সম্প্রতি তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে কাবায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে শীর্ষক একটি দাবি ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে।

ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন পোস্ট (আর্কাইভ), পোস্ট (আর্কাইভ), পোস্ট (আর্কাইভ), পোস্ট (আর্কাইভ), পোস্ট (আর্কাইভ)।

টিকটকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন – পোস্ট (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, পৃথিবীর ইতিহাসে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে কাবায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর গায়েবানা জানাজা কিংবা কাবা শরীফে ঘোষণা দিয়ে সাঈদীর গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার দাবিগুলো মিথ্যা। প্রকৃতপক্ষে কাবায় সাঈদীর জানাজাটি ব্যক্তি উদ্যোগে আদায় করা এবং সেখানে নিয়মিতই মৃত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা পূর্বক গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার নজির রয়েছে।
কাবা শরীফ দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর গায়েবানা জানাজা ছিল ব্যক্তি উদ্যোগে
দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ১৪ আগস্ট রাত ১০ টা ১২ মিনিটে Hafez Shahid Laxmipur (আর্কাইভ) নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচারিত একটি লাইভ ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।

৩ মিনিট ৪০ সেকেন্ডের এই লাইভটিতে দেখা যায়, ভিডিওটিতে জনাব হাফেজ শহীদ জানান, ‘আমরা কাবা চত্ত্বরে সালাতুল মাগরিব (মাগরিবের নামাজ) শেষ করেছি। এখন জানাজার নামাজ হবে। সে জানাজার নামাজের সাথে আমরা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবের গায়েবানা জানাজা পড়বো। এখনই ঘোষণা হবে জানাজার নামাজের কাবা চত্ত্বরে। আমরা আশা করি, আপনারাও গায়েবানা জানাজায় অংশগ্রহণে দোয়া করবেন।’
তার এই বক্তব্যের মধ্যেই মসজিদের মাইকে আরবি ভাষায় একটি ঘোষণা দেওয়া হয়। তারপর তিনি বলেন, ‘অলরেডি নামাজে জানাজার ঘোষণা হয়ে গেছে। আমরা এই নামাজে জানাজার সাথেই কাবা চত্ত্বরে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবের গায়েবানা জানাজায় আমি অংশগ্রহণ করবো।’
লাইভকারী ব্যক্তির এই বক্তব্য বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়, কাবা শরীফ ঘোষণা দিয়ে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর গায়েবানা জানাজা হয়নি। বরং এই ব্যক্তি কাবা শরীফ ভিন্ন আরেকটি জানাজার সঙ্গে মিলিয়ে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জন্য ব্যক্তি উদ্যোগে গায়েবানা জানাজা আদায় করেন।
পরবর্তীতে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে গত ১৪ আগস্ট কাবা শরীফে মাগরিবের নামাজের সময় থেকে শুরু করে এশার নামাজ পর্যন্ত সময়কালে মসজিদুল হারাম বা কাবা শরীফের ফেসবুক লাইভ স্ট্রিমিং বিশ্লেষণ করে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নাম উল্লেখ পূর্বক তার গায়েবানা জানাজার বিষয়ে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এছাড়া মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববী সম্পর্কিত ভেরিফায়েড টুইটার অ্যাকাউন্ট যাচাই করেও এমন কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
একইসাথে এ নিয়ে অনুসন্ধানে ১৫ আগস্ট হাসান নোমান (আর্কাইভ) নামে একজন সৌদি প্রবাসীর ৩ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের ফেসবুক লাইভ খুঁজে পাওয়া যায়।

সেখানে তিনি বলেন, ‘গতকাল থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি নিউজ ভেসে বেড়াচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে, বাইতুল্লাহ (কাবা শরীফে) আল্লামা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটা নিয়ে আমার সন্দেহ হয়েছিল। কারণ আমি এখন মদিনায় অবস্থান করছি। এখানে এমন কিছু দেখিনি কোনো সালাতের পরে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে জানার জন্যে আমি মক্কার জামায়েতের একজন দায়িত্বশীলকে ফোন দিয়েছিলাম। তিনি বলেছেন, বাইতুল্লায় দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর কোনো গায়েবানা জানাজা হয়নি। তবে ১৫ আগস্ট এশার নামাজের পরে মক্কা জামায়েতে ইসলামীর উদ্যোগে তারা বাইতুল্লার আশেপাশে কোথাও গায়েবানা জানাজার আয়োজন করেছেন।’
অর্থাৎ কাবা শরীফে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর আনুষ্ঠানিক কোনো গায়েবানা জানাজা হয়নি।
কাবা শরীফে গায়েবানা জানাজা সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
অনুসন্ধানের এ পর্যায়ে রিউমর স্ক্যানার টিম কাবা শরীফে গায়েবানা জানাজার ইতিহাস নিয়ে যাচাই করে। এতে দেখা যায়, পৃথিবীর ইতিহাসে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে কাবায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর গায়েবানা জানাজার দাবিটি মিথ্যা। প্রকৃতপক্ষে সেখানে নিয়মিতই মৃত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা পূর্বক গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। অনুসন্ধানে এ জাতীয় বেশ কিছু সংবাদও খুঁজে পাওয়া যায়।
যেমন, ২০২২ সালের ১৩ মে কাবা শরীফে আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শায়েখ খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের গায়েবানা জানাজার পড়ার বিষয়ে জানা যায় সৌদি আরব ভিত্তিক গণমাধ্যম সৌদি গেজেটে ‘Funeral prayer in absentia performed in Two Holy Mosques for late UAE president’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে।

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীর তত্ত্বাবধায়ক বাদশাহ সালমানের নির্দেশনায় মসজিদ দুইটিতে সেসময় মাগরিবের পর আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শায়েখ খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের গায়েবানা জানাজা পড়ানো হয়।
এটি ছাড়াও কাতার ভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার সূত্রে ২০১৮ সালে হত্যাকান্ডের শিকার সৌদি নাগরিক সাংবাদিক জামাল খাশোগির জন্যও মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীতে গায়েবানা জানাজা পড়ানোর বিষয়ে তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়।

পাশাপাশি ২০১১ সালে সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আজিজ আল সউদ দেশটির যুবরাজ সুলতান বিন আব্দুল আজিজ আল সউদের গায়েবানা জানাজা মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীসহ সৌদি আরবের সকল মসজিদে পড়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীতে গায়েবানা জানাজা পড়ার বিষয়টি একটি সাধারণ ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসে কেবল তিনজন ব্যক্তির কাবা শরীফে গায়েবানা জানাজা হয়েছে শীর্ষক তথ্যটি পুরোপুরি ভিত্তিহীন।
উল্লেখ্য, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রাজনৈতিক দল জামায়েতে ইসলামীর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ঘুরেও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে তার গায়েবানা জানাজার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেলেও কাবা শরীফে ঘোষণা দিয়ে সাঈদীর গায়েবানা জানাজা পড়ার বিষয়ে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মূলত, গত ১৪ আগস্ট রাতে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মারা যান। তার মৃত্যুর পর সেদিন রাতেই সৌদি প্রবাসী এক ব্যক্তি কাবা শরীফ থেকে ফেসবুক লাইভে এসে জানান, মাগরিবের পর সেখানে গায়েবানা জানাজা হবে, যাতে তিনি সাঈদীর জন্য গায়েবানা জানাজা পড়বেন। পরবর্তীতে তার এই বক্তব্য সূত্রেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে যে, কাবা শরীফে ঘোষণা দিয়ে সাঈদীর গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সাঈদী সহ পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র তিন ব্যক্তির গায়েবানা জানাজা কাবা শরীফে অনুষ্ঠিত হলো। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, কাবা শরীফে সাঈদীর জানাজাটি ছিল ব্যক্তি উদ্যোগে, এবং একইসাথে প্রচার হওয়া ‘কাবায় শুধুমাত্র ৩ জনের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার’ দাবিটিও মিথ্যা। সেখানে নিয়মিতই মৃত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা পূর্বক গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রসঙ্গত, জামায়াতে ইসলামীর হয়ে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে পর পর দুইবার বাংলাদেশের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। ২০১০ সালের ২৯শে জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগের একটি মামলায় তিনি গ্রেফতার হন। পরে ২ আগস্ট এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এরপর থেকেই কারাগারে ছিলেন জামায়াতের এই নেতা। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে আনা মোট বিশটি অভিযোগের মধ্যে আটটিতে তিনি আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর দুটো অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে আদালত ২০১৩ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেয়। তবে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে ২০১৪ সালে আপীল বিভাগ সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়। দণ্ডাদেশ পুনর্বিবেচনা চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও সাঈদীর পৃথক রিভিউ আবেদন খারিজ করে ২০১৭ সালের ১৫ মে আমৃত্যু কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়। এরপর থেকে কারাগারে থেকেই সাজা ভোগ করছিলেন তিনি।
সুতরাং, কাবা শরীফে ঘোষণা দিয়ে সাঈদীর গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়া এবং সাঈদীসহ মাত্র তিনজনের কাবা শরীফে জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার দাবিগুলো মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Hafez Shahid Laxmipur: Hafez Shahid Laxmipur facebook live
- Hasan Noman: Hasan Noman facebook live
- Haramain Servant: 𝐋𝐢𝐯𝐞 𝐌𝐚𝐬𝐣𝐢𝐝 𝐀𝐥-𝐇𝐚𝐫𝐚𝐦
- Haramain: Twitter
- Saudi Gazette: Funeral prayer in absentia performed in Two Holy Mosques for late UAE president
- Al jazeera: Funeral prayers held for Jamal Khashoggi in Mecca and Medina
- my.gov.sa: The King directed that (Salat Al-Gha’ib) funeral prayer in absentia be performed today for the soul of late Crown Prince Sultan bin Abdulaziz Al Saud
- Bangladesh Jamaat-e-Islami: Facebook