“জাপানে ২০০৯ সালে ওভারওয়েট হওয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আইন অনুসারে, চল্লিশ বয়সের ওপরে পুরুষদের কোমড় ৩১ ইঞ্চি, মহিলাদের কোমর ৩৫ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারবে। এর বেশি হলেই সাজা!” শীর্ষক একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিগত কয়েক বছর ধরে প্রচার হয়ে আসছে।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন – এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন – এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, জাপানে ওভারওয়েট নিষিদ্ধ হয় নি বরং জাপান সরকার ২০০৮ সালে আইন করে ওভারওয়েট ব্যক্তিদের কাউন্সেলিংয়ের বিধান করেছে।
কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম The Guardian এর ওয়েবসাইটে Japanese firms face penalties for overweight staff শিরোনামে ২০০৮ সালের ১৯ মার্চ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, “জাপানের কর্পোরেট দুনিয়ায় পরের মাস (এপ্রিল) থেকে চল্লিশোর্ধ্ব বয়সীদের জন্য ফ্ল্যাব চেক (চর্বি পরীক্ষা) বাধ্যতামূলক করার আইন পাস করেছে। “
গার্ডিয়ান বলছে, “স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ আশা করছে যে, পদক্ষেপগুলো মধ্যবয়সী পুরুষদের মধ্যে স্থূলতার বৃদ্ধি আটকাবে। ৪০ বছরের বেশি বয়সী (৪০ থেকে ৭৪ বছর বয়সী) সমস্ত কর্মচারী – মেটাবলিক সিন্ড্রোমের ঝুঁকিতে রয়েছে কিনা তা নির্ধারণ করতে এই পরীক্ষা (flab check) দিতে হবে। এক্ষেত্রে যাদের কোমড় ৩৩.৫ ইঞ্চির বেশি হবে তাদের ব্যায়াম এবং ডায়েট প্ল্যান দেওয়া হবে এবং জরুরী ক্ষেত্রে ডাক্তার দেখাতে বলা হবে।”
পরবর্তীতে মার্কিন সংবাদমাধ্যম The New York Times এ ২০০৮ সালের ১৩ জুন প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। পুরুষের পাশাপাশি নারীদের ক্ষেত্রে কোমড়ের মাপ ৩৫.৪ ইঞ্চির সীমা ঠিক করা হয়েছে জানিয়ে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, “অতিরিক্ত ওজনের জনসংখ্যাকে পরের চার বছরে ১০ শতাংশ এবং পরবর্তী সাত বছরে ২৫ শতাংশ সঙ্কুচিত করার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য, সরকার নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ কোম্পানি এবং স্থানীয় সরকারগুলোর উপর আর্থিক জরিমানা আরোপ করবে। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যুক্তি দেয় যে এই প্রচারণা ডায়াবেটিস এবং স্ট্রোকের মতো রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখবে।”
সে সময় এই আইন পরিচয় পায় ‘মেটাবো ল’ (Metabo Law) নামে। মেটাবলিক সিন্ড্রোম শব্দ থেকে এমন নামের উৎপত্তি।
জাপানের স্বাস্থ্য, শ্রম ও কল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ২০১৭ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকেও এই উদ্যোগের সত্যতা মিলেছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, “যাদের মেটাবলিক সিন্ড্রোমের লক্ষণ পাওয়া যাবে তাদের ছয় মাস পর্যন্ত বিভিন্নভাবে কাউন্সেলিং সেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।”
নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, স্থূলতা প্রতিরোধের ক্যাম্পেইনটি আইন পাস করার কয়েক বছর আগেই শুরু করেছিল জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে তেমন একটা সাড়া পায় নি সরকার। তাই রীতিমতো আইন করে মেটাবো শব্দ ব্যবহার এটিকে আকষর্ণীয় করে তোলা হয়েছে।
কেন এমন আইন?
বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল Nature এ ২০১৫ সালের ১৬ জুলাই প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮০ সালে জাপানে অতিরিক্ত স্থূলকায় মানুষের শতকরা হার ছিল ১৯.১ শতাংশ। তিন দশকের ব্যবধানে ২০১০ সালে এই হার প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশে। স্থূলকায় এর এই সমস্যা বাড়াচ্ছে মেটাবলিক সিন্ড্রোম রোগের ঝুঁকি।
মেটাবলিক সিনড্রোম হল ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ (উচ্চ রক্তচাপ) এবং স্থূলতার সংমিশ্রণের একটি রোগের নাম। ২০০৮ সালে যখন ‘মেটাবো আইন’ নিয়ে জাপানে আলোচনা চলছিল তখন গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল,” জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনুমান করে যে ১৩ মিলিয়ন জাপানি মেটাবলিক সিন্ড্রোমে ভুগছে এবং আরও ১৪ মিলিয়ন ঝুঁকিতে রয়েছে। মন্ত্রণালয় আশা করছে, যে তিন বছরের মধ্যে ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা 25% হ্রাস পাবে।”
অবস্থার উন্নতি ঘটেছে কতটা?
২০১৪ সালে অষ্ট্রেলিয়ান সংবাদমাধ্যম Mamamia তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মেটাবো বিরোধী হিরোকি হায়াশি নামের এক জাপানী ডাক্তারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, “আমার মতে এটি একটি ব্যর্থ উদ্যোগ। কারণ এটি কার্যকর হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে তিনি জানান, ৪০ থেকে ৭৪ বছর বয়সী ৫২ মিলিয়ন বা তার বেশি লোক যাদের বার্ষিক পরীক্ষা দিতে হয়। অর্ধেকেরও কম তা করে, সংখ্যায় যা প্রায় ২৩ মিলিয়ন। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ১২.৩ শতাংশ লোক এই চিকিৎসা পরামর্শ মেনে চলে।“
জাপানের একদল গবেষকের ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, মেটাবো আইনের ফলে জাপানিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যহারে স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত উচ্চ আয়ের মানুষদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা গেছে।
মূলত, ২০০৮ সালে জাপান সরকার Metabo Law নামে একটি আইন জারি করে। এই আইনের মাধ্যমে ৪০ থেকে ৭৪ বছর বয়সী মানুষদের জন্য Flab Check পরীক্ষার মাধ্যমে স্থূলকায় কিনা সেটি নির্ণয় করা হয়। যাদের স্থূলতা সমস্যা রয়েছে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। স্থূল ব্যক্তির কর্মস্থল এবং স্থানীয় সরকারকে জরিমানার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে আইনের বিধানে। কিন্তু এই আইনকে ওভারওয়েট নিষিদ্ধ করার আইন হিসেবে বিগত কয়েক বছর ধরে প্রচার করা হচ্ছে যা বিভ্রান্তিকর।
প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাপী এক বিলিয়নেরও বেশি মানুষ স্থূলকায়। এর মধ্যে ৬৫০ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক, ৩৪০ মিলিয়ন কিশোর এবং ৩৯ মিলিয়ন শিশু। এই সংখ্যা এখনও বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমান করছে যে ২০২৫ সালের মধ্যে, প্রায় ১৬৭ মিলিয়ন মানুষ এই তালিকায় যুক্ত হবেন।
সুতরাং, জাপানে ওভারওয়েট নিষিদ্ধ হওয়ার দাবিটি বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূ্ত্র
- The Guardian : Japanese firms face penalties for overweight staff
- The New York Times : Japan, Seeking Trim Waists, Measures Millions
- MHLW Japan : Empirical Study on the Utilization and Effects of Health Checkups in Japan