গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চুরিকে কেন্দ্র করে গণপিটুনিতে মো. মামুন নামের এক বাঙালি যুবককে হত্যা করার জের ধরে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ এবং হামলার ঘটনা ঘটেছে। ফলশ্রুতিতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে পাহাড়ি এলাকায়। সংঘাতের এই রেশ পার্শ্ববর্তী জেলা রাঙামাটিতেও ছড়িয়েছে। হতাহত এবং নিহতের তথ্যও সামনে এসেছে। এই ইস্যুতে ক্রমাগত ছড়াচ্ছে গুজব ও অপতথ্য। পাহাড়ের এই সংকটে ছড়ানো ১১ টি অপতথ্য নিয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম ইতোমধ্যে একটি ফ্যাক্টফাইল প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ এবারের এই প্রতিবেদনে রয়েছে উক্ত ইস্যুতে ছড়ানো আরো ৫ টি গুজব বা অপতথ্য।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টায় খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার লারমা স্কয়ার এলাকায় পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। উক্ত সংঘর্ষের পরপরই সংঘর্ষে লেলিন চাকমা নামে একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে শীর্ষক দাবি ছড়িয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে এস প্রকাশ নামের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীকে লেলিন চাকমার চিকিৎসাধীন ছবিসহ গত ২১ তারিখে একটি পোস্ট করতে দেখা যায়। পোস্টটিতে বলা হয়, “লেলিন দাদার লাস্ট আপডেট > লেলিন দাদাকে খবর নিতে আজকেও হাসপাতালে গেছি। সিটি স্কিন রিপোর্ট পাওয়ার পরে ডাক্তার বলেছেন মাথায় তেমন রক্ত জমাট নেই তাই অপারেশন করতে হবে না। আপাতত ৭২ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখতে বলছে। আগের থেকে লেলিন দা একটু ইমপ্রুভমেন্ট হচ্ছে শরীর ফোলাটাও একটু কমছে। […]”
এছাড়া, Rio ckz নামের আরেকটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকেও আজ (২৩ সেপ্টেম্বর) চিকিৎসাধীন অবস্থায় লেলিন চাকমার একটি ভিডিও প্রচার করা হয়। পরবর্তীতে লেলিন চাকমার মৃত্যুর কোনো সংবাদও বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ, লেলিন চাকমা আহত হলেও নিহত হননি। তিনি বেঁচে আছেন এবং চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
সম্প্রতি পাহাড়ে সংকট ইস্যুতে আরেকটি ভিডিও ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। প্রচারিত ভিডিওটিতে দেখা যায়, কয়েকজন (পাহাড়ি) নারী সেনা সদস্যদের সাথে বাদানুবাদ করছেন এবং সেনা সদস্যকে লাঠি দিয়ে মারার চেষ্টা করছেন।
তবে, রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত উক্ত ভিডিওটি সাম্প্রতিক সময়ের নয়, বরং এই ভিডিওটি অন্তত ৫ বছর আগে থেকেই অনলাইনে বিদ্যমান আছে।
অশান্ত পাহাড় ইসুতে আরেকটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। প্রচারিত ছবিতে দেখা যায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবির পোশাক পরিহিত একজন ব্যক্তিকে আরো কয়েকজন (পাহাড়ি) প্রহার করছেন বা করার চেষ্টা করছেন। উক্ত ছবিটি প্রচার করে দাবি করা হয়, প্রচারিত ছবিটিতে “পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে মার খাচ্ছে বিজিবি”।
তবে, রিউমর স্ক্যানার টিম যাচাই করে দেখেছে, প্রচারিত এই ছবিটিও সাম্প্রতিক সময়ের নয়। এই ছবিটি সাম্প্রতিক পাহাড়ের সংকটের প্রেক্ষাপটে প্রচার করা হলেও এটি ২০২৩ সালের ভিন্ন একটি ঘটনার ছবি। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির পানছড়িতে সাড়ে ১২ লাখ টাকাসহ দুই হুন্ডি (দাবি অনুযায়ী) ব্যবসায়ীকে আটকের জেরে দুর্বত্তরা বিজিবির ওপর হামলা চালিয়ে দুই ব্যবসায়ীকে ছিনিয়ে নেয়। হামলায় কিছু বিজিবি সদস্য আহত হন। সে সময়ের ছবি এটি। এই ঘটনায় পরে এই বিষয়টি নিয়ে মামলাও হয়। অর্থাৎ, প্রচারিত উক্ত ছবিটিও সাম্প্রতিক সময়ের নয়, বরং পুরনো।
এদিকে অস্ত্রশস্ত্রসহ ভিক্ষু বেশের দুইজনের ছবি প্রচার করে পাহাড়িদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে অস্ত্র থাকার ছবি মর্মে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।
তবে, রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, অস্ত্রশস্ত্রসহ ভিক্ষুবেশের ঐ ছবিটি বাংলাদেশের নয়। বরং থাইল্যান্ডের। ছবিটিও প্রায় দশ বছর পুরোনো। ২০১৪ সালে থাইল্যান্ডের চনবুড়ি প্রদেশের শি রাচা জেলার একটি ধর্মীয় উপাসনালয়ে অভিযানে নানা মাদকদ্রব্যসহ, উক্ত অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যায়। উক্ত ছবির সাথে বাংলাদেশের পাহাড়ে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। থাইল্যান্ডের পুরোনো ঘটনার ছবিকেই পাহাড়িদের ছবি মর্মে ছড়ানো হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে আরেকটি দাবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হতে দেখা যায়৷ মশাল মিছিলের একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি প্রচার করা হচ্ছে, ৬ জন সেনা সদস্যকে পাহাড়ীরা ধরে নিয়ে গেছে। যার প্রেক্ষিতে উত্তাল ঢাকার দৃশ্য এটি।
কিন্তু, রিউমর স্ক্যানার টিম ভিডিওটি যাচাই করে দেখে, এটি পাহাড়ের কোনো ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত নয়। বরং ভিডিওটির পিছনে আসল ঘটনা হচ্ছে গত ২০ সেপ্টেম্বর তারিখে দুর্গাপূজার ছুটি বৃদ্ধি, সারাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িতদের বিচারসহ আট দফা দাবিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ঢাকায় মশাল মিছিল করেন। উক্ত ঘটনার ভিডিও এটি। তবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিরতা নিয়ে ঢাবিতে বিক্ষোভ হয়েছিল। তাছাড়া, সম্প্রতি পাহাড়িরা ৬ জন সেনা সদস্যকে ধরে নিয়ে গিয়েছে দাবির সপক্ষেও নির্ভরযোগ্য সূত্রে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।