ভাইরাল ছবির এই ব্যক্তি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নয়

সম্প্রতি, “১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত দেলু রাজাকার এর ছবি” শীর্ষক একটি তথ্য ও ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে ছবির ব্যক্তিকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী দাবি করা হয়েছে।

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

দাবিটির সূত্রপাত অনুসন্ধানে দেখা যায় এটি অন্তত ২০১৩ সাল থেকে ইন্টারনেটে প্রচারিত হয়ে আসছে। ২০১৬, ২০১৮, ২০১৯ সহ বিভিন্ন বছরে এটি প্রচারিত হতে দেখা গেছে।

ছবিটি পোস্ট করার মাধ্যমে যে দাবিগুলো করা হয়েছে: 

১. লাল চিহ্নিত ব্যক্তির নাম রাজাকার দেলু সিকদার কিংবা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, যাকে পিরোজপুরে আটক করা হয়েছে।

২. এই ছবিটি ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর ‘দৈনিক সংবাদ’ এ প্রকাশিত হয়েছে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, আলোচিত ছবির গোল চিহ্নিত যে ব্যক্তিকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বলে দাবি করা হচ্ছে সে ব্যক্তি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নয় বরং ছবির ঐ ব্যক্তি ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে খুন হওয়া একজন রাজাকার। এছাড়াও, এই ছবিটি ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার দাবিটিও মিথ্যা। 

ছবির ব্যক্তি কি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী?

আলোচিত ছবিটিতে এক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তাকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বলে দাবি করা হয়েছে। 

ছবিটির মূল সূত্রের বিষয়ে অনুসন্ধানে রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে ছবি শেয়ারিং এবং স্টোরেজ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গেটি ইমেজ এর ওয়েবসাইটে Prisoners Last Moments শিরোনামে মূল ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়।

গেটি ইমেজে থাকা ছবির ক্যাপশন থেকে জানা যায়, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ছবিটি তুলেছেন ফটোগ্রাফার উইলিয়াম লাভলেস এবং এটি কয়েকজন আটককৃত রাজাকারকে হত্যার আগ মুহুর্তের ছবি।

Screenshot: Getty Images

ছবিটির বর্ণনায় লেখা হয়েছে,  Guerrilla fighters of the pro-independence Mukti Bahini forces preparing to beat, torture and execute men accused of being members of the pro-Pakistani Razakar paramilitary force, at a political rally at a racecourse in Dhaka, Bangladesh, two days after the Pakistani surrender at the end of the Bangladesh War of Independence, 18th December 1971. Five prisoners were tortured and killed at the event. (Photo by William Lovelace/DailyExpress/Hulton-Deutsch Collection/CORBIS/Corbis via Getty Images)

বিস্তারিত বর্ণনাতে মুক্তিবাহিনীর গোরিলা যোদ্ধা কর্তৃক আটককৃত ৫ জন (মতান্তরে ৪) রাজাকারকে হত্যার তথ্য পাওয়া যায়। 

এছাড়া, ফটো স্টক ওয়েবসাইট Alamy তে এপির ফটোগ্রাফারের তোলা আটককৃত ঐ রাজাকারদের ভিন্ন কোণের একটি ছবিতেও একই বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায়। ছবির বর্ণনায় যুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ এবং লুটপাটের অভিযোগে অভিযুক্ত পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতার অভিযোগে চারজনকে নির্যাতন ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সময়ের মারধরের ছবি বলে উল্লেখ করা হয়।

 Screenshot : Alamy

তাছাড়া, এলামির স্টক ফটোতে উক্ত ঘটনার তাদের হত্যার আগের ও পরের বেশকিছু ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিটির ছবির বর্ণনাতেও তাদের ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর হত্যা করার বিষয় উল্লেখ করা হয়।

Screenshot : Alamy

অনুসন্ধানে, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের ওয়েবসাইটের আর্কাইভ সেকশনে ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর  ‘4 Tortured, Slain at Dacca Rally‘ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায় এবং উক্ত প্রতিবেদনে থেকে ঐ চার রাজাকারকে হত্যার ব্যাপারে অধিকতর নিশ্চিত হওয়া যায়। 

Photo : The New York Times

পরবর্তীতে এই চার (বা পাঁচ) রাজাকারকে হত্যার বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইভ ভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘সংগ্রামের নোটবুক’ এ ২০১৮ সালে ‘1971.12.18 কাদেরিয়া বাহিনীর হটকারী কার্যক্রম’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে ঐ ঘটনার বিস্তারিত তথ্য, বেশকিছু ছবি এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরের প্রিন্ট ভার্সনের ছবি পাওয়া যায়। 

Screenshot : Songramer Notebook

নিবন্ধতে বলা হয়, “পল্টন ময়দানে জনসভা শেষ হওয়ার পর কাদের সিদ্দিকি ৫ বিহারী রাজাকার বা সন্ত্রাসীর বিচারে সাজা কার্যকর করেন। উপস্থিত ডজন খানেক বিদেশী সাংবাদিকদের সামনেই তাদের হত্যা করা হয়। সাংবাদিকদের অনেকেই ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত সাংবাদিক এদের মধ্যে ছিলেন হর্সট ফাস, মাইকেল লরেনট এবং অরিয়ানা ফেলাচি।”

আরও লেখা হয়, “কাদের সিদ্দিকি পরে তার প্রকাশিত বই ‘স্বাধীনতা ৭১’ এ লিখেছেন, এমন সময় বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা দুটো ডাটসান গাড়ির ভেতর থেকে কিশোরী কণ্ঠে আর্তচিৎকার শোনেন তারা। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি দুটো ঘিরে ফেলে মুক্তিবাহিনীর অন্য সদস্যরা। দুজন যুবক দৌড়ে পালায়, ধরা পড়ে চার জন। ভীত সন্তস্ত্র কিশোরী দু’জনের কাছে যা জানা গেল, তারা অবাঙ্গালী। এই ছয়জন তাদের বাসায় লুটপাট চালিয়ে, নগদ ৫০ হাজার টাকা ও দু বোনকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, আর তাদের বৃদ্ধ মোটর মেকানিক পিতাকে বেধে রাখা হয়েছে গাড়ির পেছনের বনেটে। ঠিকই দেখা যায় সত্যি বলছে মেয়েরা।

এরপর দুস্কৃতিকারি ৪(৫) জনকে জনসমুদ্রে পরিণত হওয়া স্টেডিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সদ্য স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত সে নিয়ে বক্তব্য রাখেন কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান এবং মঞ্চে তোলা হয় মেয়ে দুটোকে। তাদের বক্তব্য শোনার পর, জনতার কাছে রায় চাওয়া হয়- তারা সমস্বরে দাবি জানান মৃত্যুদণ্ডের। পরে চারজন (৫)কে একটি করে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে শাস্তি কার্যকর করে কাদেরিয়া বাহিনী।”

অর্থাৎ, আলোচিত ছবির চিহ্নিত ব্যক্তি জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নয়।

ছবিটি কি ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছবি হিসেবে ‘দৈনিক সংবাদ’ এ প্রকাশ হয়েছিল? 

ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে ছবিটির সাথে কিছু কথা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে লেখা আছে,

“১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ছবি। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনী কর্তৃক পিরোজপুরে আটককৃত রাজাকার দেলু সিকদার (বর্তমান দেলোয়ার হোসেন সাইদি) ও তার দলের অন্যান্য সদস্যরা। ওই মুহূর্তে রাজাকার দেলু সিকদার (বর্তমান দেলোয়ার হোসেন সাইদি) এর চুলের মুঠি ধরে রাখেন একজন মুক্তিযোদ্ধা।”

তবে এই দাবিও সঠিক নয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দৈনিক সংবাদের কার্যালয়ে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া এবং এতে তাদের এক সিনিয়র সাংবাদিক আগুনে পুড়ে নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রায় ৯ মাস দৈনিক সংবাদের প্রকাশনা বন্ধ থাকে। ১৯৭১ সালের মার্চের এর শেষ সপ্তাহ থেকে ১৯৭২ সালের এর ৯ জানুয়ারি অব্দি দৈনিক সংবাদের প্রকাশনা বন্ধ ছিল। 

বিষয়টি আরো অধিকতর নিশ্চিতে বাংলাপিডিয়ায় দৈনিক সংবাদ নিয়ে প্রকাশিত নিবন্ধ পড়ে দেখে রিউমর স্ক্যানার টিম। সেখানে লেখা আছে, “পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বরাবরই সংবাদ পত্রিকার প্রতি বিরূপ ছিল। দেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে সংবাদ একাত্ম ছিল এবং এর দপ্তরে বারবার পুলিশের আক্রমণ হয়েছে। আদর্শের জন্য সংবাদকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে ১৯৭১ সালের মার্চে। সংবাদের প্রেস, মেশিনপত্র, অফিস সবই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ অগ্নিকান্ডে নিহত হন সাংবাদিক শহীদ সাবের। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সংবাদ প্রকাশিত হয় নি। ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি পুনরায় এর প্রকাশনা শুরু হয়।”

অর্থাৎ, ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর আলোচিত ছবি এবং ছবির চিহ্নিত ব্যক্তিটিকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী দাবি করে  দৈনিক সংবাদ এ প্রকাশের দাবিটি সত্য নয়। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে দৈনিক সংবাদরে প্রকাশনা বন্ধ ছিল।

মূলত, ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে রাজাকার অভিযোগে আটক হওয়া কয়েকজনের একটি ছবিতে থাকা এক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে প্রথম ২০১৩ সালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী দাবি করে প্রচার করা হয়। রিউমর স্ক্যানার এর অনুসন্ধানে দেখা যায় ছবির যে ব্যক্তিকে সাঈদী বলে দাবি করা হয়েছে সেই ব্যক্তি ১৯৭১ সালেই খুন হয়েছেন। সম্প্রতি, মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এই ভুয়া তথ্যটি পুনরায় প্রচার করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, জামায়াতে ইসলামীর হয়ে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে পর পর দুইবার বাংলাদেশের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। ২০১০ সালের ২৯শে জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগের একটি মামলায় তিনি গ্রেফতার হন। পরে ২ আগস্ট এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এরপর থেকেই কারাগারে ছিলেন জামায়াতের এই নেতা। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে আনা মোট বিশটি অভিযোগের মধ্যে আটটিতে তিনি আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর দুটো অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে আদালত ২০১৩ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেয়। তবে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে ২০১৪ সালে আপীল বিভাগ সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়। দণ্ডাদেশ পুনর্বিবেচনা চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও সাঈদীর পৃথক রিভিউ আবেদন খারিজ করে ২০১৭ সালের ১৫ মে আমৃত্যু কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়। এরপর থেকে কারাগারে থেকেই সাজা ভোগ করছিলেন তিনি। গত ১৪ আগস্ট রাতে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।

সুতরাং, ১৯৭১ সালে ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে রাজাকার অভিযোগে কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে নিহত হওয়া ব্যক্তির ছবিকে সদ্য প্রয়াত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছবি দাবি করে প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

  1. Main source and details of the photo – Getty 
  2. Some more before and after execution photos of the event -Alamy
  3. News on the execution -The New York Times
  4. Details on the execution events- Songramer Notebook
  5. Dainik Sangbad – Banglapedia 

আরও পড়ুন

spot_img