শেখ জুয়েলের ভারতীয় আধার কার্ড দাবিতে ভুয়া ছবি ভাইরাল

সম্প্রতি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল ভারতে নিজের আধার কার্ড বানানোর মাধ্যমে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছেন এমন একটি দাবি দেশের গণমাধ্যমগুলোর বরাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হতে দেখা গেছে। দাবি করা হচ্ছে, জনাব জুয়েল আধারে তার নাম দিয়েছেন বিধান মল্লিক। বাবার নাম দিয়েছেন মুদিন্দ্রনাথ মল্লিক। 

উক্ত দাবিতে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালবেলা, জনকণ্ঠ, প্রতিদিনের বাংলাদেশ (ইউটিউব), ইত্তেফাক (ইউটিউব), ঢাকা পোস্ট (ইউটিউব), সময়ের আলো, একুশে টিভি, বৈশাখী টিভি (ফেসবুক), নতুন সময় (ইউটিউব), ফেস দ্যা পিপল (ফেসবুক), দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস, আমাদের বার্তা, স্বদেশ প্রতিদিন, ঢাকা প্রকাশ। 

একই দাবিতে ফেসবুকের পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

একই দাবিতে ইউটিউবের ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

একই দাবিতে এক্সের পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক 

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েলের ভারতীয় আধার কার্ড দাবিতে প্রচারিত তথ্য সঠিক নয় বরং একাধিক উপায়ে কথিত আধার কার্ডটি ভুয়া বলে নিশ্চিত হয়েছে রিউমর স্ক্যানার। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে কথিত আধার কার্ডটি বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার। কার্ডটির বাম দিকে শেখ জুয়েলের একটি ছবি রয়েছে। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় জুয়েলের নাম ‘বিধান মল্লিক’ লেখা রয়েছে। একই ভাবে পিতার নাম ‘মুদিন্দ্রনাথ মল্লিক’ লেখা রয়েছে। জন্মতারিখ দেওয়া হয়েছে ১ জানুয়ারি ১৯৫৯। আধার কার্ড নম্বর দেওয়া হয়েছে ৮৪৪২০৫৬৭৫৭২৬। কার্ডটির ডানে একটি কিউআর কোড বসানো আছে।  

আধার কার্ডের নম্বরটি রিউমর স্ক্যানার এ সংক্রান্ত সরকারি অ্যাপে যাচাই করে দেখেছে। ভারতীয় একাধিক ফ্যাক্টচেকারের সহায়তায় যাচাই করে এই নম্বরের বিপরীতে কোনো ব্যক্তির তথ্য ডাটাবেজটিতে পাওয়া যায়নি৷ 

Collage: Rumor Scanner

অর্থাৎ, এটি যে একটি ভুয়া আধার কার্ড তা নিশ্চিত। 

আধার হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট সনাক্তকরণ টুল। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খোলা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক দৈনিক কার্যক্রমের জন্য পরিচয় প্রমাণ হিসাবে ভারতীয়দের এটি প্রয়োজন হয়। এই কার্ড পেতে আবেদনের সময় প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট (ভোটারি আইডিসহ) হিসেবে, আপনার পরিচয় এবং ঠিকানার প্রমাণপত্র প্রয়োজন হয়ে থাকে। রিউমর স্ক্যানার কথিত আধার কার্ডটি বিশ্লেষণে দেশটির একাধিক রাজ্যের নাগরিকের কিছু আধার কার্ডের কপি সংগ্রহ করে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করেছে। এসব আধার কার্ডের কোনোটিতেই কার্ডের সামনের অংশে পিতার নাম উল্লেখ পাওয়া যায়নি। এসব কার্ডের অন্তত তিনটিতে স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে যে আধার কার্ডটি শুধু পরিচয়ের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার হয়, নাগরিকত্বের জন্য নয়। অর্থাৎ, এটি অনেকটা বাংলাদেশের জন্ম নিবন্ধন সনদের মতো। 

Collage: Rumor Scanner

আধারে সকলের ক্ষেত্রে পিতার নাম সামনে থাকা বা না থাকা নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল ভারতীয় একজন ফ্যাক্টচেকারের কাছে। তিনি রিউমর স্ক্যানারকে বলছিলেন, মূল ফর্ম্যাট একই। অনেকের ক্ষেত্রে যেমন আড্রেসে বাবার নাম (কার্ডের পেছনের অংশে) আছে তাই সামনে বাবার নাম লেখা নেই।” 

তিনি জানালেন, “দু ধরনের কার্ড হয়। একটা এই রকম। আধার কার্ড তৈরি হওয়ার পর প্রথমে সাধারণ একটা বড় মোটা কাগজে এরকম প্রিন্ট আউট করে দেয়। আর আপনি যদি পার্মানেন্ট একটু ভালো কোয়ালিটির কার্ড চান তাহলে বেশি টাকা খরচা করে এপ্লাই করলে এরকম Polyvinyl Chloride card দেয়।” 

রাজ্যভেদে আধার কার্ডের ডিজাইনে ভিন্নতা আছে জানিয়ে ভারতীয় এই ফ্যাক্টচেকার বলছিলেন, “বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে (আধার) তৈরি হয়েছে। রাজ্য ভিত্তিক ছোট বড় কিছু পরিবর্তন থাকবে। তবে মূল ফর্ম্যাট সেম। সেটা হলো সামনে ছবি, নাম, ডেট অফ বার্থ, আর আধার নম্বর। পিছনে ঠিকানা আর আধার নম্বর। কোনও ক্ষেত্রে কিউ আর কোড সামনে কোথাও পিছনে। আর হ্যাঁ, যেই রাজ্যের প্রধান ভাষা যেটা সেটাই প্রথম ভাষা হিসেবে এই কার্ডে ব্যবহার হয়। দ্বিতীয়টা সব সময় ইংরেজি।”

কথিত এই আধার কার্ডটি যে ভুয়া তা নিশ্চিত হওয়ার পর এটি দিয়ে কী ধরণের কাজ করা যাবে সে বিষয়ে ভারতীয় ফ্যাক্টচেকারের কাছে জানতে চেয়েছিল রিউমর স্ক্যানার। তিনি বলছিলেন, ভারতে জাল আধার কার্ড প্রচুর তৈরি হয়। জাল আধার কার্ড দিয়ে হোটেলে চেক ইন করে নিতে পারে। কারণ এসব জায়গায় খালি কার্ড ফটোকপি বানিয়ে রেখে দেয়। তবে সিম নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। কারণ এই ধরনের কাজ করতে গেলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচ করাতে হয়, ওটিপি যায় ফোনে। আধার কার্ড তৈরির সময় ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া হয়, মোবাইল রেজিস্টার হয়। সেখানেই OTP যায়। তবে সেটাও ক্ষেত্রবিশেষে জাল হয়।  

তিনি জানালেন, একটু বড় মাপের জালিয়াতিও হয় এই ক্ষেত্রটিতে। অনেকে জাল করে ডেটাবেসেও রেজিস্টার করিয়ে দেয় নম্বর ফিঙ্গারপ্রিন্ট সব দিয়ে। তবে শেখ জুয়েলের ক্ষেত্রে ডাটাবেজে তার পরিচয়ের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলেনি। তাছাড়া এই কার্ডে পিতার নামটিও (মুদিন্দ্রনাথ মল্লিক) সন্দেহের উদ্রেক করে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে নামের মিল রেখে ভুয়া এই কার্ডে সমজাতীয় একটি নাম পিতার নাম হিসেবে যুক্ত করা হতে পারে রিউমর স্ক্যানারের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে।  

ভারতে জাল আধার কার্ড তৈরিকারীদের গ্রেপ্তারের ঘটনাও রয়েছে। গেল বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া কিছু ব্যক্তিদের জাল আধার কার্ডসহ প্রয়োজনীয় জাল ডকুমেন্ট তৈরি করে দেওয়ার অভিযোগে বেঙ্গালুরুতে একজন গ্রেপ্তার হন। 

এ সংক্রান্ত অনুসন্ধানে পরবর্তীতে শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েলের কথিত বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্রটি যাচাই করেছে রিউমর স্ক্যানার। কথিত এই জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার নাম সেখ সালাহউদ্দিন (SHAIKH SALAHUDDIN)। বাবা সেখ আবু নাছের। মাতা- রাজিয়া খাতুন। জন্মতারিখ ১ জানুয়ারি ১৯৬৭। পরিচয়পত্রের নম্বর ১৯৬৭২৬৯২৬১৯০০০০৩৩। 

Screenshot: Bd Pratidin 

তবে শুরুতে খটকা লাগার বিষয় হচ্ছে, বলা হচ্ছে এই পরিচয়পত্র শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েলের, তবে স্বাক্ষরে লেখা Naser। শেখ নাসের জনাব জুয়েলের পিতার নাম। পরিচয়পত্রে মূলত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষরই থাকে, পিতার নয়। এছাড়া, এই কার্ডে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নামের ইংরেজি বানানেও ভুল রয়েছে। Government কে লেখা হয়েছে Governmment। People’s কে লেখা হয়েছে Peple’s। 

রিউমর স্ক্যানার বিষয়টি অধিকতর অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে এনআইডি নম্বরটি (19672692619000033) নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে যাচাই করে একই নম্বরে এনআইডি থাকার বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা পায়। পরবর্তীতে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যাচাই করে দেখা যায়, এই এনআইডি নম্বরটি শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েলেরই। তার পিতা-মাতার নাম এবং তার জন্ম তারিখেরও মিল পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার। তবে স্বাক্ষরের বিষয়টি ওপেন সোর্সে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অর্থাৎ, কথিত এনআইডিতে স্বাক্ষর বাদে বাকিসব তথ্য শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েলের মূল এনআইডিতে রয়েছে। তবে বাংলাদেশের পুরো নামের ইংরেজি বানানের ভুল দেখে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, এটি আসল এনআইডি নয়। মূল এনআইডির তথ্য ব্যবহার করে ভুয়া এই এনআইডির ছবি তৈরি করা হয়েছে। 

সুতরাং, শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েলের ভারতীয় আধার কার্ড দাবিতে প্রচারিত ছবিটি ভুয়া ও বানোয়াট।

তথ্যসূত্র

  • Statement from Indian Fact Checker
  • Rumor Scanner’s own investigation 

আরও পড়ুন

spot_img