ভিডিওটি পুলিশ কর্তৃক ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনার নয়

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বিএনপির ডাকা ও হরতাল অবরোধের সময় বেশ কয়েকটি স্থানে দুর্বৃত্তদের দ্বারা ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। গত ০১ নভেম্বরও বিএনপির অবরোধ চলাকালে পাবনার ঈশ্বরদী রেল জংশনের কাছে মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনকে লক্ষ্য করে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা দেশি বোমা নিক্ষেপ করে। এই ঘটনার পরপর সেদিন ইন্টারনেটে একটি ভিডিও প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। 

পাবনা জেলা প্রচার দল – Bnpp নামের একটি পেজ থেকে প্রচারিত ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, দুইজন পুলিশ সদস্য হাতে থাকা একটি বোতল ও কিছু তরল জাতীয় পদার্থ সম্বলিত পলিথিন নিয়ে রেল লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশে আরো দুই ব্যক্তি এবং রেলওয়ের একজন গার্ডকে দেখা যাচ্ছে৷ পাঁচ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের ভিডিওটি পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, “পেট্রোল বোমা কারা মারে এবার দেখে নিন, মৈত্রী ট্রেনে পেট্রোল বোমা হামলার নাটক।”

ট্রেনে আগুন

এই ভিডিওটি এখন অবধি ২১ লক্ষাধিক বার দেখা হয়েছে, শেয়ার করা হয়েছে ২৭ হাজারেরও বেশি। এছাড়া, পোস্টটিতে প্রায় ৫০ হাজার পৃথক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে। ভাইরাল পোস্টটির মন্তব্যঘর ঘুরে পোস্টটির দাবির প্রেক্ষিতে অধিকাংশ নেটিজেনকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যায়। ভিডিওটি দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। 

সেসময় ভিডিওটি আরও একাধিক পেজ এবং অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়। দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

চলতি মাসেও ভিডিওটি সমজাতীয় দাবিতে ফের ইন্টারনেটে ছড়াতে শুরু করেছে। 

এ সংক্রান্ত ফেসবুকের কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

একই ভিডিও টিকটকে দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভাইরাল ভিডিওটি পুলিশ কর্তৃক ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনার নয় বরং গত ০১ নভেম্বর পাবনায় মৈত্রী ট্রেনে বোমা নিক্ষেপের ঘটনা পরবর্তী সময়ে ঘটনাস্থল থেকে জব্দকৃত আলামত পুলিশের হাতে দেখা যাওয়ার দৃশ্যকে উক্ত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে গত ০১ নভেম্বর উক্ত দাবিতে প্রকাশিত ভাইরাল পোস্টটি বিশ্লেষণ করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। ভিডিওটির ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে কোনো স্থান এবং উপস্থিত ব্যক্তিদের পোশাক থেকে তাদের পরিচয় সনাক্ত করা সম্ভব না হওয়ায় ভিডিওটির ক্যাপশনের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করেছি আমরা। 

ক্যাপশনে মৈত্রী ট্রেনে হামলার তথ্যের সূত্রে সেদিন দেশের একাধিক গণমাধ্যমে (, , ) পাবনার ঈশ্বরদী রেল জংশনের কাছে মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে হামলার একটি খবর নজরে আসে আমাদের। 

খবরে বলা হয়, বিএনপির তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে সেদিন  দুপুরে পাবনার ঈশ্বরদী জংশন ও বাইপাস স্টেশনের মাঝামাঝি লোকোশেড এলাকায় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে ট্রেনের জানালার কাচ ভেঙেছে। তবে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

গণমাধ্যমকে সেসময় ঈশ্বরদী রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারুনুজ্জামান রুমেল বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে একটি বোতল ও ভেতরে পেট্রল জাতীয় কিছু পদার্থ জব্দ করা হয়েছে।’

একই তথ্য দিয়েছেন পাকশী রেলওয়ে জোনের পুলিশ সুপার সাহাবউদ্দীন।

এ বিষয়ে ফেসবুকের দুইটি পেজে সেদিন একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়। দুইটি ভিডিওতেই (, ) ভাইরাল ভিডিওর ক্লিপটি খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot collage: Rumor Scanner 

আরেকটি ভিডিওতে একজন পুলিশের হাতে উক্ত আলামতগুলো দেখা যায়। ভিডিও ধারণকারী ব্যক্তির জিজ্ঞাসার জবাবে তাকে জানানো হয়, এগুলো পেট্রোল বোমা। 

অর্থাৎ, পুলিশ যেসব আলামত জব্দের কথা বলছে তা থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয়ে যে, ভাইরাল ভিডিওতে পুলিশের হাতে থাকা বস্তুগুলোই এসব আলামত। 

মূলত, সম্প্রতি দেশে বিএনপির ডাকা ও হরতাল অবরোধের সময় বেশ কয়েকটি স্থানে দুর্বৃত্তদের দ্বারা ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এরই প্রেক্ষিতে ইন্টারনেটে একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, পুলিশই ট্রেনে আগুন লাগিয়েছে। ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, দুইজন পুলিশ সদস্য হাতে থাকা একটি বোতল ও কিছু তরল জাতীয় পদার্থ সম্বলিত পলিথিন নিয়ে রেল লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, পুলিশ কর্তৃক মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন লাগানোর এই দাবিটি সঠিক নয়৷ প্রকৃতপক্ষে, গত ০১ নভেম্বর বিএনপির অবরোধ চলাকালে পাবনার ঈশ্বরদী রেল জংশনের কাছে মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনকে লক্ষ্য করে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা দেশি বোমা নিক্ষেপ করে। দুর্বৃত্তদের ঐ হামলার পর পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়ে কিছু আলামত জব্দ করে। ঘটনাস্থলে পুলিশের হাতে থাকা সেসব আলামতের ভিডিও সেসময় গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হয়। যা সেসময় এবং পরবর্তীতে সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ কর্তৃক ট্রেনে আগুন ধরানোর দৃশ্য দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, পূর্বে টিয়ার শেলের ঝাঁঝের তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে পুলিশ ও সাংবাদিকের চেষ্টাকে বিএনপির ডাকা ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সংগঠিত সংঘর্ষে পুলিশ ও সাংবাদিক মিলে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার দৃশ্য দাবিতে ইন্টারনেটে একটি ভিডিও প্রচার করা হলে এ বিষয়ে ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার। 

সুতরাং, গত নভেম্বরে ট্রেনে দুর্বৃত্তদের হামলার ঘটনার পর পুলিশের জব্দকৃত আলামত পুলিশের হাতে থাকাকালীন ধারণকৃত ভিডিওকে পুলিশ কর্তৃক ট্রেনে আগুন দেওয়ার ভিডিও দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img