প্রথমবার নয়, এর আগেও পাঁচ ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী কিংবা প্যানেল ঘোষণা করেছে শিবির 

আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। পাঁচ বছর পর হতে যাওয়া এ নির্বাচনকে ঘিরে ২৮ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। এ ঘোষণা ঘিরে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে, স্বাধীনতার পর এবারই প্রথমবারের মতো ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। 

বিবিসি বাংলা ১৮ আগস্ট একটি ফেসবুক পোস্টে “প্রথমবারের মতো” শব্দ ব্যবহার করে একটি ফটোকার্ড প্রকাশ করে। তবে ২৯ মিনিট পর তা সম্পাদনা করে সেখানে “প্রকাশ্যে” শব্দটি যুক্ত করে।

এই দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদন দেখুন: বিবিসি বাংলা (ফেসবুক), দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, খবরের কাগজ। 

একই দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন: এখানে, এখানে, এখানে, এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বাধীনতার পর এবারের ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির প্রথমবার প্রার্থী বা প্যানেল ঘোষণা করেছে  বলে গণমাধ্যমে প্রচারিত দাবিটি সঠিক নয়। বরং ১৯৭৭ সালে সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক যাত্রার পর থেকে অনুষ্ঠিত ছয়টি ডাকসু নির্বাচনের (১৯৭৯, ১৯৮০, ১৯৮২, ১৯৮৯, ১৯৯০ ও ২০১৯) মধ্যে পাঁচটিতেই শিবির প্রার্থী বা প্যানেল ঘোষণা করেছে। শুধু ২০১৯ সালের নির্বাচনে তারা কোনো প্রার্থী বা প্যানেল দেয়নি।

অনুসন্ধানের শুরুতে ১৮ আগস্ট “বাঁশেরকেল্লা” নামের একটি ফেসবুক পেজে প্রকাশিত পোস্টে ১৯৮০ সালের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের একটি প্রচারপত্র এবং ১৮ সদস্যের প্রার্থীর তালিকা পাওয়া যায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ১৯৭৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। এরপর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে মোট ছয়বার– ১৯৭৯, ১৯৮০, ১৯৮২, ১৯৮৯, ১৯৯৯ এবং ২০১৯ সালে। রিউমর স্ক্যানার টিম ওপেন সোর্স অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রতিটি নির্বাচনের তারিখ বের করে। পরে বাংলাদেশের পুরোনো পত্রিকার অন্যতম অনলাইন সংরক্ষণাগার ‘সংগ্রামের নোটবুক’ ঘেঁটে সে সময়কার সংবাদমাধ্যমে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসন্ধান করে শিবিরের প্রার্থী বা প্যানেল ঘোষণার তথ্য খোঁজা হয়।

১৯৭৯ সালের ২৪ জুলাই ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনের দৈনিক ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদনে সহ-সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশিত হয়। সেখান থেকে জানা যায়, ইসলামী ছাত্রশিবিরের হয়ে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মোহাম্মদ আবু তাহের এবং জিএস পদে প্রার্থী ছিলেন আব্দুল কাদের বাচ্চু। একই তথ্য পাওয়া যায় সেদিনের দৈনিক সংবাদ পত্রিকার প্রতিবেদনেও।

পরবর্তী ডাকসু নির্বাচন হয় ১৯৮০ সালের ১৭ নভেম্বর। সেদিনের দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে এর আগের দিন (১৬ নভেম্বর) ছাত্রশিবির একটি সাইকেল র‌্যালির আয়োজন করে। একইদিনের দৈনিক গণকণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই নির্বাচনে শিবিরের “তাহের-কাদের পরিষদ” প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। আর নির্বাচনের একদিন আগে (১৬ নভেম্বর) প্রকাশিত দৈনিক সংবাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ডাকসু ও ১১টি হল সংসদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে।


১৯৮২ সালের ২৩ জানুয়ারি দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেদিন অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের পক্ষে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এনামুল হক মঞ্জু এবং জিএস পদে আব্দুল কাদের বাচ্চু। এর আগের দিন (২২ জানুয়ারি) প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ওই নির্বাচনের প্রচারণাকালে ছাত্রশিবিরের এক মিছিলে গ্রেনেড হামলা হয়, যাতে পথচারীসহ মোট ২২ জন আহত হন।


১৯৮৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের শামসু-আমিন পরিষদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। সেদিনের দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। একইদিনের দৈনিক ইত্তেফাকে উল্লেখ করা হয়, শিবিরের পক্ষ থেকে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আ.ন.ম. শামসুল ইসলাম এবং জিএস পদে আমিনুল ইসলাম।

‘Maulana A.N.M Shamsul Islam’ নামের একটি ফেসবুক প্রোফাইল থেকে গত ১৯ আগস্ট প্রকাশিত এক পোস্টে ১৯৮৯ সালের ডাকসু নির্বাচনের “শামসু-আমিন-মুজিব পরিষদ”-এর একটি ব্যানার এবং সেবার ছাত্রশিবিরের মনোনীত ২০ প্রার্থীর তালিকা পাওয়া যায়।

১৯৯০ সালের ২৭ মে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সেদিনের দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইসলামী ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে ভিপি পদে মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, জিএস পদে মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান এবং এজিএস পদে শফিকুল আলম হেলাল মনোনয়নপত্র জমা দেন। একইদিনের দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনেও একই তথ্য উঠে আসে।


তবে ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কোনো প্যানেল ঘোষণার তথ্য পাওয়া যায়নি।

অর্থাৎ, ১৯৭৭ সালে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পর থেকে অনুষ্ঠিত ছয়টি ডাকসু নির্বাচনের মধ্যে পাঁচটিতেই ছাত্রশিবির প্যানেল বা প্রার্থী দিয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের পাবলিক রিলেশন সম্পাদক এস এম তানভীর উদ্দিন রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, “বিবিসি নিউজের প্রতিবেদনে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিয়ে যে ‘স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মত ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের প্রার্থী ঘোষণা’ মন্তব্য করা হয়েছে, সেটি বিভ্রান্তিকর এবং ইতিহাস বিকৃতির শামিল। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ইসলামী ছাত্রশিবির ১৯৭৯ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ডাকসু নির্বাচনে প্যানেল দিয়েছে। কেবলমাত্র ২০১৯ সালের চরম ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা প্যানেল দিতে পারিনি। সুতরাং এবারের অংশগ্রহণকে ‘প্রকাশ্যে’ বলা উদ্দেশ্যমূলক ও বাস্তবতার সঙ্গে অসঙ্গত। ইসলামী ছাত্রশিবির এই ধরনের অপপ্রচারকে প্রত্যাখ্যান করছে।”

সুতরাং, স্বাধীনতার পর এবারই প্রথমবার বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী বা প্যানেল ঘোষণা করেছে বলে প্রচারিত দাবি মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

  • Rumor Scanner’s analysis.
  • Newspaper archive: Songramer Notebook
  • Statement from SM Tanvir Uddin, Public Relations Secretary of Bangladesh Islami Chhatrashibir 

আরও পড়ুন

spot_img