সম্প্রতি, সনাতন ধর্মীয় দেবদেবীর প্রতিকৃতি সম্বলিত কয়েকটি ধাতব মুদ্রার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, এগুলো ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলের মুদ্রা।

উক্ত দাবিতে বাংলাদেশে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
একই দাবিতে ওপার বাংলায় প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত মুদ্রাগুলো ব্রিটিশ শাসনামলের নয় বরং বিভিন্ন ই-কমার্স সাইটে উক্ত মুদ্রাগুলো পাওয়া যায়; যা বিক্রির উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে আলোচিত মুদ্রাগুলোর অনুরূপ কোনো মুদ্রা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত মুদ্রাগুলোর ছবি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। সেখানে একটি এক আনা এবং একটি দুই আনার মুদ্রার দুই পিঠ দেখা যায়। মুদ্রাগুলোর গায়ে খোদাইকৃত লেখা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এক আনার মুদ্রাটির তারিখ হিসেবে ১৮৩৯ সাল এবং ২ আনার মুদ্রাটির তারিখ হিসেবে ১৮১৮ সালের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজা ৩য় জর্জের শাসনামল ছিল ১৭৬০ সাল থেকে ১৮২০ সাল পর্যন্ত এবং রাণী ভিক্টোরিয়ার শাসনামল ছিল ১৮৩৭ সাল থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত।
আলোচিত মুদ্রাগুলোতে উল্লেখিত সাল (১৮৩৯ ও ১৮১৮) অনুযায়ী এক আনার মুদ্রাটি রাণী ভিক্টোরিয়ার শাসনামলের এবং দুই আনার মুদ্রাটি রাজা ৩য় জর্জের শাসনামলের হওয়ার কথা।
তবে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ব্রিটিশ শাসনামলের মুদ্রা সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ১৮৩৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজা চতুর্থ উইলিয়ামের প্রতিকৃতি সম্বলিত কিছু মুদ্রা চালু করেছিল। ১৮৪০ পরবর্তী সময়কালে জারি করা মুদ্রাগুলোতে রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রতিকৃতি ছিল।

পরবর্তী অনুসন্ধানে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটের ‘কারেন্সি মিউজিয়াম’ সেকশনে গিয়ে রাণী ভিক্টোরিয়ার শাসনামলের মুদ্রাগুলোর ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ছবিগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, সেসময়ের মুদ্রাগুলোর অধিকাংশই ছিল রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জের। উক্ত মুদ্রাগুলোতে রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রতিকৃতি ছিল। তবে সেখানে আলোচিত রামায়ণ থিমের মুদ্রার ছবির অনুরূপ কোনো মুদ্রা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এছাড়া, ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটের ‘কারেন্সি মিউজিয়াম’ সেকশনে গিয়ে রাজা চতুর্থ উইলিয়ামের শাসনামলের মুদ্রাগুলোর ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ছবিগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, সেসময়ের মুদ্রাগুলোর অধিকাংশই ছিল রৌপ্য এবং কপারের। উক্ত মুদ্রাগুলোতে রাজা চতুর্থ উইলিয়ামের প্রতিকৃতি ছিল। তবে সেখানে আলোচিত রামায়ণ থিমের মুদ্রার ছবির অনুরূপ কোনো মুদ্রা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তাছাড়া, ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটের ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ সেকশনে গিয়ে রাজা তৃতীয় জর্জের শাসনামলের কোনো মুদ্রা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে সেখানে উল্লেখিত অন্যান্য রাজাদের শাসনামলে জারিকৃত মুদ্রাগুলোর সাথেও আলোচিত মুদ্রাগুলোর কোনো সাদৃশ্য পাওয়া যায়নি।

এছাড়াও, ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ব্রিটিশ শাসনামল ছাড়াও অন্যান্য সময়ের মুদ্রাগুলো পর্যবেক্ষণ করেও আলোচিত রামায়ণ থিমের মুদ্রাগুলোর অনুরূপ কোনো মুদ্রা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ, ব্রিটিশ শাসনামল বা তার পরবর্তী কোনো সময়ের মুদ্রাতেই আলোচিত মুদ্রাগুলোর অনুরূপ সনাতন ধর্মীয় দেবদেবীর প্রতিকৃতি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভারতের ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’র ওয়েবসাইটে ব্রিটিশ শাসনামলের সময়ের মুদ্রার বিবরণী নিয়ে প্রকাশিত একটি নথি খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে উল্লেখিত মুদ্রার ছবিতেও রামায়ণ থিমের বা সনাতন ধর্মীয় দেবদেবীর প্রতিকৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

এছাড়াও, আলোচিত মুদ্রাগুলো সম্পর্কে ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে দিল্লি ন্যাশনাল মিউজিয়ামের মুখপাত্র সঞ্জিব সিং এর বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে তিনি জানান, সারাবিশ্বে এখন পর্যন্ত হিন্দু দেবদেবীর প্রতিকৃতি সম্বলিত কোনো মুদ্রা থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তাছাড়া রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে ভারতীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ফ্লিপকার্ট (১, ২), অ্যামাজন এবং ই-বে এর ওয়েবসাইটে আলোচিত মুদ্রাগুলোর অনুরূপ কিছু মুদ্রার ছবি পাওয়া যায়; যেগুলো বিক্রির উদ্দেশ্যে দেওয়া।

পরবর্তীতে মুদ্রা বিষয়ক ওয়েবসাইট Coin Quest এ ‘India (East Company) Spiritual Tokens (Counterfeit) 1616 to 1839’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আলোচিত মুদ্রাগুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জারি করা মুদ্রা নয়, সেগুলো মূলত মন্দিরের টোকেন, যা সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটকদের কাছে বিক্রির উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল।
অর্থাৎ, উপরোক্ত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট যে, আলোচিত মুদ্রাগুলো ব্রিটিশ শাসনামলের নয়।
মূলত, সনাতন ধর্মীয় দেবদেবীর প্রতিকৃতি সম্বলিত কয়েকটি ধাতব মুদ্রার ছবি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, সেগুলো ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলের মুদ্রা। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত দাবিটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে আলোচিত মুদ্রাগুলোর অনুরূপ কোনো মুদ্রা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া, বিভিন্ন ই-কমার্স সাইটে উক্ত মুদ্রাগুলো পাওয়া যায়; যা বিক্রির উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও, দিল্লি ন্যাশনাল মিউজিয়ামের মুখপাত্র সঞ্জিব সিং জানান, সারাবিশ্বে এখন পর্যন্ত হিন্দু দেবদেবীর প্রতিকৃতি সম্বলিত কোনো মুদ্রা থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, সনাতন ধর্মীয় দেবদেবীর ছবি সম্বলিত কিছু ধাতব মুদ্রাকে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলের মুদ্রা দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Federal Reserve Bank of India (1): https://m.rbi.org.in//Scripts/restrospectcoins.aspx
- Federal Reserve Bank of India (2): https://m.rbi.org.in//Scripts/mc_british_QueenVictoria.aspx
- Federal Reserve Bank of India (3): https://m.rbi.org.in//Scripts/mc_british_WilliamIV.aspx
- The Royal Family, UK: George III (r. 1760-1820)
- The Royal Family, UK: William IV (r. 1830-1837)
- The Royal Family, UK: Victoria (r. 1837-1901)
- Archeological Survey of India: https://ignca.gov.in/Asi_data/23336.pdf
- India Today: Did East India Company issue coins with Hindi Gods?
- Flipcart (1): https://dl.flipkart.com/s/0j1fjRNNNN
- Flipcart (2): https://www.flipkart.com/ank-ukl-two-anna-lord-hanuman-ramdarbaar-back-medieval-coin-collection/p/itm37394325b6fc2
- Amazon: https://www.amazon.in/Copper-Darbar-Antique-Vintage-Second/dp/B07D7WSLD5
- E-Bay: https://www.ebay.com/itm/155608153979
- Coin Quest: India (East Company) Spiritual Tokens (Counterfeit) 1616 to 1839
- Rumor Scanner’s Own Analysis