ফিলিস্তিন স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে দাবিতে ছড়ালো বিভ্রান্তিকর তথ্য

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার বিষয়ে নানা সময়ে নানারকম আলোচনা হয়। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দাবি করা হচ্ছে—“আলহামদুলিল্লাহ | ২৮/০৫/২০২৪ | ফিলিস্তিন স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে।” অর্থাৎ এর মাধ্যমে গত ২৮ মে ফিলিস্তিন স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে বলে প্রচার করা হয়েছে।

ফিলিস্তিন স্বাধীন দেশ

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ২৮ মে ইউরোপের তিন দেশ আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে এবং স্পেন ফিলিস্তিনকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ বিষয়টিই দেশগুলোর নাম উল্লেখ না করে ২৮ মে ফিলিস্তিন স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে বলে প্রচার করা হয়েছে, যা অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।  ফিলিস্তিন নিজেদের মূলত ১৯৮৮ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে এবং এরপর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪৭ টি দেশ তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। 

অনুসন্ধানে কাতার ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার ২৮ মে ২০২৪ সালে “Ireland, Norway and Spain recognise Palestine. What has that changed?” শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, স্পেন, আয়ারল্যান্ড এবং নরওয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে গত ২৮ মে ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা মূলত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সম্ভাবনার স্বীকৃতি। উল্লিখিত দেশগুলো ঘোষণা করেছে, রাজধানী পূর্ব জেরুজালেম হিসেবে ১৯৬৭ পূর্ব বর্ডার অনুযায়ী ফিলিস্তিনকে তারা স্বীকৃতি দিবে। ডাবলিন (আয়ারল্যান্ড সরকার) জানিয়েছে, তারা আয়ারল্যান্ডে থাকা ফিলিস্তিনি মিশন এবং ফিলিস্তিনে থাকা আয়ারল্যান্ডের কার্যালয়ের উন্নতি ঘটাবে। অপরদিকে স্পেন ও নরওয়ে সরকার ইতোমধ্যেই এগুলো করেছে। 

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম CNN এবং অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম The Conversation কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনেও ফিলিস্তিনকে উক্ত তিন দেশের স্বীকৃতি দেওয়া বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। আল জাজিরার প্রতিবেদন অনুসারে, আশা করা হচ্ছে, এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনের অবস্থান জোরদার করবে এবং যুদ্ধ সমাপ্তিতে আলোচনায় আসতে ইসরায়েলকে চাপ প্রয়োগ করবে। 

উল্লেখ্য যে, উক্ত ইউরোপীয় তিন দেশসহ এখন পর্যন্ত সর্বমোট ১৪৫ মতান্তরে ১৪৬টি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে৷ এই প্রতিবেদন প্রকাশের আগে আরও একটি ইউরোপীয় দেশ স্লোভেনিয়ার সরকার ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব তাদের সংসদে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে। সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হলে এবং স্লোভেনিয়া ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি প্রদান করলে, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি প্রদানকারী জাতিসংঘের মোট সদস্য রাষ্ট্র সংখ্যা হবে ১৪৬ বা ১৪৭টি।

ফিলিস্তিন নিজেদেরকে ১৯৮৮ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ধাপে ধাপে সর্বমোট ১৪৫টি মতান্তরে ১৪৬টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি প্রদান করেছে। এর মধ্যে গত ২৮ মে ইউরোপের তিন দেশ স্পেন, আয়ারল্যান্ড এবং নরওয়ে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই তিন দেশের ফিলিস্তিনকে দেয়া স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এই তিন দেশের নাম উল্লেখ ছাড়াই প্রচার করায় অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। পোস্টগুলোতে ফিলিস্তিন সামগ্রিকভাবে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে বলে হচ্ছে। তবে বিষয়টা ঠিক তেমন নয়। প্রকৃতপক্ষে, নতুন করে এটি কেবল আরও তিনটি নতুন দেশের স্বীকৃতি। 

এই স্বীকৃতি ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের হামলা বন্ধ না করলেও এটি ফিলিস্তিনের কূটনীতিকদের যেকোনো আলোচনা এবং সামিটে বাড়তি প্রভাব বিস্তার করতে সাহায্য করবে। ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যেকোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে অনুমতি প্রদান করবে। এই স্বীকৃতি ফিলিস্তিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি ফিলিস্তিনকে পুরোপুরি স্বাধীনতা দিচ্ছে না, যেমনটা পোস্টগুলো প্রচার করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হতে না পারায় ফিলিস্তিন এখনও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হয় না। 

২০১২ সালে জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের মর্যাদা করা হয় একটি ‘নন মেম্বার অবজার্ভার স্টেট’। বিভিন্ন সময়ে তারা পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়ার চেষ্টা করলেও প্রতিবারই জাতিসংঘের নিরাপত্তার পরিষদের অন্যতম স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ভেটো অধিকার প্রয়োগ করে তাতে বাঁধা প্রদান করে এবং যতদিন না পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের সবাই ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্য দেওয়ার পক্ষে একমত না হবে, ততদিন পর্যন্ত ফিলিস্তিন জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র হতে পারবে না। 

সম্প্রতি গত ১০ মে ভোটাভুটির মাধ্যমে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদের দাবিদার হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়ে সংস্থাটির সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। প্রস্তাবে ফিলিস্তিনকে সদস্যপদ দেওয়ার বিষয়টি ইতিবাচকভাবে পুনর্বিবেচনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি সুপারিশ করা হয়েছে।  

যার ফলে পুনরায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্যপদ দেওয়ার বিষয়টি নতুনভাবে উত্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে ভেটোহীনভাবে এটি পাস হলে তবেই ফিলিস্তিন জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হতে পারবে এবং এর মাধ্যমে ফিলিস্তিন একটি রাস্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।

অর্থাৎ, উক্ত ইউরোপীয় তিন দেশের স্বীকৃতি ফিলিস্তিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি ফিলিস্তিনকে বহিরাগত আক্রমণ থেকে কিংবা একটি পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র বলতে যেসব ক্ষমতা বুঝানো হয় তা অধিগত করতে সক্ষম করায়নি।

তাছাড়া, ফিলিস্তিন ১৯৮৮ সালেই নিজেদেরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর পর থেকে ধাপে ধাপে বিভিন্ন রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে যার সর্বশেষ সংযোজন ইউরোপীয় তিন দেশ আয়ারল্যান্ড, স্পেন এবং নরওয়ে। উক্ত ইউরোপীয় তিন দেশের স্বীকৃতির ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনের অবস্থান আগের চেয়ে জোরদার হলেও এখনও ফিলিস্তিন একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন রাষ্ট্রের মতো সুযোগ সুবিধা বা আন্তর্জাতিক মহলে অধিকার ভোগ করতে পারবে না।

মূলত, গত ২৮ মে ইউরোপের তিন দেশ আয়ারল্যান্ড, স্পেন এবং নরওয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরবর্তী এ বিষয়টিই ফেসবুকে দেশগুলোর নাম উল্লেখ ছাড়াই ‘২৮ মে ফিলিস্তিন স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে’ বলে সামগ্রিকভাবে প্রচার ঘটে, যার ফলে ফিলিস্তিন পূর্নাঙ্গ স্বাধীনতা পেয়েছে কিনা এ বিষয়ে অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্ত তৈরি হয়। যার কারণেই রিউমর স্ক্যানার এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করছে।

সুতরাং, ইউরোপের তিন দেশের স্বীকৃতির বিষয়টি ওই তিন দেশের নাম উল্লেখ না করে ঢালাওভাবে ফিলিস্তিন স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে বলে প্রচারিত হওয়ার ফলে অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ায় রিউমর স্ক্যানার উক্ত দাবি সম্বলিত পোস্টগুলোকে বিভ্রান্তিকর হিসেবে চিহ্নিত করছে।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img