সম্প্রতি ফ্রান্সের গণমাধ্যম L’equipe এর বরাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আর্জেন্টিনার ফুটবল তারকা মেসি, সার্জিও রামোস ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ২০২৯ সালে সুপার ব্যালন ডি’অরের জন্য মনোনীত হয়েছেন দাবিতে একটি তথ্য প্রচার করা হচ্ছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফ্রান্সের গণমাধ্যম L’equipe লিওনেল মেসি, সার্জিও রামোস ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ২০২৯ সালে সুপার ব্যালন ডি’অরের জন্য মনোনীত হয়েছোন দাবি করে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি বরং গণমাধ্যমটির সূত্রে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনভাবে উক্ত তথ্যটি প্রচার করা হচ্ছে।
তথ্যটি যেভাবে ছড়ালো
তথ্যটির উৎস অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফ্রান্সের গণমাধ্যম L’equipe এর সূত্রে সর্বপ্রথম এই তথ্যটি প্রচার করে নেপাল ভিত্তিক ফেসবুক পেইজ Sarcasm Football Nepal। পেইজটি থেকে গত ৭ মার্চ ‘Leo Messi, Sergio Ramos and Cristiano Ronaldo has been nominated for the Super Ballon d’Or (আর্কাইভ) শীর্ষক শিরোনামে একটি পোস্ট করা হয়।

পোস্টটিতে L’equip এর সূত্রে দাবি করা হয়, লিও মেসি, সার্জিও রামোস ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো সুপার ব্যালন ডি’অরের জন্য মনোনীত হয়েছে। এটি বিগত তিন দশকের সেরা খেলোয়াড়কে দেওয়া হয়। ফ্রান্স ফুটবল ২০২৯ সালে এই অ্যাওয়ার্ড দিবে।
পরবর্তীতে এই পোস্টটিই বাংলায় অনুবাদ বাংলাদেশে L’equip এর সূত্রেই প্রচার হতে থাকে। একই সময়ে Sarcasm Football Nepal তাদের পেইজ থেকে পোস্টটি মুছে ফেলে।
L’equip কি এমন কোনো প্রতিবেদন করেছে?
অনুসন্ধানের এই পর্যায়ে ফরাসী গণমাধ্যম L’equip এর ওয়েবসাইটে এ সুপার ব্যালন ডি’অরের জন্য মেসি, রামোস ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মনোনয়ন সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়নি।

কেবল L’equip-ই নয়, প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানেও সাম্প্রতিক সময়ে মূলধারার কোনো গণমাধ্যমে এমন কোনো তথ্যের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া সুপার ব্যালন ডি’অর প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের ফুটবল ম্যাগাজিন ফ্রান্স ফুটবল সূত্রেও এমন কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ L’equipe এর বরাতে আর্জেন্টিনার ফুটবল তারকা মেসি, সার্জিও রামোস ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ২০২৯ সালে সুপার ব্যালন ডি’অরের জন্য মনোনীত হওয়ার তথ্যটি ভিত্তিহীন।
Sarcasm Football Nepal এর রয়েছে পূর্বের গুজব ছড়ানোর রেকর্ড
রিউমর স্ক্যানারের পূর্ববর্তী বেশ কিছু গুজবের উৎস অনুসন্ধানে দেখা যায়, নেপাল ভিত্তিক ফেসবুক পেইজ Sarcasm Football Nepal থেকে ইতোপূর্বেও একাধিক গুজব প্রচার করা হয়। এর মধ্যে আছে, ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার পেলে গত ২৯ ডিসেম্বর মারা যাওয়ার পর এই পেইজটি থেকে পেলের পায়ের পাতাগুলো জাদুঘরে রাখার সিদ্ধান্ত শীর্ষক একটি দাবি। দাবিটির আর্কাইভ দেখুন এখানে।

যা পরবর্তীতে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে গুজব হিসেবে প্রতীয়মান হয়। এই বিষয়ে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধান পড়ুন এখানে।
এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ৭.৮ মাত্রার শক্তিশালি ভূমিকম্পের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আর্জেন্টাইন ফুটবল তারকার ‘লিও মেসি ফাউন্ডেশন’ তুরস্ক ও সিরিয়ার এ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৩৫ লাখ ইউরো দান করার একটি দাবিও উক্ত পেইজ থেকে প্রচার করা হয়। তবে রিউমর স্ক্যানারের দীর্ঘ অনুসন্ধানে সেটিও গুজব হিসেবে প্রতীয়মান হয়। এই বিষয়ে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধান পড়ুন এখানে।
সুপার ব্যালন ডি’অর কী? সবশেষ কখন দেওয়া হয়েছিল?
খেলাধুলা বিষয়ক ওয়েবসাইট GIVE ME SPORTS এ চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি ‘What is the Super Ballon d’Or‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, সুপার ব্যালন ডি’অর ফুটবলের বিরলতম ট্রফিগুলোর একটি। এটি ১৯৮৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর ফ্রান্সের ফুটবল ম্যাগাজিন ফ্রান্স ফুটবল তিন দশকের সেরা খেলোয়াড়ের জন্য দিয়েছিল। এরপর আর এটি দেওয়া হয়নি এবং কখন দেওয়া হবে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক খেলাধুলা বিষয়ক ওয়েবসাইট Sports Bible এ ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর ‘The Super Ballon d’Or, the most prestigious and rare award only ONE player has ever won‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৫৬ সালে ব্যালন ডি’অর চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অনেক প্রথিতযশা ফুটবলারই এটি জিতেছেন৷ তবে ফুটবল ইতিহাসে একজনই কেবল সুপার ব্যালন ডি’অর জিতেছেন। তিনি রিয়াল মাদ্রিদের মহারথী আলফ্রেডো ডি স্টিফানো। তিনি ১৯৫৭ এবং ১৯৫৯ সালে দুবার ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন। আর সুপার ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন তার দ্বিতীয় ব্যালন ডি’অর জয়ের ৩০ বছর পর অর্থাৎ ১৯৮৯ সালে।

ফ্রান্স ফুটবল ম্যাগাজিন ব্যালন ডি’অর অ্যাওয়ার্ডের ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে তিন দশকের সেরা খেলোয়াড়ের হাতে এই সুপার ব্যালন ডি’অর তুলে দেয়৷ তবে তখন শুধুমাত্র ইউরোপীয় খেলোয়াড়দের এই তালিকায় মনোনয়ন দেওয়া হতো। সুপার ব্যালন ডি’অরের জন্য অন্যান্য মনোনীতদের মধ্যে ছিলেন নেদারল্যান্ডসের কিংবদন্তি জোহান ক্রুইফ এবং ফ্রান্সের মিশেল প্লাতিনি।
উল্লেখ্য, ব্যালন ডি’অর ফ্রান্স ফুটবল ম্যাগাজিন কর্তৃক প্রদত্ত একটি অ্যাওয়ার্ড। এটি ১৯৫৬ সালে প্রথম দেওয়া হয় এবং ১৯৯৫ সালের আগ পর্যন্ত ব্যালন ডি’অরের জন্য কেবল ইউরোপীয়ান ফুটবলারদের বিবেচনা করা হতো৷ তবে ডি স্টেফানোর ক্ষেত্রে জানা যায়, তিনি জন্মসূত্রে আর্জেন্টাইন এবং ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত সেখানে খেললেও পরে তিনি কলম্বিয়া এবং স্পেনের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং নাগরিকত্ব অর্জন করেন, যা তাকে সুপার ব্যালন ডি’অরের জন্য যোগ্য করে তোলে।
আরও উল্লেখ্য যে, ১৯৮৯ সালে ফ্রান্স ফুটবল ম্যাগাজিন ব্যালন ডি’অরের ৩০ বছর পূর্তিতে সুপার ব্যালন ডি’অর প্রদান করলেও পরবর্তী ৩০ বছর পূর্তিতে অর্থাৎ ব্যালন ডি’অরের ৬০ বছর পূর্তিতে ২০২০ সালে এমন কোনো অ্যাওয়ার্ড ঘোষণা করেনি। বরং সে বছর মাগ্যাজিনটি একটি তালিকা প্রকাশ করে।

সেখানে ম্যাগাজিনটি দেখায়, ব্যালন ডি’অরের শুরু থেকে এটি সব দেশের খেলোয়াড়দের জন্য উন্মুক্ত হলে কোন খেলোয়াড় কয়টি ব্যালন ডি’অর জিততেন?
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, তিন দশকের সেরা খেলোয়াড়কে সুপার ব্যালন ডি’অর একবারই দেওয়া হয়েছিল ১৯৮৯ সালে, ফ্রান্স ফুটবল ম্যাগাজিন তাদের ৩০ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে। তারপর এই অ্যাওয়ার্ড আর কাউকে দেওয়া হয়নি বা এজন্য কারো নামও ঘোষণা করা হয়নি।
সুপার ব্যালন ডি’অর নিয়ে যত গুঞ্জন
১৯৮৯ সালের পর সুপার ব্যালন ডি’অর আর কাউকে না দেওয়া হলেও খেলাধুলা বিষয়ক বিভিন্ন ওয়েবসাইট সূত্রে এই অ্যাওয়ার্ডের জন্য বিভিন্ন দেশের সেরা খেলোয়াড়দের নাম পাওয়া যায়। যেমন, স্প্যানিশ গণমাধ্যম AS এর ‘Super Ballon d’or in 2029‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি স্টোরি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

বিগত ৩০ বছরের সেরা খেলোয়াড়কে ফ্রান্স ফুটবল অ্যাওয়ার্ড দিবে কি না এমন প্রশ্নে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, গুঞ্জন আছে যে, ২০২৯ সালে পুনরায় সুপার ব্যালন ডি’অর দেওয়া হতে পারে। যদি দেওয়া হয়, তবে এই অ্যাওয়ার্ড অর্জনে অন্যদের চেয়ে সবচেয়ে এগিয়ে থাকবেন আর্জেন্টাইন তারকা মেসি।

ভারতীয় গণমাধ্যম CNBCTV18 এ ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বরে ‘After FIFA World Cup 2022, Messi could win this rarest of rare trophies in football‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ১৯৮৯ সালের পরে সুপার ব্যালন ডি’অর যদি পুনরায় দেওয়া হয় তবে এর জন্য ৯০ এর দশক থেকে বর্তমান সময়ের সকল সেরা খেলোয়াড়দের নাম বিবেচনায় আসবে। যেমন, রোনালদো নাজারিও, রোনালদিনহো, জিনেদিন জিদান, জাভি হার্নান্দেজ, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, মেসি।

বর্তমান পারফরম্যান্স বিবেচনায় বিশ্বকাপ ও কোপা আমেরিকা জেতার পর এই তালিকায় উপরের দিকেই থাকবেন মেসি।
তবে সুপার ব্যালন ডি’অর প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ফ্রান্স ফুটবল ম্যাগাজিন সূত্রে এসব দাবির পক্ষে এখন পর্যন্ত কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া না যাওয়ায় ২০২৯ সালে সুপার ব্যালন ডি’অর প্রদানের বিষয়টি এখন পর্যন্ত গুঞ্জন হিসেবেই অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয়।
মূলত, ফুটবল বিষয়ক ম্যাগাজিন ফ্রান্স ফুটবল ফুটবলের অন্যতম মর্যাদাবান অ্যাওয়ার্ড ব্যালন ডি’অর ঘোষণা করে থাকে। ম্যাগাজিনটি ১৯৫৬ সালে প্রথম এটির প্রচলন করে। এর ধারাবাহিকতায় অ্যাওয়ার্ডটির ৩০ বছর পূর্তিতে ১৯৮৯ সালে সে সময়ে তিন দশকের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে স্পেনের ফুটবল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের মহারথী খেলোয়াড় আলফ্রেডো ডি স্টিফানোকে প্রথমবারের সুপার ব্যালন ডি’অর নামে একটি অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। এরপর ম্যাগাজিনটি কর্তৃক এই অ্যাওয়ার্ড আর কাউকে দেওয়া হয়নি এবং এর জন্য কাউকে মনোনয়নও দেওয়া হয়নি। তবে সম্প্রতি ফ্রান্সের একটি গণমাধ্যম L’equipe এর বরাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মেসি, সার্জিও রামোস ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে ২০২৯ সালে সুপার ব্যালন ডি’অরের জন্য মনোনীত করা হয়েছে দাবিতে একটি তথ্য প্রচার হলেও রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে এই দাবির পক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, L’equipe এর সূত্রে ফেসবুকে আর্জেন্টিনার ফুটবল তারকা মেসি, সার্জিও রামোস ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ২০২৯ সালে সুপার ব্যালন ডি’অরের জন্য মনোনীত হওয়ার দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- GIVE ME SPORT: What is the Super Ballon d’Or
- Sports Bible: The Super Ballon d’Or, the most prestigious and rare award only ONE player has ever won
- L’equipe: https://www.lequipe.fr/Football/
- France Football Magazine: https://www.francefootball.fr/magazine/
- France Football:
- How many Ballon(s) d’Or France Football could have won Diego Maradona?
- AS: Super Ballon d’or in 2029‘
- CNBCTV18: After FIFA World Cup 2022, Messi could win this rarest of rare trophies in football