সম্প্রতি ‘৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হচ্ছে সুন্দরবনের বাঘ গণনা’ দাবি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।
যা দাবি করা হচ্ছে
গত ২১ অক্টোবর ফেসবুকে Toji Islam নামক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রকাশিত একটি পোস্টে (আর্কাইভ) দাবি করেন, “৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হচ্ছে সুন্দরবনের বাঘ গণনা।”

একই দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সুন্দরবনে বাঘ গণনায় ৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ের দাবিটি সঠিক নয় বরং বাঘ গণনায় ব্যয় হবে ৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
কি-ওয়ার্ড সার্চ পদ্ধতির মাধ্যমে জাতীয় ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকার “সুন্দরবনের বাঘ গণনা শুরু হচ্ছে ডিসেম্বরে, বরাদ্দ ৩ কোটি টাকা” শীর্ষক শিরোনামে গত ১৮ অক্টোবর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
বন বিভাগের একটি সূত্রের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, “সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয় চলতি বছরের এপ্রিল মাসে। তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। প্রকল্পের একটি অংশে ৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা দিয়ে বাঘ গণনা করা হবে। চলতি অক্টোবর মাস থেকে এই বাঘ গণনা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অর্থ ছাড় না হওয়ায় প্রকল্পটি অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। তবে, গত সপ্তাহে পরিকল্পনা কমিশন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পে ৩ কোটি টাকা ছাড় করতে রাজি হয়েছে। এরপর বন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে কিছু কাজ বাকি রয়েছে। এ দুটি মন্ত্রণালয়ের কাজ শেষ হলেই আগামী ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাঘগণনা শুরু হবে।”

পরবর্তীতে গত ৩১ মার্চ এ বিষয়ে খুলনায় সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে প্রথম আলো’য় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ডঃ আবু নাসের মোহসিন হোসেনের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, “প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এর আওতায় সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ ও সুরক্ষার কাজ করা হবে। এর মধ্যে ৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ করা হবে বাঘ গণনায়। প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয়েছে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত। ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে বাঘ গণনার জন্য বনের বিভিন্ন এলাকায় ২০০টি বিশেষ ক্যাটাগরির ক্যামেরা স্থাপন করা হবে।”,

এ বিষয়ে জানতে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেনের সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানিয়েছেন, “তিন বছরের সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প ৩৫ কোটি টাকা। বাঘ জরিপের জন্য ৬৬ কোটি টাকা উল্লেখ করে প্রচারিত সংবাদটি বানোয়াট, মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক।”
অর্থাৎ, সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় বাঘ গণনা কাজে ব্যয় হবে ৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
খরচ এত বেশি কেন?
বাঘ সংরক্ষণের জন্য নেওয়া আলোচিত প্রকল্পটিতে শুধু যে বাঘ গণনার কাজই হবে, এমন নয়। বাঘ সম্পর্কিত নানান উদ্যোগ বাস্তবায়নের কথা রয়েছে এই প্রকল্পে। ইত্তেফাক বলছে, প্রকল্পের অন্যান্য কাজের মধ্যে রয়েছে, সুন্দরবনের বাঘ যেন লোকালয়ে চলে না আসে, সেজন্য জনবসতি আছে, এমন ৬০ কিলোমিটার এলাকায় নাইলনের বেড়া দেওয়া, ঘূর্ণিঝড় ও উচ্চ জলোচ্ছ্বাসে বাঘ যেন নিরাপদ আশ্রয় পায়, সেজন্য বনের মধ্যে ১২টি মাটির কেল্লা নির্মাণ, সুন্দরবনের যে অংশে আগুন লাগার প্রবণতা বেশি, সেসব জায়গায় দুটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ এবং আগুন লাগলে যাতে তাত্ক্ষণিকভাবে তা নেভানো যায়, সেজন্য যন্ত্রপাতি, পাইপ ও ড্রোন ক্রয়। এ ছাড়া রয়েছে, সুন্দরবনের বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমের ৩৪০ জন সদস্য ও চারটি রেঞ্জের কমিউনিটি প্যাট্রল গ্রুপের ১৮৫ জন সদস্যকে প্রশিক্ষণ প্রদান, পোশাক সরবরাহ ও প্রতি মাসে বনকর্মীদের সঙ্গে মাসিক সভা করা।
গুজবের সূত্রপাত কীভাবে?
মূলধারার গণমাধ্যম Jamuna Tv ইউটিউবে (আর্কাইভ) এবং ফেসবুকে (আর্কাইভ) গত ২৫ মার্চ “অক্টোবরে শুরু সু্ন্দরবনে বাঘ গণনা, ব্যয় হবে ৬৬ কোটি টাকা” শিরোনামে একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বাঘ গণনা প্রকল্পে খরচ হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ না থাকলেও শিরোনামে ৬৬ কোটি ব্যয় হবে বলে জানায় যমুনা টিভি। প্রতিবেদনটি যমুনার ওয়েবসাইটেও প্রকাশিত (আর্কাইভ) হয়। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরই বাঘ গণনায় ৬৬ কোটি ব্যয় হওয়ার দাবিটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
মূলত, অর্থ ছাড় বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজ শেষ হওয়া সাপেক্ষে আগামী ডিসেম্বরে সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হবে। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৬ লাখ টাকা, এর মধ্যে বাঘ গণনায় ব্যয় হবে ৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা। কিন্তু বাঘ গণনায় ৬৬ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে দাবিতে সম্প্রতি ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেনও বিষয়টি রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেছেন।
উল্লেখ্য, বিশ্বের ১৩টি দেশে মাত্র ৩ হাজার ৮৪০টি বাঘ টিকে রয়েছে। ২০১৮ সালের জরিপ মতে, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪টি।
সুতরাং, সুন্দরবনে বাঘ গণনায় ৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ের দাবিটি বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Statement from Dr Abu Naser Mohsin Hossain, Sundarbans West Forest Division.
- Ittefaq: সুন্দরবনের বাঘ গণনা শুরু হচ্ছে ডিসেম্বরে, বরাদ্দ ৩ কোটি টাকা
- Prothom Alo: সুন্দরবনে আবার শুরু হচ্ছে বাঘ গণনা