প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের তৃতীয় সৎ সরকার প্রধান নির্বাচিত হননি

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঘিরে ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স’ নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন দাবি প্রচার করা হচ্ছে। 

দাবি ১: বিশ্বের সৎ সরকার প্রধানদের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

২০১৭ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 
২০১৮ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 
২০১৯ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
২০২১ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 
২০২২ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 
২০২৩ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

দাবি ২: বিশ্বের কর্মঠ সরকার প্রধানের তালিকায় ৪র্থ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 

২০১৭ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 
২০১৮ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 
উক্ত জরিপের সূত্রে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন বাংলা ইনসাইডার, জনকণ্ঠ, কালের কণ্ঠ, ডিএমপি নিউজ৷ 

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন এখানে। 

উক্ত জরিপের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীকে মন্ত্রিপরিষদের অভিনন্দন জানানো সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেখুন এখানে। একই জরিপের সূত্রে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাসের লেখা পড়ুন এখানে। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে সৎ পাঁচজন সরকার প্রধানের তালিকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃতীয় স্থানে আছেন দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে একটি ভিত্তিহীন, ভুয়া ওয়েবসাইটের সূত্রে অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলা ইনসাইডারে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে সর্বপ্রথম এই তথ্যটি প্রচার করা হয়েছিল। তারপর থেকে প্রতিবছরই এই তথ্যটি ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে। 

অনুসন্ধান যেভাবে

দাবি ১: বিশ্বের সৎ সরকার প্রধানদের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে অনলাইন নিউজ পোর্টাল Bangla Insider এ ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর ‘শেখ হাসিনা বিশ্বের ৩য় সৎ সরকার প্রধান‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Bangla Insider

প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়, ‘বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স’  ৫ টি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেতৃত্বের সততার মান বিচার করে বিশ্বের ৫ জন সরকার রাষ্ট্রপ্রধানকে চিহ্নিত করেছেন, যাদের দুর্নীতি স্পর্শ করেনি, বিদেশে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, উল্লেখ করার মতো কোনো সম্পদও নেই। বিশ্বের সবচেয়ে সৎ এই পাঁচজন সরকার প্রধানের তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পিপলস অ্যান্ড পরিটিক্স ১৭৩ টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করেছে। এই গবেষণায় সংস্থাটি এরকম মাত্র ১৭ জন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান পেয়েছেন যাঁরা শতকরা ৫০ ভাগ দুর্নীতিমুক্ত হিসেবে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

Screenshot: Bangla Insider

প্রতিবেদনটিতে আরও দাবি করা হয়, ‘১৭৩ জন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও সৎ সরকার প্রধান হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল। ৫ টি প্রশ্নে মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে তিনি পেয়েছেন ৯০। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লং, ৮৮ পেয়ে সৎ সরকার প্রধানদের তালিকায় দ্বিতীয় স্থান পেয়েছেন। ৮৭ নম্বর পেয়ে এই তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছেন বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮৫ নম্বর পেয়ে বিশ্বে চতুর্থ সৎ সরকার প্রধান বিবেচিত হয়েছেন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইরনা সোলাবার্গ। আর ৮১ নম্বর পেয়ে এই তালিকায় পঞ্চম স্থানে আছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি।’

প্রতিবেদনটিতে প্রকাশিত এসব দাবির সত্যতা যাচাইয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম প্রথমেই জরিপকারী সংস্থা ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স’ নিয়ে অনুসন্ধান করে।

বাংলা ইনসাইডারের প্রতিবেদনে ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স’কে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাবি করা হলেও রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে এই নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। উক্ত নামে কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানে কেবল কিছু বই ও সিরিজের নাম পাওয়া যায়। 

Screenshot: Web Search 

পরবর্তীতে দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যতীত ঐ তালিকায় শীর্ষ পাঁচে থাকা বাকী ৪ জনের নাম ধরে অধিকতর অনুসন্ধানে তাদের নামে এমন কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

যেহেতু বাংলা ইনসাইডারের প্রতিবেদন অনুযায়ী,  ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স’ বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রতীয়মান হয় যে, এই জরিপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্জন নিয়ে যেভাবে ইন্টারনেটে তথ্য পাওয়া যায়, সেভাবে শীর্ষ পাঁচে থাকা অন্যান্য রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানারের সার্বিক অনুসন্ধানে তাদের নামে এমন কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

অনুরূপভাবে রিউমর স্ক্যানার টিম পাঁচজনের মধ্যে অন্তত দুইজন রাষ্ট্রপ্রধান যথাক্রমে সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল ও ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির জীবনী ও ক্যারিয়ার সংক্রান্ত একাধিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখে। সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের ক্যারিয়ার ও জীবনবৃত্তান্ত সংক্রান্ত এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন:

ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির জীবনী ও ক্যারিয়ার সংক্রান্ত এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন:

এসব প্রতিবেদন থেকে তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ও অর্জন সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য জানা গেলেও সেখানে দাবি সংক্রান্ত এমন কোনো অর্জনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

দাবি ২: বিশ্বের কর্মঠ সরকার প্রধানের তালিকায় ৪র্থ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 

দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে মূলধারার গণমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর ‘সরকার প্রধানদের শীর্ষ তালিকায় স্থান পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে মন্ত্রিপরিষদের অভিনন্দন‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot: Bangla Tribune

প্রতিবেদনটিতে প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে বিশ্বের সৎ সরকার প্রধানদের তালিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃতীয় অবস্থানে থাকায় এবং একই প্রতিষ্ঠানের করা কর্মঠ সরকার প্রধানদের তালিকায় তিনি ৪র্থ অবস্থানে থাকায় তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ। 

বিশ্বের কর্মঠ সরকার প্রধানের তালিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চতুর্থ হওয়ার ব্যাপারে প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়েছে, ‘যেসব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান কঠোর পরিশ্রম করেন এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে তার দেশে দৃশ্যমান উন্নতি করেছেন, তাদের কাজ পর্যালোচনা করে এই মূল্যায়ন করা হয়েছে। 

Screenshot: Bangla Tribune

এই জরিপের ক্ষেত্রে ১০ টি মাপকাঠি নির্ধারণ করেছে  পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স। এর ভিত্তিতে ১০০ নম্বরের মধ্যে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং ৮৭ নম্বর পেয়ে তালিকার শীর্ষে, ৮৫ নম্বর পেয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি দ্বিতীয়, ৮৩ নম্বর পেয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তৃতীয় এবং ৮০ নম্বর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চতুর্থ হয়েছেন। এ তালিকায় ৭৮ নম্বর পেয়ে পঞ্চম অবস্থানে আছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।’

অর্থাৎ বিশ্বের কর্মঠ সরকার প্রধানের তালিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৪র্থ হওয়ার দাবিতে যে জরিপটির ফলাফলকে উপস্থাপন করা হচ্ছে, সেটিও পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের। যা ইতোমধ্যে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে ভিত্তিহীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ্বের সৎ সরকার প্রধানদের তালিকায়  তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন দাবি করা অনলাইন পোর্টাল বাংলা ইনসাইডারই ‘দুর্নীতিতে জিয়া পরিবার বিশ্বে ৩য়‘ শীর্ষক শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যা পরবর্তীতে অন্যান্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিবাজ পরিবারের তালিকায় খালেদা জিয়ার পরিবার তৃতীয় হওয়ার দাবিটি মিথ্যা। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি দুইটিকে তাদের মধ্যে তুলনা করে একসাথে প্রচার করতেও দেখা যায়। 

Image collage: Rumor Scanner

মূলত, ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর ‘শেখ হাসিনা বিশ্বের ৩য় সৎ সরকার প্রধান’ শীর্ষক শিরোনামে বাংলা ইনসাইডার নামক একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে সৎ পাঁচজন সরকার প্রধানের তালিকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃতীয় স্থানে আছেন। বাংলা ইনসাইডার এক্ষেত্রে তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করে ‘বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স’কে। এছাড়া একই সূত্রে কর্মঠ সরকার প্রধানদের তালিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪র্থ অবস্থানে আছেন দাবিতেও একটি তথ্য প্রচার করা হয়। তবে রিউমর স্ক্যানারের সার্বিক অনুসন্ধানে দেখা যায়, ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স’ নামে কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। একটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন একটি প্রতিষ্ঠান সূত্রেই বাংলা ইনসাইডার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যা পরবর্তীতে অন্যান্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দীর্ঘদিন ধরে প্রচার হয়ে আসছিলো। 

সুতরাং, বিশ্বের সবচেয়ে সৎ পাঁচজন সরকার প্রধানের তালিকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃতীয় স্থানে ও কর্মঠ সরকার প্রধানদের তালিকায় চতুর্থ স্থানে থাকার দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img