ফিলিস্তিন ইস্যুতে বেভারেজ পণ্য কোকা-কোলা বয়কটের ক্যাম্পেইন চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র। এরই প্রেক্ষিতে একটি তথ্য ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে, যাতে দাবি করা হচ্ছে, কোকা-কোলার ইংরেজি লোগোটি উল্টিয়ে লিখলে আরবিতে তার অর্থ দাঁড়ায় ‘মুহাম্মাদ নাই, মক্কা নাই’।
এমন কিছু পোস্ট দেখুন- এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
টিকটকে উক্ত দাবিতে কিছু ভিডিও দেখুন- এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
ইউটিউবে উক্ত দাবিতে ভিডিও দেখুন- এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, কোকা-কোলার ইংরেজি লোগোকে উল্টো ঘুরিয়ে পড়লে এটি আরবি ভাষায় “মুহাম্মদ নাই, মক্কা নাই” বোঝায় দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সঠিক নয় বরং, অন্তত দুই যুগের বেশি সময় ধরে কোকা-কোলার নামে এই মিথটি প্রচলিত; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে।
অনুসন্ধানের শুরুতে রিউমর স্ক্যানার কোকা-কোলার ইংরেজি লোগোটি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে, লোগোটি মিরর বা উল্টো করলে কোকো-কোলার লোগোর ‘C’ আরবি ‘لا’ এর মতো দেখতে হয়না। আরবি ‘لا’ এর অর্থ ‘না’। ‘لا’ লিখতে আরবি ‘লাম’ এর সাথে ‘আলিফ’ যুক্ত করতে হয়।
একই পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে ‘হাম সাব এক হে’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিওতেও। ২০১১ সালের ০৮ এপ্রিল ‘(Illuminati-) Arabic Coca Cola Logo Message Swabi Pakistan .flv’ শিরোনামের ভিডিওটিতে দেখা যায় কোকো-কোলার লোগো উল্টো করলে আলেচিত দাবি অর্থাৎ ‘লা মুহাম্মদ’ ‘লা মক্কা’ (বাংলায়, ‘মুহাম্মাদ নাই, মক্কা নাই’) লেখা ফুটে উঠেনা। তবে লোগোর শব্দাবলি কিছুটা পরিবর্তন করে “কোকা-কোটা” করার পর ‘লা মুহাম্মদ’ ‘লা মক্কা’ অর্থ দাঁড়ায়। অর্থাৎ, কোকা-কোলার মূল লোগোকে উল্টে দিলে আরবিতে ‘লা মুহাম্মাদ’ ‘লা মক্কা’ হয়না।
Collage: Rumor Scanner
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে কোকো-কোলার ওয়েবসাইটের একটি আর্কাইভ সংস্করণে আলোচিত দাবির বিষয়ে কোকা-কোলা কর্তৃপক্ষের একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
এই ব্যাখ্যায় দাবি করা হচ্ছে, লোগোটিকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে পড়লে এটি আরবি ভাষায় “মুহাম্মদ নেই, মক্কা নেই” -এর মতো অনুবাদ করা যায় শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা বা গুজব। কোকা-কোলা কর্তৃপক্ষ বলছে, ১৮৮৬ সালে আটলান্টায় যখন কোকা-কোলার ট্রেডমার্ক তৈরি করা হয়েছিল, তখন সেখানে আরবি ভাষার খুব কমই জ্ঞান ছিল।
এছাড়াও, আলোচিত দাবিটি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সম্মানীয় মুসলিম ধর্মীয় পণ্ডিতদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছিল এবং তারা বিস্তারিত গবেষণা করে এই গুজবের সম্পূর্ণ খণ্ডন করেছেন দাবি করে কোকা-কোলা কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে সৌদি আরবে ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশেষ কমিটি কোকা-কোলার লোগোর বিরুদ্ধে গুজব পর্যালোচনা করার জন্য গঠিত হয়েছিল। কমিটি নিশ্চিত করে যে এই মিথ্যা অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই এবং কোকা-কোলার ট্রেডমার্ক ইসলামের জন্য কোনো কুৎসা নির্দেশ করে না।’
একই ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০০ সালের মে মাসে মুসলিম বিশ্বের প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আল-আজহারের গ্র্যান্ড মুফতি শেখ নাসের ফারিদ ওয়াসেল বলেছেন, “ট্রেডমার্কটি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ইসলাম বা মুসলমানদের ক্ষতি করে না।”
এই বিষয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির ওয়েবসাইটে ২০০০ সালের ১৩ মে ‘Muslim cleric defends Coke’ শীর্ষক শিরোনামে একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, ‘মিশরের সবচেয়ে সম্মানিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের একজন শেখ নাসর ফারিদ ওয়াসেল কোকা-কোলার লোগো মুসলমানদের জন্যে আপত্তিকর হতে পারে – এমন অভিযোগের নিন্দা জানিয়েছেন বলে জানা গেছে।’
মুফতি ওয়াসেলকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, এগুলো গুজব মাত্র, ফাঁকা গল্প, যা মিসরে কোকা-কোলায় কাজ করা হাজার হাজার লোকের চাকরির উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
একইদিন জর্ডানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল বাউআবা’র ওয়েবসাইটে ‘Egyptian Mufti Hits at Rumors of Anti-Islamic Coke’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনেও একই তথ্য পাওয়া যায়।
কোকা-কোলার লোগো নিয়ে আলোচিত এই দাবির বিষয়ে আন্তর্জাতিক ইসলামি পণ্ডিত মুফতি ডাঃ ইসমাইল মেঙ্কের একটি বক্তব্য পাওয়া যায়। বক্তব্যে তিনি বলেন, “কোকা-কোলা। ইংরেজিতে লেখা আছে C-O-C-A এবং C-O-L-A। কেউ কেউ বলে এটা পান করা যাবে না, কারণ এটি কিছু বলে। কিন্তু দেখার সময় এটি কীভাবে বলে? তারা বলে এটিকে উল্টা করে আয়নায় রাখুন এবং দেখুন এটি কী রকম লাগে। তারপর তারা বলে ওহ দেখুন এটা কি লেখা আছে! কিন্তু আল্লাহ্ আপনাকে জিনিসপত্র উল্টা করে দেখতে বলেননি, এগুলোকে অন্য দিক থেকে দেখে এগুলো কী লেখা আছে বের করতে বলেননি। আমি যদিও অনেকভাবে কোকা-কোলা ব্যাপারটাকে খণ্ডন করতে পারি, কিন্তু আমি আপনাকে শুধু এটাই বলছি এটি “লা মুহাম্মদ লা মক্কা” নয় এবং আপনি এসব করতে বাধ্য নন।”
বহুল আলোচিত এই দাবিটির বিষয়ে জানতে রিউমর স্ক্যানার কথা বলেছে সৌদি আরবের ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান নো রিউমারস এর প্রতিষ্ঠাতা রায়ান আদিলের সাথে। রায়ান বলছেন, ‘এটা একটি পুরোনো হাস্যকর গুজব, যা সত্য নয়’।
মূলত, ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন কোম্পানিকে পণ্য বয়কটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এই ইস্যুকে ঘিরে কোকা-কোলা ইসরায়েলের পণ্য এমন অভিযোগ তুলে বাংলাদেশেও পণ্যটি বয়কটের ক্যাম্পেইন চলছে। এরই প্রেক্ষিতে কোকো-কোলার লোগো নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে, ইংরেজি লোগোটির প্রতিবিম্ব বা উল্টো লেখা আরবিতে ’মুহাম্মাদ নাই’ ‘মক্কা নাই’ অর্থ হয়। তবে, রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, কোকা-কোলার লোগো নিয়ে আলোচিত দাবিটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, দুই যুগের বেশি সময় ধরে প্রচার হয়ে আসা এই দাবিটি সত্য নয় বলে কোকা-কোলা কর্তৃপক্ষসহ একাধিক ইসলামিক স্কলার নিশ্চিত করেছেন।
সুতরাং, কোকা-কোলার লোগোটিকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে পড়লে এটি আরবি ভাষায় “মুহাম্মদ নাই, মক্কা নাই” বোঝায় দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Coca-Cola Rumors & Facts: Anti-Muslim messages appear in graphics (No Mohammed, No Mecca)
- BBC NEWS: Muslim cleric defends Coke
- Al Bawaba: Egyptian Mufti Hits at Rumors of Anti-Islamic Coke
- Mufti Ismail Menk – Maldivian Fans Page : Coca Cola is not Laa Muhammad Laa Makkah – Mufti Menk
- Rumor Scanner’s Own Analysis