কাক দ্বিতীয়বার জোড়া বাঁধে না শীর্ষক দাবিটির সত্যতা কতটুকু?

বেশ কয়েক বছর যাবত, “কাক দ্বিতীয়বার জোড়া বাঁধেনা” শীর্ষক একটি দাবি একটি ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে। 

দাবি করা হচ্ছে, কাক একমাত্র প্রাণী যে কিনা সঙ্গী হারানোর শোক কখনো কাটিয়ে উঠতে পারে না এবং সেইসাথে কাক এটাও জানে দ্বিতীয়বার যে আসে সে ভালোবেসে আসে না, বিপদে পড়ে আসে। তখন সবকিছু থাকলেও ভালোবাসা থাকে না।  

Screenshot from Facebook

সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এবং এখানে (আর্কাইভ)। 
২০২২ সালে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এবং এখানে (আর্কাইভ)। 
২০২১ সালে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এবং এখানে (আর্কাইভ)।
২০২০ সালে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে

একই দাবিতে টিকটকের একটি ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

একই দাবিতে ইউটিউবের ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, কাক দ্বিতীয়বার জোড়া না বাঁধা শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয় বরং কাক তার জীবনকালে একবার জোড়া বাধঁলেও বিশেষ ক্ষেত্রে যদি তার সঙ্গী মারা যায় অথবা বাচ্চা উৎপাদনে অক্ষম হয় তাহলে একটি কাক দুই বা ততোধিকবার জোড়া বাঁধতে পারে। 

স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট WebMD এর তথ্যমতে, একাধিক সঙ্গীর পরিবর্তে, একই সাথে কেবল একজন সঙ্গীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করাকে মনোগ্যামি বলে। একটি মনোগ্যামাস সম্পর্ক হতে পারে শারীরিক অথবা আবেগপূর্ণ। তবে এটি সচরাচর আবেগ এবং শারীরিক চাহিদা উভয়ের সমন্বয়েই গড়ে উঠে। 

 Screenshot Source: WebMD

মার্কিন সরকারি সংস্থা ‘National Science Foundation’ কর্তৃক “Animal Attraction: The Many Forms of Monogamy in the Animal Kingdom” শিরোনামে প্রকাশিত একটি নিউজে বলা হয়, ডিএনএ ফিঙ্গার প্রিন্টিংয়ের আবির্ভাবের পূর্বে, বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে প্রায় ৯০ শতাংশ পাখির প্রজাতি প্রকৃত অর্থে একগামী (Monogamous) ছিল। কিন্তু Paternity Testing এর মাধ্যমে দেখা যায় বিজ্ঞানীদের এই ধারণা সত্য নয় বরং ৯০ শতাংশ পাখি কেবল সামাজিকভাবেই মনোগ্যামাস। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে জিনগতভাবে কেবল ১০ শতাংশ পাখিই মনোগ্যামাস হয়ে থাকে। 

Screenshot Source: National Science Foundation

কাক কি দ্বিতীয়বার জোড়া বাঁধে?

কাক নিয়ে করা গবেষণা ভিত্তিক ওয়েবসাইট Corvid Research কর্তৃক প্রকাশিত একটি ব্লগে বলা হয়, কাক সামাজিকভাবে মনোগ্যামাস হলেও সেক্সুয়ালি এবং জেনেটিক্যালি মনোগ্যামাস নয়। যৌন সম্পর্ক স্থাপনকারী কাকের জোড়া সাধারণত একসাথে থাকলেও অঞ্চলভেদে বিভিন্ন কাককে এক সঙ্গীর সাথে থাকাকালীন সময়ে অঞ্চলভেদে অন্যান্য কাকের সাথেও মিলিত হতে দেখা গেছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে বসবাসকারী কাকদের ক্ষেত্রে ৮২ শতাংশ শিশু কাকের জন্ম সঙ্গী পুরুষ কাকের সাথে মিলনের মাধ্যমে হলেও বাকি ১৮ শতাংশ শিশু কাক অন্য কাকের সাথে মিলনের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে। 

আবার আরেকটি পৃথক গবেষণায় দেখা যায়, ২৫ টি কাক পরিবারের মধ্যে ৩৬ শতাংশ কাক সঙ্গী থাকা সত্ত্বেও অন্য কাকের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেছে এবং জন্ম নেয়া ১৬ শতাংশ কাকের পিতা তাদের মায়ের স্থায়ী সঙ্গী নয়।  

যাইহোক, এটা পরিষ্কার নয় যে স্ত্রী কাকেরা অন্য পুরুষ কাকের সাথে আসলেই সেচ্ছায় সঙ্গম করার চেষ্টা করেছিল কিনা। তবে বেশিরভাগ তথ্য থেকে বোঝা যায় যে  অতিরিক্ত সঙ্গী কাকের উপর স্ত্রী কাকদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। 

তবে যদি পুরুষ সঙ্গী কাকের সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা কোনো কারণে কমে যায়, তখন স্ত্রী কাক অন্য কাকের শুক্রাণু দ্বারা নিজের শুক্রাণু নিষিক্ত করে; যদিও এটা খুবই কম সমর্থিত। 

Screenshot Source: Corvid Research

তাছাড়া, পাখি বিষয়ক ওয়েবসাইট Bird Fact কর্তৃক “Do Crows Mate For Life?” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত আর্টিকেলে বলা হয়, বেশিরভাগ কাকই সারাজীবনের জন্য একটি সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। এরা একটি সঙ্গী পাখির সাথে দৃঢ় বন্ধন তৈরি করে এবং বছরের পর বছর একসাথে থেকে বাচ্চাদের বড় করে। তবে,কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, তারা অন্যান্য পুরুষ কাকের সাথেও সঙ্গম করে। 

Screenshot Source: Bird Fact

তাছাড়া পাখি বিষয়ক আরেক ওয়েবসাইট Bird Watching Buzz  কর্তৃক প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে বলা হয়, যদিও কাক মনোগ্যামাস তারপরেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরা নিজেদের সঙ্গীকে ত্যাগ করতে পারে। 

এর কারণ হচ্ছে, জনসংখ্যা বজায় রাখার জন্য কাকদের প্রজনন করতে হয়। তাই, বাসায় থাকা অবস্থায় অথবা বাসায় থাকা বাচ্চারা সদ্য উড়তে শুরু করলে স্ত্রী কাক অন্যান্য পুরুষের সাথে সঙ্গম করে।

কিছু পাখিরা অবিশ্বাসের কারণেও অনেক সময় নিজেদের সঙ্গী পরিবর্তন করে থাকে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বিচ্ছেদ হয়ে নতুন সঙ্গী খুঁজে পাওয়ার পরিবর্তে একসাথে থেকে একাধিক পাখির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। গড়ে একটি কাক তার জীবদ্দশায় তিন থেকে পাঁচটি অংশীদারের সাথে সঙ্গম করে। 

Screenshot Source: Bird Watching Buzz 

একই আর্টিকেলে উল্লেখ রয়েছে, যদিও কাক তাদের সঙ্গীর সাথে একটি শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন তৈরি করতে পারে, তবে তারা প্রকৃত অর্থে মনোগ্যামাস নয়। সঙ্গী কাক মারা গেলে বা অদৃশ্য হয়ে গেলে কাক নিজেদের নতুন সঙ্গী বেছে নেয়। 

কখনও কখনও সঙ্গী কাক মারা গেলে বেঁচে থাকা কাক একই লিঙ্গের অন্য সঙ্গী খুঁজে বের করে, যাতে তারা বাচ্চা পাখিদের একসাথে বড় করতে পারে।

Screenshot Source: Bird Watching Buzz 

অর্থাৎ সমস্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ক্ষেত্রবিশেষে কাকেরাও একাধিকবার জোড়া বাঁধতে পারে। 

মূলত, গেল কয়েক বছর ধরে কাক দ্বিতীয়বার জোড়া বাঁধেনা” শীর্ষক একটি দাবি একটি ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসলেও অনুসন্ধানে জানা যায়, দাবিটি সঠিক নয়। কাক সাধারণ ভাবে জীবনে একবার জোড় বাঁধলেও নিজেদের সঙ্গী মারা গেলে বা হারিয়ে গেলে বিশেষ ক্ষেত্রে তারা দ্বিতীয় কিংবা একের অধিক বার জোড় বাঁধতে পারে। এমনকি কখনো কখনো এরা মূল সঙ্গীকে ছেড়ে না দিয়ে একই সাথে একের অধিক সঙ্গীর সাথেও মিলিত হয়। 

সুতরাং, কাক তার জীবনকালে একের অধিক সঙ্গীর সাথে জোড়া বাঁধার তথ্যকে কাক দ্বিতীয়বার জোড়া বাঁধেনা শীর্ষক দাবিতে প্রচার হয়ে আসছে; যা বিভ্রান্তিকর। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img