প্রকৃতিতে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে ভূমিকম্প অন্যতম। U.C. Berkeley এবং Stanford University এর গবেষকদের মতে, হয়তো এই ভূমিকম্পের কারণে ট্রয় নগরী, মায়ান সভ্যতা, দক্ষিণ এশিয়ার হরোপ্পা সভ্যতাসহ পৃথিবীর বহু সভ্যতা এবং নগরী ধ্বংস হয়েছিল।
বিবিসি বাংলা কর্তৃক ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “গত একশো বছরে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে ভূমিকম্পের কারণে। যদিও এই সময়ে প্রযুক্তির অনেক উন্নতি ঘটেছে, কিন্তু তাতে ভূমিকম্পের কারণে মানুষের মৃত্যু খুব একটা ঠেকানো সম্ভব হয়নি।”
২০২৩ সালের ০৬ই ফেব্রুয়ারি সিরিয়া এবং তুরস্কে সংঘটিত ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের ভয়াবহতা দেখেছে গোটা বিশ্ব। কাতার ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরা কর্তৃক ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উভয় দেশের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, এই মাসের শুরুতে তুরস্ক ও সিরিয়ায় আঘাত হানা ভূমিকম্পে নিহত মানুষের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৫০ হাজার। দেশটির দুর্যোগ ও জরুরী ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (AFAD) জানিয়েছে, উক্ত ভূমিকম্পে তখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪৪,২১৮ জন। অন্যদিকে সিরিয়ায় সর্বশেষ ঘোষিত মৃতের সংখ্যা ছিল ৫,৯১৪ জন। উক্ত প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, এই ভূমিকম্পের কারণে তুরস্কের প্রায় ১লক্ষ ৭৩ হাজার ভবন ধসে পড়ে এবং তুরস্কের প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ এই ভূমিকম্পের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে জাতিংঘের ধারণা অনুযায়ী, সিরিয়ার প্রায় ৮.৮ মিলিয়ন মানুষ এই ভূমিকম্প দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভূমিকম্প নিয়ে এত এত ভয়াবহতা দেখার পর পর মানুষের মনে প্রায়সই একটি প্রশ্ন জাগে। আর এই প্রশ্নটি হলো আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদেরকে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, টর্নেডো, সুনামি এবং জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের বেলায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রায় নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী দিতে দেখা গেলেও ভূমিকম্পের বেলায় কেন তারা এরকম পূর্বাভাস দেন না? তাহলে কি ভূমিকম্পের বেলায় কোনো পূর্বাভাস বা ভবিষ্যদ্বাণী দেওয়া সম্ভব নয়? এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখা যায়। তাই এ নিবন্ধে আমরা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব কি না তা নিয়ে আলোচনা করবো।
ভূমিকম্প সম্পর্কে কি আসলেই কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব কিনা? কিংবা যদি ভবিষদ্বাণী যদি নাই করা যায়, তাহলে সেটা কেন সম্ভব না? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বুঝতে হলে আমাদের সবার আগে যে বিষয়গুলো সম্পর্কে সাম্যক জ্ঞান রাখতে হবে তা হলোঃ
- ভূমিকম্প কী?
- পৃথিবীর ভূ-অভ্যন্তরিন গঠন।
- ভূমিকম্পের কারণ (পাত সঞ্চালন তত্ত্ব)।
ভূমিকম্প কী?
স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতিতে ছোট বড় বিভিন্ন কারণেই ভূমির কম্পন অনুভূত হয়। যেমন মাটিতে কোনো কিছু পড়লেও তা ভূমিতে কম্পন সৃষ্টি করে, আবার রেললাইনে গাড়ি চলার কারণেও ভূমির কিছুটা কম্পন অনুভূত হয়। তবে রেললাইনের গাড়ি চলার সময় মাটির কম্পন হলেও এটিকে কিন্তু ঠিক ভূমিকম্প বলা যায়না। ভূমিকম্প হলো বিশেষ কিছু কারণে আকস্মিকভাবে ভূপৃষ্ঠের তীব্র কাঁপন কিংবা ভূ-আন্দোলন, যা একটি বিশাল এলাকা জুড়ে অনুভূত হয়।
ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার অন্যতম কারণগুলো হতে পারে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত এবং পৃথিবীতে আছড়ে পড়া উল্কাপিন্ডের আঘাত। তবে ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে পাত/টেকটোনিক প্লেটের সঞ্চালণ। এই পাত/টেকটোনিক প্লেট কি সেটা বোঝার জন্য পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে জানা গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবীর ভূ-অভ্যন্তরীণ গঠন
আমরা বর্তমানে আমাদের যে পৃথিবী দেখছি, তা একটা সময় এরকম ছিলোনা। ক্যালিফর্নিয়া একাডেমি অব সায়েন্স এর তথ্যমতে, প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে, পৃথিবী ছিলো জলন্ত এবং অত্যন্ত উত্তপ্ত একটি পিন্ড। সময়ের সাথে সাথে পৃথিবী তাপ হারিয়ে ঠান্ডা হতে শুরু করে এবং তৈরী হয় আমাদের এই ভূ-ত্বক। তবে সময়ের ব্যাবধানে পৃথিবীর উপরিভাগ শক্ত হলেও পৃথিবীর ভূ-অভ্যন্তর এখনো অত্যন্ত উত্তপ্ত রয়েছে এবং এটি এখনো ক্রমাগত ঠান্ডা হচ্ছে। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে পৃথিবী যখন ঠান্ডা হতে শুরু করে তখন এর ভারী উপাদানগুলো কেদ্রের দিকে এবং তুলনামূলক হালকা উপাদান গুলো নিচে অবস্থান করে। আর এই বৈশিষ্ট্যগুলোর ভিত্তিতে আমরা পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠনকে প্রধান তিনটি স্তরে ভাগ করতে পারি। যথাঃ
- Crust
- Mantle
- Core
পৃথিবীর উপরস্থ ভূত্বক (Crust) এবং Mantle স্তরের সবচাইতে উপরের যে কঠিন স্তর রয়েছে এই উভয় অংশকে একত্রে বলা হয় Lithosphere (লিথোস্ফিয়ার)। পৃথিবীর ভূ-অভ্যন্তরীণ গঠন আরো ভালোভাবে বুঝতে, দেখুন নিচের চিত্রটিঃ-

ভূমিকম্পের কারণ (পাত সঞ্চালন তত্ত্ব)
ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত এবং পৃথিবীতে আছড়ে পড়া উল্কাপিন্ডের আঘাত। তবে ভূমিকম্প সবচেয়ে বেশি সংঘটিত হয় পাত/টেকটোনিক্স প্লেটের সঞ্চালণের কারণে।
National Geographic এর একটি আর্টিকেলে বলা হয়, প্লেট টেকটোনিক্স হল একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, যা ব্যাখ্যা করে কিভাবে পৃথিবীর ভূ-অভ্যন্তরীণ গতিবিধির ফলে প্রধান ভূমিরূপ তৈরি হয়। ১৯৬০ এর দশকে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটি পর্বত নির্মাণ, আগ্নেয়গিরি এবং ভূমিকম্প সহ অনেক ঘটনা ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্লেট টেকটোনিক্স থিওরি অনুযায়ী পৃথিবীর উপরে যে লিথোস্ফিয়ার বা অশ্বমন্ডল রয়েছে সেটি পুরোপুরি নিরেট নয় বরং এই লিথোস্ফিয়ার মূলত আলাদা আলাদা পাথুরে পাত (Plate) এ বিভক্ত। আর এই প্লেটগুলো অ্যাথেনোস্ফিয়ার নামক পাথরের আংশিক গলিত স্তরের উপরে ভাসমান অবস্থায় থাকে। অ্যাথেনোস্ফিয়ার এবং লিথোস্ফিয়ারের পরিচলনের কারণে, পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটগুলো প্রতি বছর দুই থেকে 15 সেন্টিমিটার (এক থেকে ছয় ইঞ্চি) বিভিন্ন হারে একে অপরের সাপেক্ষে সরে যায়।
বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘Think School’ এ বলা হয়, পৃথিবীর ভেতরে তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলোর ক্ষয়ের কারণে ভীষণ রকমের তাপের সৃষ্টি হয়। এছাড়া সেই সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে যখন বিভিন্ন ধরনের গ্রহাণুর সম্মেলনে আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিল আমাদের এই গ্রহ, তখন তাদের শক্তিও পৃথিবীর গভীরে আটকা পড়ে যায়। এদের থেকে ক্রমাগত হারে তাপ বের হচ্ছে এখনও। এই তাপশক্তি পৃথিবীর গভীরের ম্যান্টেলের মধ্য দিয়ে ক্রমশ উপরের দিকে উঠে আসতে থাকে কনভেকশন কারেন্ট বা পরিচলন স্রোতে। ব্যাপারটাকে অনেকটা হাঁড়িতে ডাল গরম করার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। হাঁড়ির নিচের আগুনের তাপ তরল ডালের মধ্যে কনভেকশান স্রোত সৃষ্টি করে ওপরে উঠে আর নিচ থেকে উত্তপ্ত ডাল ক্রমাগত উপরে উঠে আসতে থাকে এর সাথে। আর ওদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বাইরের স্তর বা লিথোস্ফেয়ার, যার উপরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তা কিন্তু নিরেট নয়, বরং ১৫-২০টি ছোট বড় টেকটনিক প্লেট বা পাতে বিভক্ত এবং এই পাতগুলো তাদের নিচের সেই গলিত, পাথরের স্তর বা ম্যাগমার ওপর ধীরগতিতে প্রবাহিত হতে থাকে। ফলে ম্যান্টেলের ভিতর থেকে সেই উত্তপ্ত বস্তু লিথোস্ফিয়ারের বা দুটো পাতের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে এবং ধাক্কা দিয়ে বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘Think School’ এ বলা হয়, পৃথিবীর ভেতরে তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলোর ক্ষয়ের কারণে ভীষণ রকমের তাপের সৃষ্টি হয়। এছাড়া সেই সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে যখন বিভিন্ন ধরনের গ্রহাণুর সম্মেলনে আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিল আমাদের এই গ্রহ, তখন তাদের শক্তিও পৃথিবীর গভীরে আটকা পড়ে যায়। এদের থেকে ক্রমাগত হারে তাপ বের হচ্ছে এখনও। এই তাপশক্তি পৃথিবীর গভীরের ম্যান্টেলের মধ্য দিয়ে ক্রমশ উপরের দিকে উঠে আসতে থাকে কনভেকশন কারেন্ট বা পরিচলন স্রোতে। ব্যাপারটাকে অনেকটা হাঁড়িতে ডাল গরম করার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। হাঁড়ির নিচের আগুনের তাপ তরল ডালের মধ্যে কনভেকশান স্রোত সৃষ্টি করে ওপরে উঠে আর নিচ থেকে উত্তপ্ত ডাল ক্রমাগত উপরে উঠে আসতে থাকে এর সাথে। আর ওদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বাইরের স্তর বা লিথোস্ফেয়ার, যার উপরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তা কিন্তু নিরেট নয়, বরং ১৫-২০টি ছোট বড় টেকটনিক প্লেট বা পাতে বিভক্ত এবং এই পাতগুলো তাদের নিচের সেই গলিত, পাথরের স্তর বা ম্যাগমার ওপর ধীরগতিতে প্রবাহিত হতে থাকে। ফলে ম্যান্টেলের ভিতর থেকে সেই উত্তপ্ত বস্তু লিথোস্ফিয়ারের বা দুটো পাতের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে এবং ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে থাকে মহাদেশীয় বা সামুদ্রিক, টেকটনিক পাতগুলোকে। আর এভাবেই অনবরত ঘটে পাতের সঞ্চালন।
ভূ অভ্যন্তরের এই টেকটোনিক প্লেটগুলোর সঞ্চালন কিভাবে ঘটে?
National Oceanic and Atmospheric Administration এর তথ্যমতে, ভূ-অভ্যন্তরীণ টেকটোনিক প্লেটগুলোর সঞ্চালন মূলত তিনভাবে ঘটতে পারে। এগুলো হচ্ছেঃ
- divergent boundary
- convergent boundary
- transform plate boundary

Divergent Boundary: ভূ-অভ্যন্তরীণ টেকটোনিক প্লেটগুলোর সঞ্চালনের ক্ষেত্রে যদি দুটি প্লেট পরস্পর থেকে দূরে সরতে থাকে তখন তাকে ডাইভারজেন্ট বাউন্ডারি বা বিমুখগামী সীমা বলে। বিমুখগামী সীমাগুলোতে ভূমিকম্প একটি সাধারণ ঘটনা এবং এই সীমাগুলো দিয়েই ভূ-অভ্যন্তর থেকে গলিত ম্যাগমা পৃথিবীর উপরিভাগে উঠে আসে এবং নতুন মহাসাগরীয় ভূত্বক সৃষ্টি করে।
Convergent Boundary: যখন দুটি প্লেট পরস্পরের দিকে একত্রিত হতে থাকে, এটি একটি অভিসারী সীমানা হিসাবে পরিচিত। এক্ষেত্রে পাতগুলো কাছাকাছি আসতে আসতে একে অন্যের নিচে ঢুকেও যায়। তবে অভিসারমুখী সীমায় যে সবসময় একটি পাত অন্য একটি পাতের নিচে চলে যায় তাও কিন্তু নয়। কখনো কখনো দুটি টেকটোনিক প্লেট কেউ কারো নিচে চলে না গিয়ে দুটি প্লেটই নিজেদের সংঘর্ষস্থল থেকে উপরের দিকে উঠতে থাকে। আর এভাবেই প্রায় ৪০-৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে মহাদেশ থেকে বিচ্ছন্ন হওয়া ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশীয় প্লেটের সংঘর্ষে হিমালয় পর্বতমালা সৃষ্টি হয়েছিল।

Transform Plate Boundary: ভূ-অভ্যন্তরীণ টেকটোনিক প্লেটগুলোর সঞ্চালনের ক্ষেত্রে যদি দুটো পাত একে অপরের সাথে সমান্তরালভাবে সরতে থাকে তাহলে সেটিকে বলা হয় ট্রান্সফর্ম বাউন্ডারি বা পরিবর্তক সীমা। পরিবর্তক সীমার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ার সান আন্দ্রিয়াস ফাটল।
গত ১০ মিলিয়ন বছরে সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট গড়ে প্রতি বছর ৩০মিমি থেকে ৫০ মিমি করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চলাচলের এই বর্তমান হার বজায় থাকলে এই ফাটলের দুদিকের ভূমি সরতে সরতে আজ থেকে ২০ মিলিয়ন বছর পরে, বর্তমানে লস এঞ্জেলস শহর সান ফ্রানসিসকো শহরের পাশে চলে আসবে।
ভূমিকম্প কেন হয়?
ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে যে, পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটগুলো মোটেও স্থির না বরং খুবই ধীর গতিতে এরা সর্বদা সঞ্চালিত হতে থাকে। আর পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটগুলোর সঞ্চালনের ফলে কখনো কখনো এরা নিজেদের ফাটল রেখা বরাবর কখনো কখনো একটি প্লেট আরেকটি প্লেটের উপরে উঠে যাওয়ার জন্য, আবার কখনো বা আনুভূমিকভাবে পিছলে সরে যাওয়ার জন্য চাপে থাকে। মূলত শিলার মধ্যে থাকা ঘর্ষণ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণেই এই চাপের সৃষ্টি হয়।
US Geological Survey এর তথ্যমতে, পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটগুলো যেহেতু ধীরে হলেও সর্বদা চলমান থাকে তাই একই ফাটলরেখা (Fault Line) বরাবর অবস্থানরত দুটো টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে ক্রমাগত চাপ বাড়তে থাকে। ফলে একটা সময় পর তা শিলার প্রতিরোধ ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়াতে এই শিলাগুলো ভেঙে যায় এবং এদের স্থানচ্যুতি ঘটে। টেকটোনিক প্লেটগুলোর এই আকষ্মিক স্থানচ্যুতির কারণে মুক্তি পায় বহুকাল ধরে জমে থাকা বিপুল পরিমাণ শক্তি, যা তরঙ্গ আকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর টেকটোনিক প্লেটের আকষ্মিক স্থানচ্যুতির কারণে চারদিকে ছড়িয়ে পড়া সিসমিক তরঙ্গের কারণেই ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগ আন্দোলিত হয়, যাকে আমরা ভূ-কম্পন কিংবা ভূমিকম্প বলে থাকি।
আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে ভূমিকম্পগুলো যেহেতু দুটি টেকটোনিক প্লেটের সীমানা কিংবা ফাটলরেখা বরাবর হয়ে থাকে তাই যেসকল দেশ/স্থানের উপর দিয়ে এরকম ফাটলরেখাগুলো গিয়েছে সেসব দেশ/স্থানগুলোই বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ। উদাহরণস্বরুপঃ জাপানের মধ্যে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় টেকটোনিক প্লেটের ফাটলরেখা (Fault Line) বেশি হওয়াতে এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলোর একটি হিসেবে ধরা হয়।
একটি ফাটলরেখায় দুটি টেকটোনিক প্লেটের স্থানচ্যুতির ফলে যে শক্তি নির্গত হয়, তা ভূ-ত্বকের শিলার মাধ্যমে চারিদিকে তরঙ্গ বা ওয়েব হিসেবে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর দুটি প্লেটের স্থানচ্যুতির ফলে চার ধরণের তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। এই তরঙ্গগুলো হচ্ছেঃ
- P-wave
- S-wave
- Love Wave
- Rayleigh Wave
উলেখ্য যে এই চার ধরণের ওয়েভের মধ্যে P এবং S wave ভূত্বকের গভীর অংশ দিয়ে ছড়ায় এবং অনেক দূর পর্যন্ত পৌছাতে পারে। এদের মধ্যে P-wave বলতে গেলে পৃথিবীর কোর বা কেন্দ্রের মধ্য দিয়েও প্রবাহিত হতে পারে।

উল্লেখ্য যে, একটি ভূমিকম্প কতটা মারাত্মক হবে সেটা নির্ভর করে দুটি টেকটোনিক প্লেটের আকস্মিক স্থানচ্যুতির কারণে নির্গত শক্তির উপর। দুটি টেকটোনিক প্লেটের স্থানচ্যুতি যত বিস্তৃত এলাকাজুরে হবে, সেখান থেকে নির্গত তরঙ্গও তত বেশি শক্তিশালী হবে, ফলে ভূপৃষ্ঠে এর প্রভাবও ততটাই সুদূর প্রসারী হবে। তাছাড়া, ভূমিকম্পের তীব্রতাকে প্রভাবিত করে এমন আরো কিছু ফ্যাক্টর হচ্ছে, ভূমিকম্পের গভীরতা, চ্যুতির নৈকট্য, অন্তর্নিহিত মাটি এবং ভবনের বৈশিষ্ট্যগুলো-বিশেষ করে উচ্চতা ইত্যাদি।
ভূমিকম্প নিয়ে কি কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে Can you predict earthquakes? শীর্ষক একটি faq এর উত্তরে বলা হয়েছে,
“না। ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে অথবা অন্য কোনো বিজ্ঞানীরা কখনো বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেননি। আমরা জানি না কীভাবে এই ভবিষ্যদ্বাণী করতে হয়। নিকট ভবিষ্যতে এটা জানা যাবে, এমনটা মনেও হয় না। ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে (USGS) এর বিজ্ঞানীরা শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক সময়ের (বছর) মধ্যে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা গণনা করতে পারেন।

ভূমিকম্প সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বানী করার ক্ষেত্রে যে তিনটি বিষয়ের অবশ্যই সঠিক ব্যাখ্যা দিতে হবে সেগুলো হচ্ছে, ১.ভূমিকম্পের তারিখ ও সময়; ২.স্থান; এবং ৩.ভূমিকম্পের অনুমিত মাত্রা।
হ্যাঁ, কিছু লোক বলে যে তারা ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে, কিন্তু তাদের দাবিগুলো মিথ্যা। আর এর কারণগুলো হচ্ছেঃ
- তাদের এই ভবিষ্যদ্বানীগুলো বৈজ্ঞানিক প্রমাণের উপর ভিত্তি করে করা হয়না। অন্যদিকে ভূমিকম্প একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার অংশ।
- ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য উপরোক্ত তিনটি বিষবস্তু সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য আগে থেকেই সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
- যারা দাবি করে যে, তারা আগে থেকেই ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে, তাদের ক্ষেত্রে লক্ষ করলে দেখা যায় এই ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো খুবই সাধারণ মানের। উদাহরণস্বরুপঃ যদি বলা হয়ে থাকে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোথাও একটি M4 মাত্রার ভূমিকম্প হবে তাহলে সেটি কখনোই সূস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী হতে পারেনা।
যখন কোনো ভূমিকম্প হয়, যেটা তাদের পূর্বাভাসের কিছু অংশের সাথে মিলে যায়, তখন তারা দাবি করে তারা সফল, যদিও তাদের পূর্বাভাসের একাধিক তথ্য বাস্তবে যা হয় তার চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন, তাই এটা ব্যর্থ পূর্বাভাস ।
অবৈজ্ঞানিক ব্যক্তিদের ভবিষ্যদ্বাণী সচরাচর তখনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোরাঘুরি শুরু করে যখন কোনো অজানা কিছু হয়, যেটাতে ধারণা করা হয় যে এই সব ঘটনা নিকট ভবিষ্যতে ভূমিকম্পের আভাস দেয় । এই আভাসগুলো হতে পারে ছোট ছোট ভূমিকম্পের মড়ক, স্থানীয় জলাশয়ে রেডন গ্যাস বেড়ে যাওয়া, প্রাণীদের অস্বাভাবিক আচরণ, মাঝারি ভূমিকম্পের মাত্রায় বৃদ্ধি বা একটি মাঝারি ধাক্কা, যা এত বিরল যে সেটাকে পূর্বাঘাত (foreshock) হিসেবেও ধরা যায় না।
দুর্ভাগ্যবশত, এই ধরনের বেশিরভাগ আভাসগুলো প্রায়শই ভূমিকম্পের পূর্ব প্রভাব ছাড়াও ঘটে। তাই, প্রকৃপক্ষে ভুমিকম্প নিয়ে একটি বাস্তব ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব নয়। তবে ভূমিকম্প সম্পর্কে বাস্তব বা প্রকৃত অর্থে ভবিষ্যদ্বাণী না করা গেলেও এর পরিবর্তে কিছু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে পূর্ভাভাস সম্পর্কে বেশ কিছু সম্ভাবনা দাঁড় করানো যেতে পারে।”
অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগের মতো ভূমিকম্পের বেলায় বাস্তব ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব না হলেও একটি নির্ষিষ্ট সময়কালের (Time Window) মধ্যে ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু তার সম্ভাবনা দাঁড় করানো যেতে পারে। আর এই বিষয়টি বোঝানোর জন্য বিজ্ঞানীরা দুইটি আলাদা পদ (Terms) ব্যবহার করে থাকে। যথাঃ
1. Earthquake Probabilities.
2.Earthquake Forecast.
‘Earthquake Probabilities’ দ্বারা মূলত একটি দীর্ঘমেয়াদি সময়ব্যাপ্তির মধ্যে ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু তা নির্দেশ করে। বেশিরভাগ ভূমিকম্পের সম্ভাবনা ঐতিহাসিক ঘটনার গড় হার থেকে নির্ধারিত হয়। কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ভূমিকম্প সংঘটনের হারকে ধ্রুবক হিসেবে ধরে নিলে পরবর্তী বছরগুলোতে ভূমিকম্পের হার সম্পর্কে সম্ভাব্য বিবৃতি প্রদান করা সম্ভব। তবে এই সম্ভাবনার সীমা ১/৩০ থেকে শুরু করে ১/৩০০০ এর মধ্যে হতে পারে।
তবে যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে, ঐতিহাসিক ঘটনার তথ্য পাওয়া না যায় সেক্ষেত্রে Slip Rate নামক গাণিতিক টার্ম ব্যবহার করে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা নির্ধারণ করা হয়। আর এই সম্ভাবনার সীমা ১/৩০ থেকে ১/৩০০ এর মধ্যে হতে পারে।
অন্যদিকে, ‘Earthquake Forecast’ দ্বারা মূলত একটি সময়ব্যপ্তির মধ্যে ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু তা নির্দেশ করে। সাধারণত ভূমিকম্পের আফটার-শক (Aftershocks) এর ব্যাপারে এই টার্ম ব্যবহৃত হয়। একটি বড় ভূমিকম্পের পরে, আফটারশক হিসেবে আরেকটি হয় যেটির তীব্রতার মাত্রা এবং সময়ব্যপ্তি পূর্বের ভূমিকম্পের চেয়ে তুলনামূলক কম হয়ে থাকে। বেশিরভাগ আফটারশকের ক্রম একই প্যাটার্ন অনুসরণ করে বিধায় ভূমিকম্পের পর একটি একটি নির্দিষ্ট আফটারশকের সম্ভাব্যতা নির্ধারণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে এই সম্ভাবনার সীমা ১/৩০ এর বেশি হতে পারে।
ভূমিকম্প আগে থেকেই প্রেডিক্ট করা যায় কিনা সে ব্যাপারে দৈনিক প্রথম আলো কর্তৃক প্রকাশিত বিজ্ঞান ম্যাগাজিন ‘বিজ্ঞানচিন্তা‘ এর একটি আর্টিকেলে বলা হয়,
“ভূমিকম্প সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য জানা প্রয়োজন ৪টি জিনিস। ১. ভূমিকম্পের তারিখ, ২. সময়, ৩. স্থান আর ৪. ভূমিকম্পের অনুমিত মাত্রা। কথা হলো, এই চারটা জিনিস বিজ্ঞানীরা বুঝবেন কীভাবে? একটা উদাহরণ দিই।
বৃষ্টি হবে, এটা বোঝার উপায় কী? আকাশে মেঘ জমতে হবে প্রথমে। সেক্ষেত্রে বৃষ্টির সম্ভাবনা বোঝা যায়। মেঘের নিচের স্তর থেকে মূলত বৃষ্টি হয়। এই স্তরটা ভারী হয়ে উঠছে কি না, ওপরের দিকের উষ্ণ ও হালকা বায়ু আর নিচের দিকের শীতল ও ভারী বায়ুর বিনিময় ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় খেয়াল করেন আবহাওয়াবিজ্ঞানীরা। এ থেকে তাঁরা অনুমান করেন, বৃষ্টি কোথায়, কখন, কতটা হবে।
তারমানে, ভূমিকম্পের সঙ্গেও এরকম কিছু বিষয়ের সংযোগ বের করতে হবে ভূতত্ত্ববিদদের। দেখতে হবে, একটা ভূমিকম্পের আগে আগে ঠিক কোন ঘটনাগুলো ঘটে। আর লাগবে মহাদেশীয় পাতগুলোর সঞ্চারণ বা নড়াচড়া অনুমানের মতো সূক্ষ্ম গাণিতিক মডেল। এই মডেল ব্যবহার করে অনুমান করতে হবে, পাতগুলো কখন, কতটা নড়বে ও কোনদিকে যাবে; এ সময় কী কী হতে পারে এসব।
বিজ্ঞানীরা সেই চেষ্টা করেছেন তবে সফল হননি। তাঁরা বেশ কিছু প্রাকৃতিক ঘটনার সঙ্গে ভূমিকম্পের সংযোগ বের করার চেষ্টা করেছেন। যেমন ভূমিকম্পের আগে অনেক সময় আশপাশের জলাধারগুলোতে রেডনের পরিমাণ বেড়ে যায়। পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। পরিবর্তন দেখা যায় তড়িৎচৌম্বকীয় ক্রিয়ায়। বিভিন্ন প্রাণীর আচরণে নানারকম অসঙ্গতিও চোখে পড়ে। কিন্তু অনেকভাবে চেষ্টা করেও বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হতে পারেননি, এরকম কিছু হলেই ভূমিকম্প হবে। আবার অনেক সময় ভূমিকম্প হলেও এসব ঘটতে দেখা যায় না। অর্থাৎ, ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ তাঁদের হাতে নেই।
ভূমিকম্পের উৎপত্তি পৃথিবীর অনেকটা গভীরে। সেখান থেকে প্রচণ্ড শক্তি এসে পৌঁছে পৃষ্ঠতলে। হতে পারে, ভূমিকম্পের উৎপত্তির আগে কিছু নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটে। কিন্তু পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে আমরা সেগুলো শনাক্ত করতে পারি না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, কি যে শনাক্ত করতে হবে বা কোন চিহ্নটা খোঁজা প্রয়োজন, তা-ই জানেন না বিজ্ঞানীরা। তাঁদের হাতে এ বিষয়ক কোনো সূত্রও নেই।
বিজ্ঞানীরা তাই আপাতত কাছাকাছি একটি কাজ করেন। তাঁরা কিছু নির্দিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফল্ট লাইনের গাণিতিক মডেল তৈরি করে, সেগুলোর আচরণ থেকে বোঝার চেষ্টা করেন, ভূমিকম্প হতে পারে কি না। তবে এই কাজটিও অনেক জটিল। প্রচণ্ড চাপ ও তাপমাত্রায় পাথর কীভাবে কাজ করে, শুধু সেটা বের করলেই হয় না। পৃথিবীর যত গভীরে যাব, তাপমাত্রা ও চাপ তত বাড়বে। এই প্রচণ্ড তাপমাত্রা, চাপ, এদের পরিবর্তনশীলতা ও পাথর এবং খনিজদের এ পরিস্থিতিতে আচরণ—সব আবার গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে বানিয়ে দেখা বা খুঁটিনাটি সব উপাত্ত ব্যবহার করে মডেল বানিয়ে সিমুলেশন তৈরি করা খুব সহজ কাজ নয়। এ জন্য বিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্রের সান আন্দ্রেয়াজ ফল্ট অঞ্চলে গর্ত খুঁড়ে, উপাত্ত সংগ্রহ করেও দেখেছেন। কিন্তু এগুলোর জন্য অনেক শ্রম যেমন দিতে হয়, তেমনি কাজগুলোও অনেক ব্যয়বহুল। আর সবশেষে যুতসই ফলাফলও পাওয়া যায় না। সবমিলে, বিষয়টা বেশ জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরেকটি বিষয় হলো, বিজ্ঞানীদের সাধারণ ধারণা, মৃদু ভূমিকম্প ও প্রচণ্ড ভূমিকম্পগুলো একইভাবে শুরু হয়। ভাবনাটি যৌক্তিক। ফলে, সমস্যা হলো, কোনো প্রাথমিক চিহ্ন খুঁজে পেলেও সেটা বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত করছে, নাকি মৃদু ভূমিকম্প—সেটা অনুমান করা মুশকিল।”
প্রাণীরা কি ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে পারে?
US Geological Survey কর্তৃক ‘Animals & Earthquake Prediction’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে বলা হয়, “ভূমিকম্পের পূর্বে পশুপাখিদের অস্বাভাবিক আচরণের বিষয়টি প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রীষ্টপূর্ব ৩৭২ অব্দে, গ্রীসে। আরো বলা হয়, ইঁদুর, নীল, সাপ এবং সেন্টিপিডস এর মতো প্রাণীদেরকে ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পের বেশ কয়েক দিন আগে নিরাপত্তার জন্য তাদের বাড়িঘর ছেড়ে দিতে দেখা গিয়েছে। এমনকি মাছ, পাখি, সরীসৃপ এবং কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক সেকেন্ড আগে পর্যন্ত অদ্ভুত আচরণ প্রদর্শন আশ্চর্যজনক প্রমাণ রয়েছে। যাই হোক, সিসমিক ইভেন্টের (ভূমিকম্প সংঘটন) পূর্বে প্রাণীদের এমন সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং নির্ভরযোগ্য আচরণ, এবং এটি কীভাবে কাজ করতে পারে তার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা এখনও আমাদের কাছে নেই। বর্তমান সময়ে, এই রহস্যের উদঘাটনে কাজ করা বিজ্ঞানীরা চীন এবং জাপানে রয়েছেন।
তবে ভূমিকম্পের কয়েক সেকেন্ড পূর্বে প্রানীদের অস্বাভাবিক আচরণের ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীদের কাছে রয়েছে। ভূমিকম্পের কোনো স্থানে ভূমিকম্প হলে ঐ স্থান থেকে ‘P Wave’ নামের এক ধরনের ছোট শকওয়েভ সবার আগে পৃথিবীতে পৌছায়। বেশিরভাগ মানুষ এই ‘P Wave’ এর উপস্থিতি টের না পেলেও অনেকে প্রাণীরাই এই ওয়েভের উপস্থিতি ঠিকই টের পায়। অন্যদিকে বেশিরভাগ মানুষ ভূমিকম্প টের পায় ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে যখন ‘S Wave’ ভূ-পৃষ্ঠে এসে পৌছায়। মূলত ভূ-পৃষ্ঠে S ওয়েভের আগে P ওয়েভ পৌছানোর কারণে মানুষের আগে কিছু কিছু প্রাণীরা ভূমিকম্পেরর উপস্থিতি টের পায় এবং তাদের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করা যায়।
একসময় একটি কথিত থিওরি ছিলো যেখানে বলা হয়, ‘San Jose Mercury’ এর নিউজে হারিয়ে যাওয়া পোষা প্রাণীর বিজ্ঞাপন এবং ‘San Francisco Bay’ ভূমিকম্পের তারিখগুলোর মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৮৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়া জিওলজিতে প্রকাশিত এক আর্টিকেলে এই তত্ত্বের একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে নিউজে হারিয়ে যাওয়া পোষা প্রাণীদের বিজ্ঞাপনের তারিখের সাথে সান ফ্রান্সিকোর ‘বে’ এলাকায় হওয়া ভূমিকম্পের কোনো সম্পর্ক নেই।
ভূমিকম্পের সময় প্রাণীদের অস্বাভাবিক আচরণের ব্যাপারে ২০০০ সালে একজন বিজ্ঞানীর একটি বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র সংক্ষেপে তুলে ধরা হচ্ছেঃ-
“ভূমিকম্পের সময় কিংবা সিসমিক ইভেন্টের সময় কিছু পূর্বে প্রাণীদের অস্বাভাবিক আচরণ বিবর্তনগত কিনা এবং এই ধরণের আচরণ কোনো জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কিনা সেই প্রশ্নের উত্তরে উক্ত গবেষণাপত্রে বলা হয়, সমস্ত প্রাণী সহজাতভাবেই শিকারীদের হাত থেকে বাঁচতে এবং তাদের জীবন রক্ষার জন্য তাৎক্ষণিক সাড়া প্রদান করে থাকে। বিপদকালীন সময়ে বিভিন্ন ধরণের মেরুদন্ডী ইতোমধ্যেই ‘প্রাথমিক সতর্কতা’ আচরণ প্রকাশ করে, যা আমরা ভূমিকম্প ব্যতীত অন্যান্য ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে বুঝতে পারি, তাই এটি সম্ভব যে ভূমিকম্পের সময়ে প্রাণীদের অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া জিনগত কারণে আগে থেকেই বিদ্যমান। যদিও সিসমিক ইভেন্টের পর একটি বৃহত্তর S তরঙ্গের সেকেন্ড আগে একটি P-তরঙ্গ ভূপৃষ্ঠে আঘাত হানার পর প্রাণীদের অস্বাভাবিক আচরণ একটি সহজাত প্রতিক্রিয়া, তাই বলতে গেলে এটি একটি ‘বিশাল ব্যাবধান কিংবা বড় কিছু’ নয়। তবে ভূমিকম্পের কয়েক দিন বা সপ্তাহ আগে ঘটতে পারে এমন অন্যান্য পূর্বাভাস সম্পর্কে কি আমরা এখনও জানি না? প্রকৃতপক্ষে, যদি ভূমিকম্পের এমন কোনো পূর্বাভাস থাকে যা সম্পর্কে আমরা এখনো ভালোভাবে জানতে পারিনি (স্থল কাত হওয়া,ভূগর্ভস্থ জলের পরিবর্তন, পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের বিচিত্রতা) তাহলে, প্রকৃতপক্ষে এটি হতে পারে যে কিছু প্রাণী এসব পূর্বাভাস বুঝতে পারে।
তবে, এই বিষয়ে এখনও আরও অনেক গবেষণা করা প্রয়োজন।…. কারণ এই সংকেতগুলো যদি ভূমিকম্পের আগে পরিবেশে উপস্থিত না থাকে তবে একটি সংযোগ অপ্রাসঙ্গিক।”

সুতরাং, এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো বিজ্ঞানী অথবা গবেষণা সংস্থা কর্তৃক ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানীরা কেবল একটি নির্দিষ্ট স্থানে কয়েক বছরে মধ্যে ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা করতে পারলেও, কোনো স্থানে কখন, কোথায় এবং কত মাত্রায় ভূমিকম্প হতে পারে সে ব্যাপারে আগে থেকে কিছু বলা সম্ভব হয়নি। আবার ভূমিকম্প সংঘটনের কয়েকঘন্টা কিংবা কয়েকদিন পূর্বে কিছু প্রাণীর মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করা গেলেও প্রকৃতপক্ষে এই অস্বাভাবিক আচরণের পেছনে ভূমিকম্প দায়ী কিনা সেটি এখনো নিশ্চিত নয় এবং বিজ্ঞানীরা মনে করেন এটি নিয়ে আরো বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন। তাই, ভূমিকম্প এখন পর্যন্ত প্রেডিক্ট করা যায় না, সামনে প্রেডিক্ট করা যাবে এ বিষয়েও নিশ্চিত নন বিজ্ঞানীরা। ভূমিকম্প প্রেডিক্ট করতে পারার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। তবে ভূমিকম্প ঝুঁকির এলাকাগুলোর ভূমিকম্পের সম্ভাবনা অনুমান করা যায়। আবার এই অনুমান সবসময় সঠিক হবে না। সাধারণত যারা ভূমিকম্প প্রেডিক্ট করতে পারে বলে দাবি করে তারা মূলত অধিক ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলো নিয়ে তাদের প্রেডিকশন প্রকাশ করে, যে এলাকায় সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভবনা বেশি এবং যেখানে যেকোনো সময় ভূমিকম্প হতে পারে। তবে কেউ যদি বলে আগামী ৭২ ঘন্টার মধ্যেই ভূমিকম্প ঘটবে এবং উল্লেখিত মাত্রায় ঘটবে তবে তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সুতরাং, বৈজ্ঞানিকভাবে সুনির্দিষ্ট করে ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বানী করা সম্ভব নয়।
তথ্যসূত্র
- Optimum Seismic: How Have Earthquakes Shaped Civilization?
- BBC News Bangla: যেসব ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপেছিল বিশ্ব
- Aljazeera: Death toll climbs above 50,000 after Turkey, Syria earthquakes
- California Academy of Science: From Core to Crust, Defining Earth’s Layers
- United State Geological survey: Cutaway views showing the internal structure of the Earth. Left: To…
- National Geographic: Plate Tectonics
- Think School: Plate Tectonics
- National Oceanic and Atmospheric Administration: What are the different types of plate tectonic boundaries?
- United State Geological survey: The Himalayas,Two continents collide
- The Geological Society: Los Angeles will be adjacent to San Francisco in approximately 20 million years
- World Atlas: The World’s 10 Most Earthquake Prone Countries
- US Geological Survey: What is an earthquake and what causes them to happen?
- National Science Foundation: Seismic Wave Motions—4 waves animated
- US Geological Survey: P-wave and S-wave paths through the earth By Earthquake Hazards Program
- Jumpstart: What Affects Earthquake Shaking?
- US Geological Survey: Can you predict earthquakes?
- US Geological Survey: What is the difference between earthquake early warning, earthquake forecasts, earthquake probabilities, and earthquake prediction?
- বিজ্ঞানচিন্তা: ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণী করা কি সম্ভব?
- US Geological Survey: Animals & Earthquake Prediction