পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে প্রায়ই সংঘাতের ঘটনার ঘটে যার প্রভাব পড়ে বম সম্প্রদায়ের উপরও। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুইটি ছবি প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, “ঢাকায় পার্বত্য মেলা হচ্ছে! অন্যদিকে পাহাড়ে বম জাতিগোষ্ঠীর সাথে এইটা হচ্ছে!”
অর্থাৎ, দাবি করা হয়েছে প্রচারিত ছবিগুলো সাম্প্রতিক সময়ে বম সম্প্রদায়ের ধারণকৃত ছবি। ছবি দুইটির মধ্যে একটিতে দেখা যাচ্ছে কোনো এক বন বা পাহাড়ে একদল মানুষ অবস্থান করছে এবং অপর ছবিতে কয়েকজন নারীকে আটককৃত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে।

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বম সম্প্রদায়ের সাম্প্রতিক সময়ে ধারণকৃত ছবি দাবিতে প্রচারিত ছবি দুইটি সাম্প্রতিক সময়ের নয় বরং একটি ছবি ২০২২ সালের এবং অপরটি ২০২৪ সালের এপ্রিলের।
প্রথম ছবি যাচাই
আলোচিত দাবিতে প্রচারিত প্রথম ছবিটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ২৪ নভেম্বরের একটি প্রতিবেদনে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) এর মধ্যকার সংঘাতের কারণে অনেক পাহাড়িরা পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজেদের গ্রাম বা ঘর ছেড়ে ভারতের মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছে। প্রচারিত ছবিটির বিষয়ে বলা হয়, ছবিটিতে বাড়ি ছেড়ে চলে আসা সেসব গ্রামবাসীদের দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া, প্রতিবেদনে ২০২২ সালের নভেম্বরে পাহাড় ছেড়ে মিজোরামে আশ্রয় নেওয়া এক ব্যক্তির মন্তব্যও প্রচার করা হয়েছে। অর্থাৎ, এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে প্রচারিত ছবিটি সাম্প্রতিক সময়ের নয় বরং ২০২২ সালের।
দ্বিতীয় ছবি যাচাই
আলোচিত দাবিতে প্রচারিত দ্বিতীয় ছবিটি ‘হিল ভয়েস’ নামের একটি ওয়েবসাইটে ২০২৪ সালের ২৩ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে পাওয়া যায়।

ছবিটি সম্পর্কে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, শিশু-নারী সহ নিরীহ নাগরিকদের সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। এছাড়াও দাবি করা হয়, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক সেনাসৃষ্ট কেএনএফ সন্ত্রাসীদের দমনের নামে বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় বি এ (অনার্স) পড়ুয়া নিরীহ এক বম ছাত্রকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।” প্রচারিত ছবিটি সে সময়কার। এছাড়া, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগও প্রতিবেদনটিতে করা হয়। তবে দাবিগুলোর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে, প্রচারিত উক্ত আটকের ঘটনার ভিন্ন কোণ থেকে ধারণকৃত আরেকটি ছবি গণমাধ্যম দেশ টিভির ওয়েবসাইটে ২০২৪ সালের ২২ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদনে পাওয়া যায়।

“মায়ের সঙ্গে কারাগারে ৪ শিশু” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত উক্ত প্রতিবেদনটিতে প্রচারিত ছবিটিতে প্রদর্শিত নারীদের সম্পর্কে বলা হয়, “বান্দরবানের রুমায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সংশ্লিষ্টতার সন্দেহে আরও ৩ নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। […] পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত শনিবার (২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল) রাত ৯টার দিকে রুমার গীর্জাপাড়া থেকে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। পরে রুমা থানায় আইনি প্রক্রিয়া শেষে বান্দরবান সদর থানায় আনা হয়। আজ (২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল) আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।”
অর্থাৎ, এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে প্রচারিত দ্বিতীয় ছবিটিও সাম্প্রতিক সময়ের নয় বরং ২০২৪ সালের এপ্রিলের।
উল্লেখ্য যে, কেএনএফ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সংঘাতের কারণে ভয় ও আতঙ্কে বম জনগোষ্ঠীর লোকজন এলাকা ছাড়তে শুরু করে ২০২২ সালে শেষ দিকে। সে সময় ৫০০ জনের মত বম সদস্য প্রতিবেশী ভারতের মিজোরামে গিয়ে আশ্রয় নেয় বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়। পরে তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরিবার নিয়ে ফিরে আসেন। এরপর গত বছরের এপ্রিলের শুরুতে রুমা ও থানচিতে কয়েকটি ব্যাংকে ডাকাতরা হানা দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ দুটি ঘটনায় জড়িত পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফের সশস্ত্র সদস্যরা, যারা পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত। ডাকাতির ঘটনার পর যৌথ বাহিনীর কেএনএফ-বিরোধী অভিযানে ‘গণহারে গ্রেপ্তারের’ মধ্যে চলাফেরা, খাদ্য সংগ্রহসহ নানা বিধিনিষেধের মধ্যে পড়তে হয় বলে বমরা অভিযোগ করছিলেন। এ সময়ও বমদের পাড়াছাড়ার ঘটনা ঘটছিল।
সুতরাং, ২০২২ ও ২০২৪ সালের দুইটি পুরোনো ছবি প্রচার করে ছবিগুলো সাম্প্রতিক সময়ে বম সম্প্রদায়ের ধারণকৃত ছবি দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- The New Indian Express – Walked for three days, slept in jungle, starved: Bangladeshi refugee recounts escape to Mizoram
- Hill Voice – সেনাবাহিনী কর্তৃক নিরীহ বম ছাত্রকে গুলি করে হত্যা, শিশু-নারী সহ নিরীহ নাগরিক গ্রেপ্তার
- Desh TV – মায়ের সঙ্গে কারাগারে ৪ শিশু
- Bdnews24 – ভারতে আশ্রয় নিয়েছে ৩ হাজার বম, ৯ পাড়া খালি: রেভারেন্ড পাকসিম বম