আওয়ামী লীগের কর্মীদের গেরিলা প্রশিক্ষণের অভিযোগে আটক নারী সেনাপ্রধানের স্ত্রী নন 

আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি মেজর পদমর্যাদার সাদেকুল হক সাদেক নামে এক সেনাকর্মকর্তাকে হেফাজতে নিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। গত ৩১ জুলাই ঢাকা সেনানিবাসে অফিসার্স মেস ‘এ’-তে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনী সদর দপ্তরের মিলিটারি অপারেশনস পরিদফতরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা এ তথ্য জানান।

এরই প্রেক্ষিতে “আওয়ামীলীগ নেতাদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়ে ধরা পরলো সেনাপ্রধানের স্ত্রী” শীর্ষক থাম্বনেইল সম্বলিত একটি ভিডিও ইউটিউবে প্রচার করা হয়েছে। 

ভিডিওটি পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, একইসাথে যমুনা টিভি, আমার দেশ, বাংলাদেশ প্রতিদিন এবং ডিবিসি নিউজের ফুটেজ একত্রিত করে আলোচিত দাবিটি ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে। 

এর মধ্যে যমুনা টিভির ফুটেজে ‘রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আটক সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান’ – এমন অডিও শোনা যায়। দৈনিক আমার দেশের ফুটেজে ‘কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের গেরিলা প্রশিক্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিনকে ভাটারা থানার সন্ত্রাস বিরোধী আইনের মামলায় ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত’ – এমন অডিও শুনতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ প্রতিদিনের ফুটেজে ‘আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগে আটক সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিনকে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে করা মামলায় ৫ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত’ – এমন অডিও শোনা যায় এবং ডিবিসি নিউজের ফুটেজে এক আইনজীবীকে কথা বলতে শোনা যায়। তবে ডিবিসি নিউজের ফুটেজে অভিযুক্ত সুমাইয়া জাফরিনকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের স্ত্রী হিসেবে দাবি করা হয়নি। 

উক্ত দাবিতে ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। 

ফ্যাক্টচেক 

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আওয়ামী লীগ কর্মীদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগে আটক হওয়া সুমাইয়া জাফরিন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের স্ত্রী নন। প্রকৃতপক্ষে, অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্রমূলক গোপন বৈঠকের’ অভিযোগের মামলায় সেনাবাহিনীর মেজর সাদেকুল হক সাদেকের স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিনকে হেফাজতে নেওয়ার ঘটনার বিষয়ে গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত সংবাদ প্রতিবেদন সম্পাদনা করে আলোচিত দাবির ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া সেনাপ্রধানকে আটকের দাবিটিও বানোয়াট।

অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার। ভিডিওটির কয়েকটি গণমাধ্যমের (যমুনা টিভি, আমার দেশ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ডিবিসি নিউজ) সংবাদের ফুটেজ দেখানো হয়। তারপর ডিবিসি নিউজের প্রতিবেদনে একজন আইনজীবীকে কথা বলতে দেখা যায়। 

যমুনা টিভির ভিডিও ফুটেজ যাচাই 

এই বিষয়ে অনুসন্ধানে গত ০১ আগস্টে ‘মেজর সাদেকুলের বিরুদ্ধে তদন্ত আদালত গঠন করা হবে: আইএসপিআর’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিও প্রতিবেদনের শুরুর অংশের সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওর ভিজ্যুয়াল সাদৃশ্যতা থাকলেও অডিওতে অমিল লক্ষ্য করা যায়। মূল ভিডিওতে কোথাও ‘সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আটক’ শীর্ষক তথ্যের বিষয়ে উল্লেখ পাওয়া যায়নি। 

মূল ভিডিওতে সংবাদ উপস্থাপককে বলতে শোনা যায়, “রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আটক মেজর সাদেকুল হক সাদেকের বিরুদ্ধে তদন্ত আদালত গঠন করার কথা জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১৭ জুলাই ওই কর্মকর্তাকে উত্তরার নিজ বাসা থেকে আটক করে সেনা হেফাজতে নেয়া হয়। প্রাথমিক তদন্তে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলেও আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।” 

অর্থাৎ, এটি নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে যে, যমুনা টিভির প্রতিবেদনের ভিডিও ক্লিপ সম্পাদনা করেই আলোচিত ক্লিপটি তৈরি করা হয়েছে। 

আমার দেশের ভিডিও ফুটেজ যাচাই  

এই বিষয়ে অনুসন্ধানে দৈনিক আমার দেশের ইউটিউব চ্যানেলে গত ০২ আগস্টে ‘আওয়ামী না’শ’ক’তা’য় সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তারা কোর্ট মা’র্শা’লে’র মুখোমুখি’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওর শুরুর অংশের সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওর মিল রয়েছে। তবে, ভিডিওতে থাকা অডিও ক্লিপের মধ্যে অমিল লক্ষণীয়। মূল ভিডিওতে ‘কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের গেরিলা প্রশিক্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিনকে ভাটারা থানার সন্ত্রাস বিরোধী আইনের মামলায় ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত’ শীর্ষক কোনো তথ্যের উল্লেখ ছিলো না। 

মূল প্রতিবেদনটির শুরুর অংশে বলা হয়, “আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গোপনে নাশকতার ট্রেনিং-এ সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তা মেজর সাদেক ও তার সুপিরিয়র কমান্ডকে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করা হচ্ছে। প্রাথমিক তদন্তে তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার পর সেনাবাহিনীর তরফ থেকে দু’টি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে।” 

অর্থাৎ, আমার দেশের সংবাদ প্রতিবেদন সম্পাদনা করে আলোচিত ক্লিপটি তৈরি করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ প্রতিদিনের ভিডিও ফুটেজ যাচাই 

এই বিষয়ে অনুসন্ধানে বাংলাদেশ প্রতিদিনের ইউটিউব চ্যানেলে গত ০৭ আগস্ট ‘আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী জাফরিন ৫ দিনের রিমান্ডে’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। তবে ভিডিওটিতে ‘আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগে আটক সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিনকে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে করা মামলায় ৫ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত’ শীর্ষক তথ্যের উল্লেখ করা হয়নি। উক্ত ভিডিওর সঙ্গে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিও ক্লিপের সাদৃশ্যতা থাকলেও অডিও ক্লিপে অমিল দেখা যায়। 

বাংলাদেশ প্রতিদিনের মূল প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, আলোচিত সেনা কর্মকর্তা মেজর সাদেকুলের স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিনকে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে করা মামলায় ০৫ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা অনুমতি দিয়েছেন আদালত। ০৭ আগস্ট ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন।” 

অর্থাৎ, বাংলাদেশ প্রতিদিনের ইউটিউবে প্রকাশিত এক ভিডিও প্রতিবেদন ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনা করে আলোচিত দাবি সম্বলিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে। 

ডিবিসি নিউজের ভিডিও ফুটেজ যাচাই 

এই বিষয়ে অনুসন্ধানে ডিবিসি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলে গত ০৭ আগস্ট ‘মেজর সাদেকের স্ত্রী জাফরিন ৫ দিনের রি/মা/ন্ডে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিও প্রতিবেদনটির ১ মিনিট ১০ সেকেন্ড সময়ের সঙ্গে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত অংশের ভিজ্যুয়াল সাদৃশ্যতা পাওয়া যায়। তবে, ভিডিওটিতে কোথাও সুমাইয়া জাফরিনকে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের স্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। 

অর্থাৎ, ডিবিসি নিউজ-এর এই প্রতিবেদন সম্পাদনা করে সেখানে মেজর সাদেকের নাম উহ্য রেখে আলোচিত ফুটেজটি তৈরি করা হয়েছে। 

উল্লিখিত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এটি নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে যে, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি বিভিন্ন গণমাধ্যমের ভিডিও প্রতিবেদনের ফুটেজগুলো সম্পাদনা করে তৈরি করা হয়েছে। 

ইউটিউব থাম্বনেইল যাচাই 

এই বিষয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এবং তার স্ত্রী দাবিতে প্রচারিত থাম্বনেইল ইমেজটি সম্পাদনা বা এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। যেখানে সেনাপ্রধান এবং তার স্ত্রীর ছবি এবং পেছনে থাকা পুলিশদের একইরকম মুখাবয়বসহ বেশকিছু অসঙ্গতি লক্ষণীয়। 

Screenshot from Youtube by Rumor Scanner 

এছাড়া, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের স্ত্রী’র চেহারার সঙ্গে মেজর সাদেকের স্ত্রীর চেহারার যথেষ্ট অমিল দেখতে পাওয়া যায়।

Face Comparison by Rumor Scanner 

এছাড়া, Probaho tv নামক ইউটিউব চ্যানেল একই দাবিতে আরেকটি ভিডিও প্রচার করা হয় যেখানে আলোচিত ভিডিও ক্লিপগুলো ছাড়াও আরও কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ যুক্ত করা হয়েছে। উক্ত ক্লিপগুলোর সাথে আলোচিত দাবির কোনো সম্পর্ক নেই।

উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্রমূলক গোপন বৈঠকের’ অভিযোগের মামলায় সেনাবাহিনীর মেজর সাদেকুল হক সাদেকের স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিন দোষ স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গত ১২ আগস্ট, পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে তাকে আদালতে হাজির করা হলে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ ফারজানা হক জবানবন্দি রেকর্ড করে আসামিকে কারাগারে পাঠান। 

সুতরাং, আওয়ামী লীগের কর্মীদের গেরিলা প্রশিক্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত মেজর সাদেকের স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিনকে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের স্ত্রী দাবিতে প্রচার করা হয়েছে, যা মিথ্যা।  

তথ্যসূত্র 

আরও পড়ুন

spot_img