সেনাবাহিনীর উপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার চিঠি ও হাসিনার প্রত্যাবর্তন বিষয়ে ভুয়া তথ্য প্রচার

সম্প্রতি জাতিসংঘের কথিত একটি চিঠির ছবি সম্বলিত পোস্টের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি প্রচার করা হয়েছে, “জাতিসংঘ সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘ থেকে পাঠানো একটি চিঠির মাধ্যমে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে জানানো হয়েছে যে, যদি আগামী ২৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা না যায় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া সফলভাবে বাস্তবায়িত না হয়, তবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপর শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।”

সেনাবাহিনী

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সেনাবাহিনীর উপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুশিয়ারি ও হাসিনার প্রত্যাবর্তন বিষয়ে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর কাছে জাতিসংঘ চিঠি পাঠিয়েছে শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয় বরং, ব্লগস্পটের বিনামূল্যের ডোমেইন সাইটে কালের কণ্ঠের লোগো ব্যবহার করে প্রচারিত একটি ভুয়া সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচিত দাবি প্রচার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত পোস্টগুলো পর্যবেক্ষণ করলে তাতে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। পোস্টগুলোতে কেবল জাতিসংঘের একটি কথিত চিঠির ছবির সংযুক্তি পাওয়া যায়। এ বিষয়ে অনুসন্ধানে জাতিসংঘ এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোতে এমন কোনো চিঠি প্রকাশের প্রমাণ মেলেনি। তবে, উল্লিখিত দাবিতে প্রচারিত কিছু পোস্টে “বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা চিঠি প্রকাশ – একটি জরুরি পরিস্থিতি*” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের স্ক্রিনশটের সংযুক্তি পাওয়া যায় যেখানে মূলধারার সংবাদমাধ্যম কালের কণ্ঠের লোগোর উপস্থিতিও পাওয়া যায়। 

এরই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করলে ব্লগস্পটের বিনামূল্যের একটি ডোমেইন সাইটে “ডেইলি নিউজ বিডি আওয়ামী লীগ” নামক একটি সাইটে “বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা চিঠি প্রকাশ – একটি জরুরি পরিস্থিতি*” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত উক্ত প্রতিবেদনটি গত ১৩ জানুয়ারি প্রকাশিত হতে দেখা যায় এবং জানা যায় যে এটিই আলোচিত দাবিটির সম্ভাব্য উৎস। উক্ত সাইটটি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, সাইটটির লোগো হিসেবে কালের কণ্ঠের লোগো ব্যবহার হলেও এর ইউআরএলে ব্যবহার হয়েছে আওয়ামী লীগের নাম; নাম দেওয়া হয়েছে ডেইলি নিউজ বিডি আওয়ামী লীগ।

কথিত সংবাদটি পড়ে দেখা যায়, এতে দাবি করা হয়েছে, “জাতিসংঘ সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘ থেকে পাঠানো একটি চিঠির মাধ্যমে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে জানানো হয়েছে যে, যদি আগামী ২৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা না যায় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া সফলভাবে বাস্তবায়িত না হয়, তবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপর শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।” কথিত উক্ত সংবাদ প্রতিবেদনেও প্রচারিত কথিত জাতিসংঘের চিঠিটিরও সংযুক্তি পাওয়া যায়৷ এছাড়াও প্রতিবেদনটিতে ‘পদক্ষেপের সম্ভাবনা’, ‘মার্শাল ল জারি করার সম্ভাবনা’, ‘সেনাবাহিনীর পদক্ষেপ’, ‘সেনাবাহিনীর বিদ্রোহের সম্ভাবনা’ শীর্ষক শিরোনামে আরো একাধিক অনুচ্ছেদও পাওয়া যায় যেখানে নানা সম্ভাবনা উল্লেখ করা হয়। এছাড়া, কথিত উক্ত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সামনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পথ রয়েছে—একটি হল শান্তিপূর্ণভাবে পরিস্থিতি সমাধান করা এবং অন্যটি হল মার্শাল ল জারি করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ।”

উক্ত প্রতিবেদনেও আলোচিত দাবিটির পক্ষে কথিত একটি চিঠির ছবি ব্যতীত কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণের উল্লেখ করা হয়নি। তাছাড়া, স্বাভাবিকভাবেই জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এমন কোনো চিঠি পাঠানো হলে তা গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার কথা। কিন্তু একাধিক উপায়ে অনুসন্ধান করেও জাতিসংঘের এমন কোনো চিঠি প্রকাশ বা হাসিনার প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে জাতিসংঘ থেকে এমন কোনো নির্দেশনার বিষয়ে গণমাধ্যম কিংবা নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

উক্ত সাইটে দাবিটি প্রকাশে মূলধারার গণমাধ্যম কালের কণ্ঠের লোগো ব্যবহার করা হলেও কালের কণ্ঠ পত্রিকার ওয়েবসাইট এবং প্রিন্ট সংস্করণে সাম্প্রতিক সময়ে উক্ত দাবিতে কোনো সংবাদ প্রকাশের প্রমাণ মেলেনি। ইন্টারনেট আর্কাইভেও এ সংক্রান্ত দাবির কোনো সংবাদ কালের কণ্ঠের ওয়েবসাইটে প্রকাশের তথ্য পাওয়া যায়নি। 

বরং প্রায় এক মাস আগে ২০২৪ সালের ১২ ডিসেম্বরে জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রেস রিলিজ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘ একটি বৈঠকে টেকসই উন্নয়ন এবং এলডিসি থেকে উত্তরণের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে। জাতিসংঘ নির্বাচনী প্রক্রিয়া, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগকে সমর্থন করেছে।

এছাড়া, মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলো’তে গত ১৪ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি বলেন, ‘নির্বাচন কখন হবে, সেটা সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো ঠিক করবে। আমরা সময়সীমা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। আমরা নির্বাচনে শুধু কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দিতে চাই।’” অর্থাৎ, বাংলাদেশের ক্ষমতায় কারা আসবে তা নিয়ে জাতিসংঘ কোনো আদেশ বা নির্দেশ দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেনি বরং, তারা নির্বাচনে সহযোগিতা করার ইচ্ছে জানিয়েছে। যা নির্বাচন ছাড়াই ২৫ দিনের মধ্যে জাতিসংঘ শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করানোর নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষক আলোচিত দাবিটির সাথে সাংঘর্ষিক।

উল্লেখ্য যে, পূর্বেও ব্লগস্পটের বিনামূল্যের ডোমেইন সাইটে কালের কণ্ঠের লোগো ব্যবহার করা এই সাইটটি থেকে একাধিকবার ভুয়া তথ্য প্রচার করলে তা নিয়ে একাধিকবার ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল রিউমর স্ক্যানার টিম।

সুতরাং, সেনাবাহিনীর উপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুশিয়ারি ও হাসিনার প্রত্যাবর্তন বিষয়ে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর কাছে জাতিসংঘ চিঠি পাঠিয়েছে শীর্ষক প্রচারিত দাবি মিথ্যা এবং বানোয়াট।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img