০৬ এপ্রিল পৃথিবীতে বিমানের আকারের কোনো গ্রহাণু আঘাত হানবে না

সম্প্রতি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিমানের আকারের গ্রহাণু পৃথিবীতে ধেয়ে আসছে শীর্ষক একটি দাবি ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু পোস্টে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার বরাত দিয়ে দাবি করা হয়েছে, উক্ত গ্রহাণুটি ০৬ এপ্রিল পৃথিবীতে আঘাত হানবে বা আছড়ে পড়বে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। উক্ত পোস্টগুলোর আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে,এখানে, এখানে  এবং এখানে। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, নাসা ০৬ এপ্রিল বিশাল গ্রহাণু পৃথিবীতে সরাসরি আঘাত হানবে শীর্ষক কোনো মন্তব্য করেনি বরং একটি গ্রহাণু সম্পর্কে ফেসবুকে এবং গণমাধ্যমে অতিরঞ্জিত তথ্য উপস্থাপন করার ফলে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। 

গুজবের সূত্রপাত 

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ০৪ এপ্রিল দেশীয় গণমাধ্যম বাংলাভিশন এর ফেসবুক পেজে “বিমানের আকারের গ্রহাণু ধেয়ে আসছে পৃথিবীতে, ৬ এপ্রিল বড় ঘটনার ইঙ্গিত নাসা’র” শীর্ষক শিরোনামে একটি পোস্ট (আর্কাইভ) করার পর থেকেই তা মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

Screenshot source: Facebook 

বাংলাভিশনের এ সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রতিবেদনের (আর্কাইভ) শুরুতে দাবি করা হয়, “সম্প্রতি ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NASA) এর জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি জানিয়েছে, আগামী দিনে পৃথিবীতে এক বিশাল গ্রহাণু আছড়ে পড়বে।” কিন্তু বিস্তর অনুসন্ধান করেও নাসা এই ধরনের কথা বলেছে কিনা তার কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তবে বাংলাভিশনের প্রতিবেদনের শেষ অংশে দাবি করা হয় “তবে নাসার বিজ্ঞানীরা আশ্বস্ত করেছেন, দেড়শ ফুটের এই গ্রহাণুর দ্বারা পৃথিবীর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত নেই।”

Screenshot source: Facebook

অর্থাৎ, বাংলাভিশন তাদের ফেসবুক পেজের পোস্টে আলোচিত গ্রহাণুর আছড়ে পড়াকে বড় ঘটনার ইঙ্গিত বলে দাবি করলেও বিস্তারিত প্রতিবেদনে গণমাধ্যমটি এই গ্রহাণুর দ্বারা পৃথিবীর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে।  

পৃথিবীতে গ্রহাণু আছড়ে পড়বে দাবিতে উক্ত সংবাদটি পরিবেশনের কারণে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। আর এই বিভ্রান্তি এবং আতঙ্কের নমুনা উক্ত পোস্টের কমেন্ট সেকশনেই লক্ষ্য করা যায়।

Screenshot collage: Rumor Scanner  

গ্রহাণুটির বিষয়ে কী জানা গেছে? 

প্রতিনিয়তই ছোট-বড় গ্রহাণু পৃথিবীর  কক্ষপথের খুব কাছ দিয়ে ঘেঁষে যায় আর বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা পৃথিবীর কক্ষপথের কাছ দিয়ে যায় এমন গ্রহাণুগুলোকে প্রতিনিয়তই ট্র‍্যাক করে থাকে। 

এদের মধ্যে নাসার অ্যাসটেরয়েড ওয়াচ ড্যাশবোর্ড (NASA’s Asteroid Watch Dashboard) ভবিষ্যতে যে পাঁচটা গ্রহাণু এবং ধূমকেতু পৃথিবী থেকে ৭.৫ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্বের মধ্য দিয়ে যাবে, সেসব ধুমকেতু এবং গ্রহাণুর তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। এভাবে একটি গ্রহাণু পৃথিবী থেকে নূন্যতম দূরত্ব পার করে ফেললে সেখানে আরো একটি গ্রহাণুর তথ্য সংযুক্ত হয়। এভাবে ওয়েবসাইটের ডাটা প্রতিনিয়ত আপডেট হয়ে থাকে।

নাসার অ্যাসটেরয়েড ওয়াচ ড্যাশবোর্ডে সাধারণত যেসব তথ্য প্রকাশ করা হয় তা হলো পরবর্তীতে পৃথিবীর পাশ দিয়ে যাবে এমন গ্রহানুগুলোর নাম, কত তারিখে পৃথিবী থেকে নূন্যতম কত দূরত্বে থাকবে এবং উক্ত গ্রহাণুর ডায়ামিটার। 

উক্ত ড্যাশবোর্ডে দেখা যায়, ০৬ এপ্রিল যে পাঁচটি গ্রহাণু পৃথিবীর পাশ দিয়ে যাবে তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে Asteroid 2023 FZ3। এটি আকারে প্রায় ১৫০ ফুট যা একটি বিমানের সমান। ৪,১৯০,০০০ কিলোমিটার দূরত্বে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে থাকবে।

Screenshot source: NASA

এদিকে ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ০৬ এপ্রিল Coordinated Universal Time (UTC) অনুযায়ী দুপুর ২:৫৬ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ৮:৫৬ মিনিটে) 2023 FZ3 নামক গ্রহাণুটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৪১ লক্ষ ৯০ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান করবে। এরপর এটি স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাবে।

Screenshot source: ESA

তাছাড়া উক্ত ওয়েবসাইট পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় প্রতিনিয়তই ছোট বড় অনেক গ্রহাণু পৃথিবীর কাছাকাছি আসে। অর্থাৎ এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। 

Asteroid 2023 FZ3 কি পৃথিবীর জন্য হুমকি হতে পারে?

নাসার অ্যাসটেরয়েড ওয়াচ ড্যাশবোর্ড (NASA’s Asteroid Watch dashboard) এর ওয়েবসাইটে বলা হয়, পৃথিবী থেকে ৭.৫ মিলিয়ন দূরত্বের মধ্যে যে সকল অবজেক্ট (গ্রহাণু) এর দৈর্ঘ্যের ১৫০ মিটারের বেশি, সেসব গ্রহাণুকেই সম্ভাব্য ক্ষতিকর অবজেক্ট হিসেবে ধরা হয়। 

Screenshot source: NASA

সেক্ষেত্রে 2023 FZ3 এর দৈর্ঘ্য মাত্র ৪৬ মিটার (১৫০ ফুট)। তাছাড়া উক্ত গ্রহাণুটির সম্পর্কে নাসার ওয়েবসাইটে কোনো জরুরী সতর্কতা মূলক বিবৃতি খুজে পায়নি রিউমর স্ক্যানার টিম।

তবে নাসার অন্য একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২৫ মিটার থেকে বড় কিন্তু ১ কিলোমিটার থেকে ছোট পাথর খন্ড যদি মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে আঘাত করে তাহলে সেই ক্ষতির পরিমান একটি নির্দিষ্ট এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। 

Screenshot source: NASA

অর্থাৎ, 2023 FZ3 গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত আনলেও সেটির ক্ষতির পরিমাণ হবে খুবই কম। তবে পৃথিবীতে এই গ্রহাণু পতিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

মূলত, বেশ কিছু ফেসবুক পোস্টে ০৬ এপ্রিল একটি গ্রহাণু তুলনামূলক পৃথিবীর কাছ দিয়ে যাওয়ার খবরটিকে “৬ এপ্রিল পৃথিবীতে গ্রহাণু আছড়ে পড়বে” দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহাণুর পৃথিবীর নিকটবর্তী হওয়ার ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। তবে বেশিরভাগ গ্রহাণু পৃথিবীর পাশ কাটিয়েই চলে যায়। ফলে বড় আকারের এসব গ্রহাণু দ্বারা পৃথিবীর আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।

উল্লেখ্য, ভবিষ্যতে পৃথিবীতে বড় কোনো গ্রহাণুর আঘাত আনার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে পৃথিবী থেকে মিসাইলের মাধ্যমে সেটির কক্ষপথ পরিবর্তন করে দেওয়ার এক্সপেরিমেন্ট ২০২২ সালেই সফলভাবে সম্পন্ন করেছে নাসা। অর্থাৎ বাইরের কোনো গ্রহাণু কিংবা আঘাত থেকে বাঁচার জন্য প্রতিরক্ষামূলক প্রযুক্তি এখন মানুষের কাছে রয়েছে। 

সুতরাং, ০৬ এপ্রিল বিমান সদৃশ একটি গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হানার খবর অতিরঞ্জিতভাবে গণমাধ্যম ও ফেসবুকে উপস্থাপণ করা হয়েছে, যা বিভ্রান্তিকর। 

তথ্যসূত্র

  • NASA: Asteroid Watch dashboard (Archive)
  • ESA: Near-Earth Objects Coordination Centre.
  • NASA: Asteroid Fast Facts.
  • NASA: NASA Confirms DART Mission Impact Changed Asteroid’s Motion in Space

আরও পড়ুন

spot_img