গত ১২ ই নভেম্বর ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় প্রজাপতি পরিবহনের একটি বাসে আগুনের ঘটনার একটি ভিডিওর দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে একজন পুলিশ সদস্যকে বোতল দিয়ে বাসের আগুনে তরল কিছু ঢালতে দেখার বিষয়টিকে পুলিশ কর্তৃক বাসে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানোর ঘটনা বলে প্রচার করা হচ্ছে।
উল্লিখিত দাবিতে ফেসবুকে ভাইরাল ছয়টি পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই প্রতিবেদন প্রকাশ অবধি ভিডিওটি প্রায় ৬ লক্ষ ১৪ হাজার ৫ শত বার দেখা হয়েছে, শেয়ার করা হয়েছে প্রায় ২৪ হাজার ১ শত ৩৪ বার। এছাড়া, এই পোস্টগুলোতে প্রায় ৩৫ হাজার ৪২ টি পৃথক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে। ভাইরাল পোস্টগুলোর মন্তব্যঘর ঘুরে পোস্টটির দাবির প্রেক্ষিতে অধিকাংশ নেটিজেনকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যায়।
উক্ত দাবির ভাইরাল পোস্টগুলো দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
একই দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে প্রকাশিত একটি পোস্ট দেখুন এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ভাইরাল ভিডিওতে ঐ পুলিশ সদস্য বোতলে করে বাসে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেননি বরং তিনি বাসের আগুন নেভানোর জন্য বোতলে করে বাসে পানি দিচ্ছিলেন।
কিভাবে ছড়ালো এ বিভ্রান্তি?
চ্যানেল ২৪ এর তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে “প্রকাশ্য দিবালোকে যাত্রী বোঝাই বাসে আগুন!” শিরোনামে মিরপুর-১০ এ প্রজাপতি বাসে আগুনের ঘটনার ১ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পোস্ট করে। তবে তাদের এই ভিডিওতে শিরোনাম ব্যতীত কোনো তথ্য উল্লেখ না করে কেবল ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে ঐ ভিডিওর পুলিশের বোতলে করে বাসের আগুনে তরল পদার্থ ঢালার দৃশ্যের ১৭ সেকেন্ড অংশ কাট করে বোতলে করে পেট্রোল ঢেলে পুলিশ আগুন লাগাচ্ছে দাবিতে ফেসবুকে প্রচার করা হয় এবং যা খুব দ্রুতই ভাইরাল হয়ে যায়।
রিউমর স্ক্যানার টিমের ভিডিও পর্যবেক্ষণ
রিউমর স্ক্যানার টিম চ্যানেল-২৪ এর ১ মিনিট ৪৩ সেকেন্ড এর ঐ ভিডিও ফুটেজটি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে, ঐ পুলিশ সদস্যের বোতলে করে তরল কিছু ঢালার আগে থেকেই বাসে আগুন জ্বলছিল এবং একাধিক ব্যক্তি ঐ পুলিশ সদস্যের আগে ও পরে বোতলে করে পানি ঢেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলেন।
চ্যানেল-২৪ এর ভিডিও পর্যবেক্ষণে যা পাওয়া যায়:
- চ্যানেল ২৪ এর আপলোড করা ঐ ভিডিওর প্রথম ২০ সেকেন্ড পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় বাসের পিছনের দিকের সিটে আগুন লাগে, ঐ স্থানের পাশে আওয়ামিলীগের শান্তি সমাবেশ থাকায় পুলিশ উপস্থিত ছিল এবং কয়েকজন পুলিশ ঐ বাসের দিকে ছুটে যাচ্ছেন। একই সময়ে বাসের যাত্রীদের দ্রুত বাস থেকে নামতে এবং হেল্পারকে পানির বোতল নিয়ে আগুন লেগে যাওয়া পিছনের সিটে দৌড়াতে দেখা যায়।
- পুলিশ সদস্য যখন বোতল থেকে তরল কিছু ঢালছিল তখন বাসের ভিতরে এক ব্যক্তির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় এবং হেল্পারের বক্তব্য থেকে জানা যায় তিনি ঐ বাসের ভিতর থেকে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছেন। তাই ঐ পুলিশ সদস্য যখন বোতল দিয়ে তরল ঢালছিলেন তখন বাসের হেল্পার ভেতরেই ছিলেন। ভিডিওর ১ মিনিট ১তম সেকেন্ড থেকে পরবর্তী ৭ সেকেন্ডে ভিতরে তার উপস্থিতি দেখা যাবে।
- ঐ পুলিশ সদস্য আসার আগে থেকেই বাসে আগুন জ্বলছিল। মূলত ঐ পুলিশ সদস্য বাসে আগুনের ঘটনা দেখে বাসের কাছে ছুটে এসেছিলেন, যা চ্যানেল ২৪ এর ভিডিওর প্রথম অংশেই দেখা যায়।
- পুলিশের আগে ও পরে এক ব্যক্তি বাইরে থেকে বোতলে করে পানি ঢেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছিলেন। এই একই কাজ ঐ পুলিশ সদস্যও করেন।
- বাসের ভেতর থেকে এক ব্যক্তিকে বোতলে করে পানি ছিটাতে দেখা যায়। হেল্পারের বক্তব্য থেকে জানা যায় তিনি আগুনের ঘটনার পরপরই বাসে থাকা পানির বোতল দিয়ে পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন।
যেহেতু পুলিশ সদস্যের তরল ঢালার দৃশ্যের আগে থেকেই বাসটিতে আগুন ছিল, তাই পুলিশ সদস্য পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগাচ্ছেন বিষয়টি এমন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পাশাপাশি ঐ পুলিশ সদস্যের বোতল দিয়ে তরল কিছু ঢালার সময় বাসের ভিতর বাসের হেল্পারও অবস্থান করছিলেন এবং পিছনে ছিল একাধিক ক্যামেরা। পাশে আওয়ামিলীগের শান্তি সমাবেশ থাকায় সেখানে সাংবাদিকদের উপস্থিতি ছিল। তাই এই দৃশ্যে পুলিশ পেট্রোল ঢালছেন এমনটা হওয়ার সুযোগ নেই। আবার পুলিশ সদস্যের তরল ঢালার আগের আগুনের উত্তাপ যেমন, সেই তরল পেট্রোল হলে উত্তাপের যে পরিবর্তন হওয়া বা বেশি হওয়ার যে প্রবণতা দেখা যাওয়ার কথা তেমনটাও ঘটেছে বলে দেখা যায়নি। এছাড়াও একাধিক ফুটেজ বিশ্লেষণ করে, বোতল থেকে তরল ঢালা ঐ পুলিশ সদস্যকে আগুন নেভানোর কাজে যুক্ত থাকতে তৎপর দেখা গেছে।
ঐ ঘটনার লাইভ ভিডিও খুঁজে পাওয়া
রিউমর স্ক্যানার টিম চ্যানেল ২৪ এর একটি লাইভ ভিডিও খুঁজে পায়। চ্যানেল ২৪ এর দুপুর ১ টার লাইভ খবরের ২ মিনিট ৫৯তম সেকেন্ডে মিরপুর-১০ থেকে যুক্ত হন চ্যানেল ২৪ এর প্রতিনিধি সুলতান মাহমুদ আরিফ। সংবাদ পাঠকের পক্ষ থেকে মিরপুরে থাকা রিপোর্টার সুলতান মাহমুদ আরিফ এর কাছে জানতে চাওয়া হয় অবরোধের পক্ষে-বিপক্ষে এখন পর্যন্ত কোনো কর্মসূচি চোখে পড়েছে কি না, যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে কি না। জিজ্ঞাসার উত্তরে ৫ সেকেন্ড বলার আগেই পিছনে প্রজাপতি বাসে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে এবং চ্যানেল ২৪ এর এই প্রতিনিধির লাইভ রিপোর্টিংয়ে আগুন লাগার পরবর্তী ঘটনা উঠে আসে।
লাইভে থাকা রিপোর্টারকে আগুন লাগার মুহুর্ত থেকে পরবর্তী সময়ে যা বলতে শোনা যায় তা নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো-
“….একটু আগে একটি বাসে আগুন দিয়েছে। এই আমি যখন আপনার সাথে কথা বলছি ঠিক সেই মুহুর্তেই। আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে প্রজাপতি পরিবহন, অর্থাৎ মিরপুর ১০ গোলচত্বরে দূর্বৃত্তরা প্রজাপতি পরিবহনে আগুন দিয়ে পালিয়ে গেছে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে বাসটিতে দাউদাউ করে ভিতরে আগুন জ্বলছে। এবং ভিতরে কয়েকজন যাত্রী ছিলেন, যাত্রীরা নেমে যায়। ঠিক গাড়িটির পাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন এবং আমরাও ঠিক যখন আপনাকে এখানকার পরিস্থিতি দেখাচ্ছিলাম ঠিক তখনই এখানে আগুনটি দেওয়া এবং সাথে সাথে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে সন্দেহজনক একজনকে আটক করে…। প্রজাপতি পরিবহনে কিন্তু আগুন জ্বলছে এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অর্থাৎ পুলিশ সদস্য যারা আছেন তারা কিন্তু বোতলে করে পানি দিয়ে আগুন নির্বাপণের চেষ্টা করছেন। যেহেতু এটি কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা, এখনও এক দেড় মিনিটও হয়নি তাই এখানে এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস আসেনি।.. কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আগুনটি লাগে এবং মূলত এরপরই পুলিশ সদস্যরা এসে আগুনটি নির্বাপণের চেষ্টা করেন।”
চ্যানেল২৪ এর লাইভের এই অংশটি গণমাধ্যমটির ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেলেও প্রচার করা হয়।
অর্থাৎ, চ্যানেল ২৪ এর লাইভ চলাকালীন সময়ে ঐ বাসে আগুনের ঘটনা ঘটে এবং সেখানে উপস্থিত রিপোর্টার জানিয়েছেন ঐ দৃশ্য পুলিশ সদস্য বোতলে করে পানি এনে আগুন নেভানোর চেষ্টার ঘটনার৷ যেহেতু তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে পানির ব্যবস্থা কিংবা ফায়ার সার্ভিস আসার সুযোগ ছিল না তাই পুলিশ সদস্য, বাসের স্টাফ এবং আশেপাশের লোকজন বোতল এবং বিভিন্ন পাত্রে আশপাশ থেকে পানি এনে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলেন।
প্রজাপতি পরিবহনের ঐ বাসে আগুন লাগার ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল থেকে মোহনা টিভির একটি লাইভ আমরা খুঁজে পাই৷ ঐ লাইভ ভিডিও পর্যবেক্ষণ করেও উপস্থিত লোকজন এবং পুলিশ সদস্যদের আগুন নেভাতে তৎপর দেখা যায়।
সুতরাং, রিউমর স্ক্যানারের পর্যবেক্ষণ এবং অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয় যে ঐ পুলিশ সদস্য ঐ দৃশ্যে আগুন নেভানোর জন্য বোতলে করে অন্যদের মতোই পানি ঢালছিলেন, পেট্রোল নয়। তাই সার্বিক বিবেচনায় আলোচিত দাবির ভাইরাল পোস্টগুলোকে বিভ্রান্তকর হিসেবে চিহ্নিত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
তথ্যসূত্র
- Rumor Scanner’s Analysis
- Channel 24 Live News
- Mohona TV live footage