৬০ হাজার বছর পর একসাথে চাঁদ তারা দেখা যাওয়ার দাবিটি মিথ্যা 

গত ২৪ মার্চ, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আকাশে চাঁদের নিচে শুক্র গ্রহ দেখা যাওয়াকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যম ও ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে বেশকিছু বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়তে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। এর মধ্যে একটি দাবি ছিল, আলোচিত এই দৃশ্য ৬০ হাজার বছর পর পর দেখা যায়।  কেউ কেউ এই দৃশ্য ৬০ বছর পর দেখা যাবে বলেও দাবি করেছেন।

Screenshot source:Facebook 
Screenshot source:Facebook 

উক্ত দাবিতে ছড়িয়ে পড়া কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

গণমাধ্যমে যেভাবে উপস্থাপন 

জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাক এ বিষয়ে ২৪ মার্চের এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, চাঁদের নিচে দেখা যাওয়ার বস্তুটি তারা। 

Screenshot source: Ittefaq 

একই দাবিতে সংবাদ প্রকাশ করেছে মূলধারার সংবাদমাধ্যম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ঢাকা পোস্ট, দৈনিক আমাদের সময়ঢাকা প্রকাশ। 

অনলাইন সংবাদমাধ্যম ঢাকা পোস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমানের বক্তব্য নিয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, “পৃথিবীর সব কিছুরই কোনো না কোনো কারণ আছে। আজকে যে চাঁদের নিচে তারা দেখা গেছে, এটার পেছনে অবশ্যই সায়েন্স কাজ করছে। তবে ঠিক কী কারণে এ রকম দেখা যাচ্ছে সেটা বিজ্ঞানীরা আজও খুঁজে পাইনি।”

Screenshot source: Dhaka Post

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘news18’, দাবি করেছে, চাঁদ ও শুক্রের অবস্থানে এমন দৃশ্য আকাশে ১০০ বছরে আর দেখা যাবে না। 

Screenshot source: news18

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ৬০ হাজার বছর পর চাঁদ তারা একসাথে দেখা যাওয়ার দাবিটি সঠিক নয় বরং চাঁদের সাথে মূলত শুক্র গ্রহকে দেখা গেছে এবং উক্ত দৃশ্য বিরল নয়, চাঁদ ও শুক্র গ্রহের দ্বারা তৈরি হওয়া এমন দৃশ্য কয়েক মাস পর পরই দেখা যায়।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে মহাকাশ বিষয়ক ওয়েবসাইট Space এ গত ২৩ মার্চ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চাঁদ এবং শুক্রগ্রহ সেদিন (২৩ মার্চ) সূর্যাস্ত পরবর্তী সময়ে চোখ জুড়ানো দৃশ্যের জন্ম দেবে। পরদিন (২৪ মার্চ) সন্ধ্যায় এরা অবস্থান পরিবর্তন করবে। সেই রাতে, সামান্য প্রশস্ত চাঁদ শুক্রের উপরে এবং সামান্য বাম দিকে ভালভাবে ঘোরাফেরা করবে।

Screenshot source: Space

স্পেসের প্রতিবেদনে বলা নয়, অবশ্যই আমরা যা দেখতে পাব তা একটি দৃষ্টিভঙ্গির বিভ্রম। চাঁদ পৃথিবী থেকে ২৩৩,৪০০ মাইল (৩৭৫,৭০০ কিমি) দূরে, যেখানে শুক্র গ্রহের দূরত্ব ১১৫ মিলিয়ন মাইল (১৮৫ মিলিয়ন কিমি)। অর্থাৎ, চাঁদের তুলনায় শুক্র গ্রহ পৃথিবী থেকে ৪৯২ গুণ বেশি দূরে। 

স্পেস লিখেছে, ২৩ মার্চ চাঁদ শুক্র এর প্রায় সরাসরি নীচে এবং ২৪ মার্চ প্রায় সরাসরি উপরে দেখাবে। পরে গোধূলিতে শুক্র স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়। 

এটি কোনো বিরল কোনো দৃশ্য কিনা এমন কোনো তথ্য উল্লেখ না থাকলেও স্পেস এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চাঁদ এবং শুক্র গ্রহকে আবার একসাথে দেখার পরবর্তী সুযোগ মিলবে ২৩ এপ্রিল।

Screenshot source: Space

স্পেস এর প্রতিবেদনটি লিখেছেন জো রাও (Joe Rao), যিনি একাধারে আবহাওয়াবিদ এবং স্কাইওয়াচিং কলামিস্ট হিসেবে বেশ পরিচিত। 

রিউমর স্ক্যানার টিমের পক্ষ থেকে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম জো রাও এর সাথে। তিনি বলছিলেন, “শুক্র গ্রহ মাসিক ভিত্তিতে চাঁদের সাথে একত্রিত হয়। কানাডার রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির ২০২৩ অবজারভারস হ্যান্ডবুক অনুসারে, পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে ২৩ এপ্রিল, ২৩ মে এবং ২১ জুন এদের ফের একত্রিত হতে দেখা যাবে।”

জো রাও রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “গড়ে প্রতি ৩১ বছরে চাঁদের অর্ধাংশ শুক্রকে পুরোপুরি ঢেকে দেয়। চাঁদ এবং শুক্র সাধারণত মাসিক ভিত্তিতে একে অপরের সাথে মিলিত হবে। এর মধ্যে কয়েকটি ঘটনায় এরা অতটা কাছাকাছি আসে না, তবে সেটিও এই ধরনের (২৪ মার্চের ঘটনা) ঘটনার মতো দৃষ্টিনন্দন হয়।”

জো রাও বলছিলেন, আলোচিত দৃশ্যটি দেখার জন্য ৬০ হাজার বছর অপেক্ষা করার যে বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে তা একেবারেই বানোয়াট।

নাসা কী বলছে?

মহাকাশ গবেষণা বিষয়ে বিশ্বের অন্যতম নির্ভরযোগ্য মার্কিন সংস্থা নাসার ওয়েবসাইটে গত ২৫ মার্চ প্রকাশিত একটি ছবিতে আকাশে চাঁদের উপরে শুক্র গ্রহ দেখা যায়। ২৩ মার্চ ইতালি থেকে ছবিটি তোলা হয়। নাসা লিখেছে, ২৪ মার্চ কিছু স্থান থেকে চাঁদকে শুক্র গ্রহের নিকট দিয়ে যেতে দেখা যাবে। এ সময় শুক্র চাঁদের আড়ালেও পড়ে যেতে পারে। 

Screenshot source: Nasa

তবে নাসার সাইটে এটি বিরল দৃশ্য কিনা বা এই ঘটনা ৬০ হাজার বছর পর পর ঘটে কিনা সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। 

এ বিষয়ে জানতে তাই রিউমর স্ক্যানার টিমের পক্ষ থেকে আমরা নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের (NASA Goddard Space Flight Center) সোলার সিস্টেম এক্সপ্লোরেশন ডিভিশনের ডিজিটাল মিডিয়া লিড ‘মলি এল ওয়াসের’ (Molly L. Wasser) এর সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। 

মলি এল ওয়াসের রিউমর স্ক্যানারকে জানিয়েছেন, “চাঁদের সাথে তারা দেখা যাওয়ার যে দাবির কথা বলা হচ্ছে সেটি মূলত শুক্র গ্রহ এবং এটি কোনো বিরল ঘটনা নয়।”

মলি জানালেন, “চাঁদ এবং শুক্র নিয়মিত আকাশে মিলিত হয় যখন শুক্র সকাল বা সন্ধ্যার আকাশে দিগন্তের উপরে থাকে। চাঁদের কক্ষপথ বরাবর শুক্র দৃশ্যমান হলে প্রতি মাসে কয়েক দিনের মধ্যে চাঁদকে শুক্রকে অতিক্রম করতে দেখা যায়। তাই শুক্র যদি দিগন্তের উপরে দৃশ্যমান হয়, চাঁদ মাসিক ভিত্তিতে এর কাছাকাছি দৃশ্যমান হয়। কিছু পন্থা অবশ্যই অন্যদের তুলনায় কাছাকাছি এবং পর্যবেক্ষণ করা আরও উত্তেজনাপূর্ণ।”

অর্থাৎ, চাঁদ ও শুক্র গ্রহের এক সাথে দেখা যাওয়াটা বিরল কোনো ঘটনা নয় এবং ৬০ হাজার বছর পর পর এই দৃশ্য দেখা যাওয়ার দাবিটিও সঠিক নয়। 

মূলত, গত ২৪ মার্চ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আকাশে চাঁদের নিচে শুক্র গ্রহ দেখা যাওয়াকে কেন্দ্র করে আলোচিত দৃশ্যটিকে বিরল, শুক্র গ্রহকে তারা এবং আবার ৬০ হাজার বছর পর এই দৃশ্য দেখা যাবে শীর্ষক একটি দাবি ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়, দৃশ্যটি মোটেও বিরল কোনো ঘটনা নয়। নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের এক কর্মকর্তা রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেছেন, চাঁদের সাথে যাকে দেখা গিয়েছে তা শুক্র গ্রহ এবং চাঁদ ও শুক্র গ্রহের দ্বারা তৈরি হওয়া এমন দৃশ্য কয়েক মাস পর পরই দেখা যায়। কিছু দৃশ্য দৃষ্টিনন্দন বলে এগুলো নিয়ে আলোচনা বেশি হয়। 

উল্লেখ্য, একই ঘটনায় রাসূলের (সাঃ) নাম উদ্ধৃত করে কিয়ামত বিষয়ে দুইটি হাদিস ফেসবুকে প্রচার করা হলে উক্ত বিষয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।

সুতরাং, সম্প্রতি চাঁদ শুক্র গ্রহ একসাথে দেখা যাওয়ার প্রেক্ষিতে উক্ত দৃশ্য ৬০ হাজার বছর পর আবার দেখা যাবে শীর্ষক একটি দাবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img