গত ১৮ এপ্রিল মন্দিরে আগুন দেওয়ার ঘটনায় সন্দেহের জেরে ফরিদপুরের মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী গ্রামে দুই নির্মাণ শ্রমিক পিটিয়ে হত্যা করে একদল উত্তেজিত হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এর প্রতিবাদে গতকাল ২৩ এপ্রিল সকালে মধুখালীর বাগাট বাজার এলাকায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করেন স্থানীয় লোকজন। এসময় মহাসড়ক থেকে বিক্ষুব্ধ জনতাকে সরাতে পুলিশ টিয়ারসেল ও শর্টগানের গুলি ছুড়ে। যাতে প্রায় ১৫ জন আহত হন।
এর প্রেক্ষিতে উক্ত ঘটনায় পুলিশের গুলিতে দুইজন নিহত হয়েছেন দাবিতে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে। এর সাথে শর্টগানের গুলিতে আহত এক ব্যক্তির ছবি যুক্ত করে দাবি করা হয় উক্ত ব্যক্তি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ফরিদপুরের মধুখালীতে দুই শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে ডাকা ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধে পুলিশের গুলিতে দুইজন নিহত হওয়ার তথ্যটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, মহাসড়ক অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও শর্টগানের গুলি ছুড়ে। যাতে প্রায় ১৫ জন আহত হন। এর মধ্যে একজন গুরুতর আহত হন। যার ছবিকে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়া ব্যক্তির ছবি দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।
আলোচিত দাবিটির বিষয়ে অনুসন্ধানে উক্ত ঘটনায় প্রকাশিত একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন পর্যলোচনা করে রিউমর স্ক্যানার টিম (সমকাল, দেশ রূপান্তর, ইনকিলাব, নয়া দিগন্ত, কালবেলা)। এতে পুলিশের গুলিতে ১৫ জন আহত হবার তথ্যটি পাওয়া গেলেও কারও নিহত হওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এছাড়াও প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমেও উক্ত ঘটনায় দুজন নিহতের দাবির বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে অনুসন্ধানে গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে ফরিদপুর জেলা পুলিশ ও মধুখালী থানার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে প্রচারিত একটি বিজ্ঞপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘অদ্য ২৩-০৪-২০২৪ খ্রি. মধুখালী থানায় মানববন্ধন ও হাইওয়ে রোডে ব্যারিকেড দেওয়ার ঘটনা জেলা পুলিশ অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বর্তমানে যানবাহন চলাচল ও অন্যান্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। আজকের ঘটনায় কোথাও কেউ নিহত হয়নি। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিহতের সংবাদ ছড়ানো হচ্ছে। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। সকলকে এমন মিথ্যা প্রচার হতে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করা হলো। আইন মেনে চলুন, পুলিশকে সহায়তা করুন।’
পরবর্তীতে দাবিটির অধিকতর সত্যতা যাচাইয়ে একাধিক গণমাধ্যমের স্থানীয় প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম।
দৈনিক কালবেলা এর ফরিদপুর জেলা প্রতিনিধি তন্ময় উদ্দৌলা রিউমর স্ক্যানারকে জানান, উক্ত ঘটনায় কয়েকজন পুলিশ সদস্যসহ প্রায় ২০ জনের মত আহত হয়েছেন। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো নিহতের ঘটনা ঘটেনি। নিহত ব্যক্তির ছবি দাবিতে প্রচারিত ছবিটি তাকে দেখানো হলে তিনি জানান, এই ব্যক্তি পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছেন কিন্তু মারা যাননি।
ঢাকা পোস্ট এর ফরিদপুর প্রতিনিধি জহির হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনিও একই তথ্য জানান।
পরবর্তীতে উক্ত বিষয়ে মধুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-এর আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ কবির সরদারের সাথেও কথা বলে রিউমর স্ক্যানার টিম। তিনি বলেন, ‘সকালের ঘটনায় কেউ নিহত হননি। সোহেল নামের একজন গুরুতর আহত ছিলেন তবে বর্তমানে তিনি শঙ্কামুক্ত আছেন।’
অর্থাৎ, মধুখালীতে দুই শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে করা মানববন্ধনে অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের চালানো গুলিতে এই প্রতিবেদন প্রকাশ অবধি কোনো নিহতের ঘটনা ঘটেনি।
মূলত, গত ১৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ফরিদপুরের মধুখালীর পঞ্চপল্লী গ্রামে একটি কালী মন্দিরে আগুন লাগার ঘটনায় পার্শ্ববর্তী নির্মাণাধীন স্কুল ভবনের আশরাফুল ও আশাদুল নামের দুই নির্মাণশ্রমিক ভাইকে হাত-পা বেঁধে মারধর করে একদল উত্তেজিত হিন্দু ধর্মাবলম্বী। পরবর্তীতে তাদের উদ্ধার করে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজন মারা যান। এ ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল ২৩ এপ্রিল সকালে মধুখালীর বাগাট বাজার এলাকায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করেন স্থানীয় লোকজন। এসময় মহাসড়ক অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও শর্টগানের গুলি ছুড়ে। যাতে প্রায় ১৫ জন আহত হন। এই ঘটনায় পুলিশের ছোড়া গুলিতে দুজন নিহত হয়েছে দাবিতে একটি তথ্য সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি নিহতের ছবি দাবিতে শর্টগানের গুলিতে আহত এক ব্যক্তির ছবিও প্রচার করা হচ্ছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, উক্ত ঘটনায় পুলিশ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন আহত হলেও এতে কোনো নিহতের ঘটনা ঘটেনি। বরং আহত একজন ব্যক্তির ছবি নিহতের ছবি দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।
সুতরাং, ফরিদপুরের মধুখালীতে দুই শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদ কর্মসূচিতে পুলিশের গুলিতে দুইজন নিহত হয়েছেন দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।