ডুবন্ত দ্বারকা নগরীর শ্রী কৃষ্ণের মন্দিরের ভিডিওটি থ্রিডি অ্যানিমেশনে তৈরী

সম্প্রতি, ভারতে ডুবন্ত প্রাচীন দ্বারকা নগরীর শ্রীকৃষ্ণের মন্দির দাবিতে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে। 

Screenshot from Facebook 

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এবং এখানে (আর্কাইভ)।

একই দাবিতে ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, পানির নিচে ডুবন্ত দ্বারকা নগরীতে শ্রীকৃষ্ণের মন্দির দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি বাস্তব নয় বরং শ্রীরাম নামের একজন আর্টিস্ট প্রাচীন দ্বারকা নগরী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই থ্রিডি অ্যানিমেটেড ভিডিওটি তৈরি করেছেন। 

অনুসন্ধান যেভাবে এগিয়েছে

প্রথমত, ইন্টারনেটে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটির সত্যতা অনুসন্ধানে, প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে বাস্তবে পানির নিচে ডুবন্ত প্রাচীন দ্বারকা নগরীতে শ্রীকৃষ্ণের মন্দির পাওয়া গিয়েছিল কিনা সে বিষয়ে জানতে আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় গণমাধ্যম এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোতে অনুসন্ধান করে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

পরবর্তীতে ভাইরাল ভিডিওটির মূল উৎস অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে Lost Temple নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে গত ৩১ মার্চ পোস্ট করা একটি রিল ভিডিও খুঁজে পায় রিউমর স্ক্যানার টিম। 

ভিডিওর ক্যাপশনে বলা হয়, উক্ত ভিডিওটি জলের নিচে ডুবন্ত প্রাচীন দ্বারকা শহর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে থ্রিডি অ্যানিমেশন প্রযুক্তিতে তৈরি এবং ভিডিওটি @artz_by_ram নামক একটা ইন্সটাগ্রাম আইডি থেকে নেওয়া হয়।

Screenshot from Facebook

পরবর্তীতে উক্ত তথ্যের সূত্র ধরে artz by ram নামের ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্টে গত ২০ মার্চ প্রকাশিত মূল ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়।

উক্ত ভিডিওর ক্যাপশন থেকে জানা যায়, এটি কোনো বাস্তব ভিডিও নয় বরং পানির নিচে ডুবন্ত প্রাচীন দ্বারকা নগরীর উপর ভিত্তি করে এই থ্রিডি ভিডিওটি বানানো হয়েছে।

Screenshot from Instagram

উক্ত ইন্সটাগ্রাম আইডির প্রোফাইল থেকে জানা যায়, শ্রীরাম একজন আর্টিস্ট যিনি মূলত ডিজিটাল পোট্রেট ও থ্রিডি মডেল নিয়ে কাজ করে থাকেন।

Screenshot from Instagram 

তার ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, শ্রীরাম নিয়মিতই এই ধরনের আর্টওয়ার্কের ভিডিও আপলোড করে থাকেন। 

Screenshot from Instagram
দ্বারকা নগরীর পরিচিতি

ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ১৫ জানুয়ারি “Dwarka: India’s submerged ancient city” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের সাতটি পবিত্র তীর্থস্থানের একটি, দ্বারকা শহরটি কেবল ধর্মীয়ভাবেই নয় বরং প্রত্নতাত্ত্বিক দিক বিবেচনায়ও সমান গুরুত্বপূর্ণ। 

মহাকাব্য মহাভারতে কৃষ্ণের প্রাচীন রাজ্য হিসাবে এই শহরটির উল্লেখ করা হয়েছে, যা প্রায় ৮৪ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে একটি সুরক্ষিত শহর হিসেবে বিস্তৃত ছিল, যেখানে গোমতী নদী এবং আরব সাগর মিলিত হয়েছে। পাঠ্য অনুসারে, কৃষ্ণের মৃত্যুর পর প্রাচীন শহরটি আরব সাগরের নীচে তলিয়ে যায়। 

Screenshot Source: BBC

বিবিসি’র প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, প্রত্নতাত্ত্বিকরা আধুনিক দ্বারকার উপকূলে ডুবে যাওয়া শহরের প্রকৃত প্রমাণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন।

ফলস্বরূপ, পাথরের খন্ড এবং স্তম্ভের মতো অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু পানির নিচে আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে এই প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুগুলোর সঠিক বয়স নিয়ে এখনও বিতর্ক চলমান রয়েছে। 

Screenshot Source: BBC

তাছাড়া, জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (UNESCO) কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতীয় শহর দ্বারকা হিন্দু সংস্কৃতিতে কৃষ্ণের মহান এবং সুন্দর শহর হিসেবে পরিচিত।

হিন্দু পুরাণে বলা হয়েছে যে, কৃষ্ণ যখন আধ্যাত্মিক জগতে যোগদানের জন্য পৃথিবী ত্যাগ করেছিলেন, তখন কলির যুগ শুরু হয়েছিল এবং দ্বারকা এবং এর বাসিন্দারা সমুদ্র দ্বারা নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিলো। 

আধুনিক দ্বারকা শহর আজ হিন্দু ধর্মের সাতটি পবিত্র শহরের একটি, প্রতি বছর তীর্থযাত্রীরা কৃষ্ণের উপাসনা করে। দ্বারকা নগরীর নিমজ্জিত অংশের খোঁজ ১৯৩০-এর দশকে শুরু হয়েছিল, এবং প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ১৯৬৩ সালে সংঘটিত হয়েছিল। তৎকালীন সময়ের উক্ত খননে অনেক প্রাচীন প্রত্নবস্তু পাওয়া গিয়েছিল, সেইসাথে পানির নিচে কাজ করা প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দলের নেতৃত্বে পরবর্তী খননের সময় প্রাচীন দ্বারকার নিমজ্জিত অংশের অবশেষ পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রাচীন দ্বারকা শহরের একটি সুরক্ষিত ভিত্তি আবিষ্কার করেছিলেন যা নির্দেশ করে যে, প্রাচীন শহরের প্রাচীরগুলি অবশ্যই নদীর তীরে নির্মিত হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকদের খননে পাওয়া গিয়েছিল বিভিন্ন নির্মাণ, স্তম্ভ এবং সেচ ব্যবস্থার জন্য ব্যবহৃত পাথরের খন্ড। তবে ইউনেস্কোর প্রতিবেদনেও উল্লেখ রয়েছে, প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুগুলোর বয়সের ব্যাপারে বিতর্ক রয়েছে। 

Screenshot Source: UNESCO

মূলত, শ্রীরাম নামের একজন আর্টিস্ট প্রাচীন দ্বারকা নগরী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শ্রী কৃষ্ণের মন্দিরের একটি থ্রিডি এনিমেশন ভিডিও তৈরী করেন। উক্ত ভিডিওটিকেই সম্প্রতি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া বেশ কিছু পোস্টে, মূল ভিডিওটি যে বাস্তব নয় তা উল্লেখ না করেই পানির নিচে ডুবন্ত দ্বারকা নগরীতে শ্রীকৃষ্ণের মন্দিরের ভিডিও দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।  

প্রসঙ্গত, পূর্বে কক্সবাজার রেল স্টেশনের থ্রিডি অ্যানিমেটেড ছবি বাস্তব দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত হলে সে ব্যাপারে ফ্যাক্টচেক আর্টিকেল প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। পড়ুন এখানে

সুতরাং প্রাচীন দ্বারকা নগরীর শ্রী কৃষ্ণের মন্দিরের একটি থ্রিডি অ্যানিমেটেড ভিডিওকে বাস্তব দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে; যা বিভ্রান্তিকর।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img