাস হওয়ায় এটি কোভিড বা ফ্লুর মতো এর দ্রুত রূপান্তর বা মিউটেশন হয় না জানিয়ে প্রতিবেদনে এই ব্যাপারটিকে বিশেষজ্ঞরা স্বস্তির কারণ হিসেবে দেখছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের চেয়ে মাঙ্কিপক্স ভয়াবহ হতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সৌম্য স্বামীনাথন ভারতীয় সংবাদমাধ্যম NDTV কে বলেছেন,” দুটি ভাইরাসের সরাসরি তুলনা করা যাবে না। কারণ, তথ্যের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও এটা পরিষ্কার যে মাঙ্কিপক্স একটি আলাদা ভাইরাস। আর এটা করোনার মতো একই গতিতে রূপান্তরিত হয় না।”

২৮ জুলাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান Tedros Adhanom Ghebreyesus বলেছেন, “মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব বন্ধ করা যেতে পারে যদি দেশ, সম্প্রদায় এবং ব্যক্তিরা নিজেদেরকে সচেতন করে ঝুঁকিগুলিকে গুরুত্ব সহকারে নেয় এবং সংক্রমণ বন্ধ করতে এবং দুর্বল গোষ্ঠীগুলিকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ কে লুৎফুল কবির জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো’র অনলাইন সংস্করণে লেখা একটি কলামে উল্লেখ করেন, “যদিও এটি গুটিবসন্তের চেয়ে কম মারাত্মক, তবুও এই রোগটি করোনার মতো মহামারি আকারে ছড়ানোর আগেই আতঙ্কিত না হয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। তাহলেই কেবল খুব সহজেই এই রোগটি মোকাবিলা করা সম্ভব বলে আশা করা যায়।”
মূলত, মাঙ্কিপক্স একটি ডিএনএ ভাইরাস হওয়ায় এটি দ্রুত রূপান্তর বা মিউটেশন হয় না বলে এর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন না বিশেষজ্ঞরা। এখন পর্যন্ত মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যার পরিসংখ্যানও এই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ারই আভাস দিচ্ছে। তবে যৌন কার্যকলাপসহ কিছু ব্যাপারে সতর্ক হলেই ভাইরাসটি রোধ করা সম্ভব বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সুতরাং, মাঙ্কিপক্স ভয়ংকর হয়ে উঠার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো আশঙ্কা নেই।
তথ্যসূত্র
- World Health Organization : Monkeypox
- Centers for Disease Control and Prevention : About Monkeypox
- Worldometers : COVID-19 CORONAVIRUS PANDEMIC
- Centers for Disease Control and Prevention : Past U.S. Cases and Outbreaks
- Centers for Disease Control and Prevention : How it Spreads
- বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম : মাঙ্কিপক্স: কতটা দুশ্চিন্তার?
- রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) : মাঙ্কিপক্স ভাইরাস সংক্রমন সংক্রান্ত প্রয়য়াজনীয় তথ্য
- World Health Organization: Monkeypox Questions and Answers
- Centers for Disease Control and Prevention : Monkeypox Symptoms
- European Medicines Agency (EMA) : Tecovirimat SIGA
- Centers for Disease Control and Prevention : Treatment
- World Health Organization : Recovering from monkeypox at home
- Centers for Disease Control and Prevention: Considerations for Monkeypox Vaccination
- World Health Organization: Monkeypox – United Kingdom of Great Britain and Northern Ireland
- Monkeypox meter : REALTIME MONKEYPOX TRACKER
- BBC : Monkeypox: India on alert after reporting fourth case
- The Guardian: Monkeypox declared global health emergency by WHO as cases surge
- World Health Organization : 2022 Monkeypox Outbreak: Global Trends
- BDnews24.com : মাঙ্কিপক্স: কতটা দুশ্চিন্তার?
- NDTV : Monkeypox Has Been A “Wake-Up Call”, Says WHO Chief Scientist
- NDTV : Amid Monkeypox Surge, WHO Urges “Reducing Number Of Sexual Partners”
- Bdnews24 : মাঙ্কিপক্স: দেশের সব বন্দরে সতর্কতা
- Prothom Alo : মাঙ্কিপক্স নিয়ে বিশ্বজুড়ে সতর্কতা, বাংলাদেশের ভয় কম যে কারণে