সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারমূলক ভুয়া বিজ্ঞপ্তির ওপর কালবেলায় প্রথম পাতায় সংবাদ প্রকাশ

গত এপ্রিলের শুরুতে বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদিস নামের একটি ধর্মীয় সংগঠনের নামে ‘হিন্দু নারীদের ধর্মান্তরিত করতে পারলে পুরস্কার ঘোষণার’ একটি কথিত বিজ্ঞপ্তি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসের সভাপতি অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ ফারুক এবং সেক্রেটারী জেনারেল ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী এর সাক্ষরিত কথিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায় হিন্দু নারীদের ধর্মান্তরিত করার জন্য পুরষ্কার ধার্য করেছে জমঈয়তে আহলে হাদিস। ব্রাহ্মণ মেয়েকে ধর্মান্তরিত করলে তিন লাখ, ভারতীয় বাঙালী মেয়েকে ধর্মান্তরিত করতে পারলে দুই লাখ, মেয়ে নমশূদ্র হলে পঞ্চাশ হাজার এবং পুরো কোনো হিন্দু পরিবারকে ধর্মান্তরিত করতে পারলে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা দেখা যায় ওই বিজ্ঞপ্তিতে। 

হিন্দু নারীদের ধর্মান্তরিত করতে পারলে পুরস্কার ঘোষণার কথিত এ বিজ্ঞপ্তি গত ২ এপ্রিল ভয়েস অব বাংলাদেশি হিন্দুস এর দুটি এক্স অ্যাকাউন্টে পোস্ট হওয়ার পর ৩ এপ্রিল তা ভারতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। টুইটার তথা এক্সে হিন্দি ও ইংলিশ উভয় ভাষাতেই এ বিজ্ঞপ্তির ব্যাপক প্রচার ঘটে। ৩ এপ্রিল সকালের দিকে ওই বিজ্ঞপ্তির বিষয়টি নজরে আসে রিউমর স্ক্যানার টিমের এবং সেদিন দুপুরের মধ্যেই রিউমর স্ক্যানার টিম বিজ্ঞপ্তিটি ভুয়া বলে নিশ্চিত হয়। 

মূলত, ২০২২ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদিস এর একটি বিজ্ঞপ্তি সংগ্রহ করে তা সম্পাদনার মাধ্যমে লেখা পরিবর্তন করে ভুয়া ওই বিজ্ঞপ্তি তৈরি করা হয়েছে বলে নিশ্চিত হয় রিউমর স্ক্যানার। 

Notice comparison by Rumor Scanner 

বিজ্ঞপ্তিটি ভুয়া নিশ্চিত হওয়ার পর ৩ এপ্রিল দুপুর ৩.৫১ মিনিটে রিউমর স্ক্যানারের একজন সিনিয়র ফ্যাক্টচেকার তার ব্যক্তিগত এক্স অ্যাকাউন্টে এটিকে ভুয়া চিহ্নিত করে পোস্ট করেন এবং বিষয়টি ভারতে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হওয়ায় এর প্রচার থামাতে ও মূল তথ্য প্রচারের জন্য ভারতীয় ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান অল্ট নিউজকেও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত করেন। পরবর্তীতে ৩ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭.২০ মিনিটে অল্ট নিউজ ওই বিজ্ঞপ্তিকে ভুয়া চিহ্নিত করে “2022 notice by Bangladesh religious body morphed to show rates for converting Hindus” শিরোনামে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। 

রিউমর স্ক্যানার ফেসবুক পেজেও ওই বিজ্ঞপ্তিকে ভুয়া চিহ্নিত করে ৩ এপ্রিল রাত ১০.৫২ মিনিটে ফ্যাক্টচেক পোস্ট করা হয় এবং পরের দিন ৪ এপ্রিল এ বিষয়ে ইংরেজি ভাষায় ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ৪ ও ৫ এপ্রিল ভারতীয় আরও বেশকিছু ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান ওই বিজ্ঞপ্তিকে ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত করে ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করে। 

ওই বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে ৩ এপ্রিল জমঈয়তে আহলে হাদিসের সাথে রিউমর স্ক্যানারের যোগাযোগের পরের দিন বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদিস “বিভ্রান্ত গোষ্ঠী কর্তৃক জমঈয়তের নামে তৈরিকৃত, প্রকাশিত ও প্রচারিত ভুয়া বিজ্ঞপ্তির প্রতিবাদে বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসের বিবৃতি” শিরোনামে তাদের বিজ্ঞপ্তিকে বিকৃত করে সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারের বিষয়টি নিয়ে প্রেস বিবৃতি প্রকাশ করে।

সেসময়ে অল্ট নিউজের ফ্যাক্টচেকের পর অল্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ফ্যাক্টচেকার মোহাম্মদ জুবায়েরের একাধিক টুইট এবং Boom, India Today, The Quint সহ ভারতীয় বেশকিছু  ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানের ওই বিজ্ঞপ্তিকে ভুয়া শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রকাশের পর ভারতে এ বিজ্ঞপ্তি ছড়িয়ে পড়ার গতি মন্থর হয়ে পড়ে।

তবে এতেই শেষ হয়নি। আলোচিত ওই বিজ্ঞপ্তি ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ৪ দিন পর গত ৭ এপ্রিল উদ্বেগ প্রকাশ করে ভুয়া ওই বিজ্ঞপ্তির ওপর প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। “হিন্দু নারীদের ধর্মান্তরকরণে প্রেমের ফাঁদ: ঐক্য পরিষদের উদ্বেগ” শিরোনামের ওই প্রেস বিজ্ঞপ্তির প্রথম অংশে লেখা হয়– “বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস নামীয় এক তথাকথিত সংগঠনের সভাপতি ও সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ ফারুক ও ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গত বেশ কিছুদিন ধরে এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে চলেছে যা এতসঙ্গে সংযুক্ত করা হল, যাতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বিশেষ করে হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণে তাদের দলের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকল শিবিরদের জন্য নতুন পুরষ্কার ধার্য করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ব্রাহ্মণ মেয়েদের ধর্মান্তরকরণের জন্য তিন লক্ষ, ভারতীয় বাঙালী মেয়েদের জন্যে দুই লক্ষ, নম শুদ্র মেয়েদের জন্য পঞ্চাশ হাজার আর পুরো পরিবারের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা পুরস্কার হিসেবে দেয়া হবে কথিত ধর্মান্তরকারীদের।” 

Press release of BHBCOP based on the fake viral notice 

বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের উদ্বেগ প্রকাশ করে ভুয়া বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে দেওয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তির ওপর কালবেলা, ভোরের কাগজসহ কিছু সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ৭ এপ্রিল ওই প্রেস রিলিজের ওপর ‘হিন্দু নারীদের ধর্মান্তরকরণে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি’ শিরোনামে কালবেলার প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়–“হিন্দু নারীদের ধর্মান্তরীত করার নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে দেশজুড়ে। এ কাজে সফল হতে একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনের পক্ষ থেকে কর্মীদের জন্য রীতিমতো পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন আইডি থেকে ব্যাপক প্রচার চালানো হচ্ছে। প্রেমের ফাঁদে ফেলে সনাতন সম্প্রদায়ের নারীদের ধর্মান্তরিত করার সব কায়দা কৌশলও এসব স্ট্যাটাসে তুলে ধরা হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসব অন্যায় কর্মকাণ্ড চললেও কেন প্রতিকার মিলছে না।

একের পর এক সাম্প্রদায়িক এমন ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। রোববার (৭ এপ্রিল) পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. রাণা দাশগুপ্ত স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এ উদ্বেগ জানানো হয়েছে। সেইসঙ্গে এসব ঘটনায় দায়ীদের দ্রুত চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়েছে সংগঠনের পক্ষ থেকে।”

কালবেলার এই প্রতিবেদন পরের দিন প্রিন্ট সংস্করণেও প্রকাশিত হয়৷ 

কালবেলার এ প্রতিবেদন ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে দুইবার পোস্ট করা হয়। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি রিউমর স্ক্যানারের একজন ফ্যাক্টচেকারের নজরে আসলে তিনি গত ১৬ এপ্রিল ‘ভুয়া বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে দেওয়া প্রেস রিলিজের ওপর সংবাদ প্রকাশের’ বিষয়টি কালবেলার অনলাইন বিভাগ কর্তৃপক্ষকে অবগত করেন। তবে সেই প্রতিবেদনটি এখন পর্যন্ত তাদের ওয়েবসাইটে রয়েছে। উপরন্তু দেখা গেছে সম্প্রতি গত ৪ মে ওই বিজ্ঞপ্তিকে ভিত্তি করে এবার কালবেলার প্রিন্ট সংস্করণে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। 

Kalbela prints fake notice as 2nd Lead on front page  

এক মাস পূর্বে ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত হওয়া ওই বিজ্ঞপ্তি যুক্ত করে “ধর্মান্তরকরণে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর নতুন মিশন!” শিরোনামে পত্রিকার প্রথম পাতার দ্বিতীয় লিড হিসেবে এবারের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে কালবেলা। উক্ত প্রতিবেদনে ওই বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়– “সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে ধর্মান্তরকরণের নতুন মিশনে নেমেছে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। দাওয়াতের নামে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধর্মান্তরিত করতে রীতিমতো সংগঠনের কর্মীদের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন আইডি ও পেজ খুলে এ-সংক্রান্ত প্রচার চালানো হচ্ছে। নিজেদের কর্মীদের শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে ধর্মান্তরিত করার কলাকৌশলও।

বাংলাদেশ জমিয়তে আহলে হাদিস’ সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ ফারুক ও সেক্রেটারি জেনারেল ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী স্বাক্ষরিত একটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্প্রতি ঘুরপাক খাচ্ছে। এতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বিশেষ করে হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণে তাদের দলের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত পুরস্কার ধার্য করা হয়েছে। সংগঠনের সব জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর পাঠানো হয়েছে এর কপি। অফিসের ঠিকানায় দেওয়া আছে রাজধানীর উত্তর যাত্রাবাড়ীর ৭৯/ক/৩ বাসা। সেখানে গিয়ে কথা হয় এক ব্যক্তির সঙ্গে। তবে তিনি দাবি করেছেন, বিশেষ এই বিজ্ঞপ্তি তাদের সংগঠনের নয়। কেউ এই সংগঠনের নামে ষড়যন্ত্রে নেমেছে।”

কালবেলার ওই প্রতিবেদনের প্রতিবেদক রাজন ভট্টাচার্য প্রতিবেদনের প্রিন্ট ভার্সনের ছবি ও ক্যাপশনে লিংকসহ নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট (আর্কাইভ) করেছিলেন। পরবর্তীতে ওই বিজ্ঞপ্তিটি ভুয়া এ সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর অবশ্য তিনি পোস্টটি সরিয়ে ফেলেছেন কিংবা পোস্টের প্রাইভেসি বদল করে ফেলেন– যার ফলে তার ওই পোস্ট বর্তমানে উপলব্ধ নয়। 

Post of Kalbela reporter Rajon Bhattacharya

এর পূর্বে গত ২৪ এপ্রিল আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এএফপি এর ফ্যাক্টচেক ইউনিট ওই নোটিশকে ভুয়া শনাক্ত করে “Bangladesh organisation’s notice doctored to promote false ‘cash for Islamic conversion’ claim” শিরোনামে একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। 

সুতরাং, গত এক মাসে যে বিজ্ঞপ্তিকে দেশি ও বিদেশি বেশকিছু ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছে সেই সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারমূলক ভুয়া বিজ্ঞপ্তি যুক্ত করে সম্প্রতি প্রথম পাতায় দ্বিতীয় লিড হিসেবে সংবাদ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক কালবেলা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img