জুনে ৩১১ ভুল তথ্য শনাক্ত

চলতি বছরের জুন মাসে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া ৩১১টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার। রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে গত জুন মাসে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক থেকে গণনাকৃত এই সংখ্যার মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়ে সবচেয়ে বেশি (১১৫) ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ মিলেছে, যা মোট ভুল তথ্যের ৪০ শতাংশ। এছাড়া আন্তর্জাতিক বিষয়ে ৮৫টি, জাতীয় বিষয়ে ৪৫টি, বিনোদন ও সাহিত্য বিষয়ে ১৮টি, প্রতারণা বিষয়ে ১০টি, খেলাধুলা বিষয়ে পাঁচটি, ধর্মীয় বিষয়ে সাতটি, শিক্ষা বিষয়ে তিনটি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে জুনে।

এসব ঘটনায় ভিডিও কেন্দ্রিক ভুলই ছিল সবচেয়ে বেশি, ১৫৩টি। এছাড়া তথ্য কেন্দ্রিক ভুল ছিল ১১০টি এবং ছবি কেন্দ্রিক ভুল ছিল ৪৮টি। শনাক্ত হওয়া ভুল তথ্যগুলোর মধ্যে মিথ্যা হিসেবে ২০৯টি, বিকৃত হিসেবে ৬৪টি এবং বিভ্রান্তিকর হিসেবে ৩৮টি ঘটনাকে সাব্যস্ত করা হয়েছে। 

প্লাটফর্ম হিসেবে গত মাসে ফেসবু্কে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে, সংখ্যার হিসেবে যা ৩০৩টি। এছাড়া ইনস্টাগ্রামে ৬৬টি, ইউটিউবে ৬৮টি, এক্সে ১৯টি, টিকটকে ২৩টি এবং লিংকডইনে অন্তত একটি ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। ভুল তথ্য প্রচারের তালিকা থেকে বাদ যায়নি দেশের গণমাধ্যমও। ১০টি ঘটনায় দেশের একাধিক গণমাধ্যমে ভুল তথ্য প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার।  

বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য প্রচারের বিষয়টি গেল বেশ কয়েক মাস ধরে আলোচনায় থাকলেও সম্প্রতি তা কিছুটা হ্রাস পেতে দেখা যাচ্ছে। জুন মাসে সাতটি সাম্প্রদায়িক অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এর মধ্যে ছয়টি ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় পরিচয়ধারী অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। 

রিউমর স্ক্যানার টিমের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গেল মাসে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে জড়িয়ে তিনটি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। ভুলতথ্যগুলোর ধরণ বুঝতে এগুলোকে রিউমর স্ক্যানার দুইটি আলাদা ভাগে ভাগ করেছে৷ সরকারের পক্ষে যায় এমন ভুল তথ্যের প্রচারকে ইতিবাচক এবং বিপক্ষে যায় এমন ভুলতথ্যের প্রচারকে নেতিবাচক হিসেবে ধরে নিয়ে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, এসব ভুলতথ্যের সবগুলোতেই সরকারকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। 

জুন মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে ১৭টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। সবগুলোতেই তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে জড়িয়ে তিনটি (সবগুলোই বিপক্ষে), আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে জড়িয়ে তিনটি (সবগুলোই বিপক্ষে), সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে), ফরিদা আখতারকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে) এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমকে জড়িয়ে দুইটি (সবগুলোই বিপক্ষে) ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। 

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে সর্বত্র। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গেল মাসে ২৯টি অপতথ্যের প্রচার দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। 

রিউমর স্ক্যানার গেল মাসের ফ্যাক্টচেকগুলো বিশ্লেষণে দেখেছে, এই সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), তার অঙ্গসংগঠন এবং নেতাকর্মীদের জড়িয়ে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য (৪৯টি) প্রচার করা হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে বিএনপিকে জড়িয়ে ১৬টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে, যার সবগুলোতেই দলটিকে নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এই সময়ে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে), ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে চারটি (সবগুলোই বিপক্ষে) এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নিয়ে একটি (বিপক্ষে) অপতথ্যের প্রচার করা হয়েছে। দলটির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে জড়িয়ে এই সময়ে একটি (বিপক্ষে) অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।

বিএনপির পর কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, তার অঙ্গ-ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন এবং নেতাকর্মীদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি (২৪টি) অপতথ্যের প্রচার করা হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে জড়িয়ে ছয়টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে যার ৮৩ শতাংশই দলটির পক্ষে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে এই সময়ে ১১টি অপতথ্য (৮২ শতাংশই পক্ষে) প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। এছাড়া নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়া দলটির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে জড়িয়ে জুনে একটি অপতথ্য (পক্ষে) শনাক্ত করা হয়েছে। 

এছাড়া, জুন মাসে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, তার অঙ্গসংগঠন এবং নেতাকর্মীদের জড়িয়ে ১৫টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে জামায়াতকে জড়িয়ে ছয়টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে, যার সবগুলোই দলটিকে নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমানকে জড়িয়ে এই সময়ে দুইটি অপতথ্য (৫০ শতাংশ বিপক্ষে) প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। দলটির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে এই সময়ে চারটি (সবগুলোই বিপক্ষে) অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও দলটির নেতাকর্মীদের জড়িয়ে গত মাসে ১৮টি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে এনসিপিকে জড়িয়ে পাঁচটি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে, যার সবগুলোই দলটিকে নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এই দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে জড়িয়ে গত মাসে একটি (বিপক্ষে) অপতথ্যের প্রচার করা হয়েছে গত মাসে। এছাড়া দলটির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহকে জড়িয়ে দুইটি (সবগুলোই বিপক্ষে), সারজিস আলমকে জড়িয়ে চারটি (সবগুলোই বিপক্ষে), তাসনিম জারাকে জড়িয়ে দুইটি (সবগুলোই বিপক্ষে), নুসরাত তাবাসসুমকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে), তাজনূভা জাবীনকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে) এবং সারোয়ার তুষারকে জড়িয়ে দুইটি (সবগুলোই বিপক্ষে) অপতথ্যের প্রচার দেখা গেছে।  

ভুল তথ্যের রোষানল থেকে রক্ষা পায়নি রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোও। গেল মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে জড়িয়ে চারটিসহ এই বাহিনীকে জড়িয়ে পাঁচটি ভুল তথ্য প্রচার দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। এছাড়া বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজিপি ময়নুল ইসলামকে জড়িয়ে একটিসহ এই বাহিনীকে জড়িয়ে চারটি ভুল তথ্য এবং র‌্যাবকে জড়িয়ে একটি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।    

গেল মাসের ভুল তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, এই সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ভুয়া কনটেন্ট শনাক্ত হয়েছে ৪১টি। একই সময়ে ডিপফেক ভিডিও শনাক্ত করা হয়েছে পাঁচটি। 

গত ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাসহ বিভিন্ন স্থানে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাতের সূত্রপাত হয়। এরপর হামলা, পাল্টা জবাব ও হুমকির মধ্যে ১২ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর যুদ্ধবিরতির খবর আসে।  এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে বহু ভুল তথ্য ছড়ায়, নিয়মিত প্রচার হয় পুরোনো ছবি কিংবা ভিন্ন ঘটনার ভিডিও। ভুয়া ছবি-ভিডিও তৈরিতে ব্যবহার হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিও। এসব ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে রিউমর স্ক্যানার গেল মাসে এ সংক্রান্ত ৭৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে। 

গত মাসে গণমাধ্যমের নাম, লোগো, শিরোনাম এবং নকল ও ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার করে ৫২টি ঘটনায় দেশি ও বিদেশি ২৭টি সংবাদমাধ্যমকে জড়িয়ে ৫২টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে ভুল তথ্য প্রচারে মূলধারার গণমাধ্যম কালবেলার নাম সবচেয়ে বেশি (৭) ব্যবহার করা হয়েছে। গণমাধ্যমটির পর একাত্তর টিভি, কালের কণ্ঠ ও ইত্তেফাক (চারটি করে) এর নাম বেশি ব্যবহার করা হয়েছে।  

বার্তা প্রেরক
তানভীর মাহতাব আবীর
জ্যেষ্ঠ ফ্যাক্টচেকার,
রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশ। 
[email protected]

আরও পড়ুন

spot_img