গত বছরের (২০২৩) ০৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলে ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ নামে হামলা শুরু করে। এই হামলা কেন্দ্র করে ইসরায়েল-হামাস সংঘাত শুরু হয়, যা এখনো চলছে। সম্প্রতি, রমজান মাস শুরু হওয়ার প্রেক্ষিতে গাজায় ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হয়েছে৷ এমন এক ত্রাণ সহায়তা পাঠানোর খবরে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া বেশ কিছু পোস্টে দাবি করা হচ্ছে, পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষ্যে গাজাবাসির জন্য ত্রাণ পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
উক্ত দাবিতে ফেসবুকের পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, রমজান উপলক্ষ্যে গাজায় আলোচিত ত্রাণ সহায়তা বাংলাদেশ সরকার পাঠায়নি বরং মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশের জনগণ থেকে অনুদান সংগ্রহ করে তা আল আজহারের গাজা সহায়তা ফান্ডে পৌঁছে দিয়েছেন। সেখান থেকে বাংলাদেশের পতাকায় গাজায় ত্রাণের লরি গিয়েছে। এই সহায়তার সাথে বাংলাদেশ সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে জাতীয় দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের ওয়েবসাইটে গত ১৩ মার্চ প্রকাশিত রমজানে গাজায় পৌঁছালো বাংলাদেশিদের ত্রাণ শিরোনামের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, পবিত্র রমজান মাসের তৃতীয় দিনে অসহায় গাজাবাসীদের সাহায্যার্থে ‘হেল্প গাজা’ প্রচারাভিযানের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৮০টি দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে দুই হাজার টন খাদ্যসহ ১০০ ট্রাকের একটি বহর মিশরের রাফা সীমান্ত দিয়ে গাজা উপত্যকায় পাঠানো হয়েছে।
মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থী (প্রাক্তন) হোজাইফা খানের বরাত দিয়ে এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গাজার মানুষের জন্য আল-আজহার কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে দ্য ওয়ার্ল্ড ওয়ান উম্মাহ ফাউন্ডেশনের দাতব্য তহবিলের মাধ্যমে রমজানের শুরুতেই বাংলাদেশি টাকায় মোট ৩৫ লাখ টাকার ত্রাণ পাঠানো হয়েছে।
এই অর্থ আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা হিউম্যান ফার্স্ট, আজহার ওয়েলফেয়ার সোসাইটি বাংলাদেশ ও হোয়াট পিগন ছাত্র সংগঠনগুলোর মাধ্যমে সংগ্রহ করেন বলে জানান হোজাইফা।
এ ছাড়া, বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য বেভারেজ প্রতিষ্ঠান ৪৮ লাখ টাকার ত্রাণ গাজার মানুষের জন্য পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে।
অনুসন্ধানে মিশরের সংবাদমাধ্যম Ahram এর ওয়েবসাইটে ১১ মার্চ প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক দাতব্য সংস্থা আল আজহার জাকাত অ্যান্ড চ্যারিটি হাউস নামক একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই ত্রাণ সহায়তা গাজায় পাঠানো হয়েছে৷ চ্যারিটি হাউসটির এক বিবৃতির বরাতে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে৷
এক্সে (সাবেক টুইটার) চ্যারিটি হাউসের অফিশিয়াল অ্যাকাউন্টে এ সংক্রান্ত বিবৃতিটি খুঁজে পাওয়া যায়৷ ১৩ মার্চ প্রকাশিত এই বিবৃতিতে এই ত্রাণ সহায়তার বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ থাকলেও এটা স্পষ্ট করে বলা হয়নি যে, সংশ্লিষ্ট দেশগুলো থেকে ঠিক কারা সহায়তা করেছেন।
এ বিষয়ে আরো অনুসন্ধান করে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী জনাব হোজাইফা খানের (যার বক্তব্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে রয়েছে) ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এ সংক্রান্ত একটি পোস্ট খুঁজে পেয়েছি আমরা। ১৪ মার্চের এই পোস্টে তিনি জানান, “আল-আযহারে অধ্যয়নরত আমরা এক ঝাঁক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী নিরলস প্রচেষ্টায় এবার বাংলাদেশের ৫টি , ভারতের ১৩টি ও বৃটেনের ২টি লরি সহ মোট ২০টি লরি পাঠাতে সক্ষম হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।”
জনাব হোজাইফা বলছেন, “বাংলাদেশ থেকে আসা অনুদানগুলো আযহার কতৃপক্ষের অনুরোধে এবার বাংলাদেশি পতাকার পাশাপাশি নির্দিষ্ট একাধিক ব্যানারে দেওয়া হয়েছে।”
হোজাইফা তার পোস্টে তাদের এই কাজ সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তিকে মেনশন করেছেন। এদের মধ্যে জনাব আবদুল্লাহ হাশেমের সাথে কথা বলেছি আমরা৷
জনাব হাশেমের কাছে আমরা আলোচিত দাবিটির বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি রিউমর স্ক্যানার টিমকে জানিয়েছেন, “আল আযহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যানারে যতো ত্রাণ পাঠানো হয়েছে, সব বাংলাদেশের জনগণের অনুদান। এখানে সরকারি কোন অনুদান, সহায়তা বা সহযোগিতা নাই। আল আযহারে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশ ও বিদেশ থেকে বাংলাদেশি ভাইবোনদের থেকে গাজার জন্য অনুদান কালেকশন করেছেন। এরপর সব অনুদান আল আযহারের গাজা সহায়তা ফান্ডে পৌঁছে দিয়েছেন। সেখান থেকে বাংলাদেশের পতাকায় গাজায় ত্রাণের লরি গিয়েছে। এ ক্ষেত্রে মিসরস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসেরও কোন অবদান ও সহযোগিতা নেই।”
জনাব হাশেম গত কয়েকদিনে এই ত্রাণ সহায়তা সংশ্লিষ্ট একাধিক পোস্ট ও ভিডিও প্রকাশ করেছেন৷ সেগুলোর কয়েকটি দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
মূলত, গত বছরের (২০২৩) ০৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের হামাস কর্তৃক ইসরায়েলে ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ নামে হামলা শুরু হলে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের পুরোনো সংঘাত নতুন রূপ পায়, যা এখনও চলছে। সম্প্রতি, রমজান মাস শুরু হওয়ার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশ থেকে ফিলিস্তিনের গাজায় ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হয়েছে৷ এমন এক ত্রাণ সহায়তা পাঠানোর খবরে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া বেশ কিছু পোস্টে দাবি করা হচ্ছে, পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষ্যে গাজাবাসির জন্য ত্রাণ পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত দাবিটি সঠিক নয়। রমজান উপলক্ষ্যে গাজায় আলোচিত এই ত্রাণ সহায়তা বাংলাদেশ সরকার পাঠায়নি। মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশ ও বিদেশ থেকে বাংলাদেশের জনগণ থেকে গাজার জন্য অনুদান সংগ্রহ করে তা আল আজহারের গাজা সহায়তা ফান্ডে পৌঁছে দিয়েছেন। সেখান থেকে বাংলাদেশের পতাকায় গাজায় ত্রাণের লরি গিয়েছে। এই সহায়তার ক্ষেত্রে সরকারি কোনো অনুদান, সহায়তা বা সহযোগিতা এমনকি মিসরস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসেরও কোনো সম্পর্ক নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সুতরাং, রমজান উপলক্ষ্যে গাজায় ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সরকার শীর্ষক একটি দাবি ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে; যা বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- The Daily Star: রমজানে গাজায় পৌঁছালো বাংলাদেশিদের ত্রাণ
- Ahram Online: Al-Azhar Zakat and Charity House dispatches Ramadan convoy to Gaza
- baitzakatEG: X Post
- Statement from Abdullah Hashem
- Rumor Scanner’s own analysis