সম্প্রতি ‘ইতিহাসের তিনটি জানাজার নামাজ’ শীর্ষক দাবিতে তিনটি জানাজার দৃশ্য সম্বলিত একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।

ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন পোস্ট (আর্কাইভ), পোস্ট (আর্কাইভ), পোস্ট (আর্কাইভ), পোস্ট (আর্কাইভ), পোস্ট (আর্কাইভ), পোস্ট (আর্কাইভ)।

টিকটকে প্রচারিত এমন কিছু ভিডিও দেখুন ভিডিও (আর্কাইভ), ভিডিও (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জানাজার ছবির সাথে প্রচারিত ছবিগুলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানের জানাজার ছবি নয়। প্রকৃতপক্ষে, জিয়াউর রহমানের জানাজার দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ছবিটি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জানাজার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জানাজার দৃশ্যটি একটি চলচ্চিত্রের অংশ। তাঁর জানাজার কোনো প্রকৃত ছবি বা ভিডিও ইন্টারনেট বা অন্য কোনো সূত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না।
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জানাজার দৃশ্যের ছবিটি সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
গত ১৪ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া জামায়েত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জানাজা গত ১৫ আগস্ট পিরোজপুর জেলার বাইপাস সড়কে সাঈদী ফাউন্ডেশন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়।
এই জানাজার দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ছবিটির সত্যতা যাচাইয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে Mohin Kholil নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গত ১৫ আগস্ট ‘মুকুটহীন রাজার রাজকীয় বিদায় । আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জানাজা নামাজের সময়ের দৃশ্য‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।
এই ভিডিওটির শুরুতেই দৃশ্যমান ফুটেজের সঙ্গে সাঈদীর জানাজার দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ছবিটির মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

একই জানাজা নিয়ে আরও ভিডিও দেখুন এখানে।

অর্থাৎ সাঈদীর জানাজার দৃশ্য দাবিতে যে ছবিটি প্রচার করা হচ্ছে, সেটি তার জানাজারই।
জিয়াউর রহমানের জানাজার দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ছবিটির সত্যতা যাচাই
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, জিয়াউর রহমানের জানাজার দৃশ্য দাবিতে যে ছবিটি প্রচার করা হচ্ছে, সেটি মূলত জিয়াউর রহমানের জানাজার নয়।

রিউমর স্ক্যানারের দীর্ঘ অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, জিয়াউর রহমানের জানাজার দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ছবিটি ১৯৬৩ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জানাজার ছবি। অপরদিকে জিয়াউর রহমানের জানাজা হয়েছিলো মানিক মিঞা এভিনিউতে।
এ নিয়ে ২০২২ সালে প্রকাশিত রিউমর স্ক্যানারের বিস্তারিত অনুসন্ধান পড়ুন
এই ছবিটি জিয়াউর রহমানের জানাজার নয়
বঙ্গবন্ধুর জানাজার দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ছবিটির সত্যতা যাচাই
অনুসন্ধানের এ পর্যায়ে রিউমর স্ক্যানার টিম বঙ্গবন্ধুর জানাজার দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ছবিটির সত্যতা যাচাই করে।
এ নিয়ে যাচাইয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে জেলা তথ্য অফিস, ঝালকাঠির ইউটিউব চ্যানেলে ২০২২ সালের ১১ আগস্ট ‘চলচ্চিত্র: আগস্ট ১৯৭৫‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত চলচ্চিত্রের ১ ঘন্টা ২৮ মিনিট সময়কালে বঙ্গবন্ধুর জানাজার দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়।

অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর জানাজার দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ছবিটি একটি চলচ্চিত্রের অংশ, কোনো বাস্তব দৃশ্য নয়।
বঙ্গবন্ধুর জানাজায় প্রকৃতপক্ষে কত মানুষ ছিল?
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয় যে, জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জানাজার দৃশ্যের সাথে জিয়াউর রহমান ও বঙ্গবন্ধুর জানাজার দৃশ্যের তুলনা আনা হয়েছে প্রকৃতপক্ষে এই তিনজনের জনপ্রিয়তা বুঝাতে৷
যদিও ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, জিয়াউর রহমানের জানাজার দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ছবিটি তার জানাজার নয়। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর জানাজার দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ছবিটি একটি চলচ্চিত্রের অংশ, কোনো বাস্তব দৃশ্য নয়। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত পোস্টগুলোতে বঙ্গবন্ধুর জানাজার তারিখও ভুলভাবে প্রচার করা হচ্ছে।
এ নিয়ে অনুসন্ধানে বঙ্গবন্ধুর জানাজার কোনো বাস্তব ছবি বা ভিডিও ফুটেজ খুঁজে পাওয়া যায় না।
তবে ইতিহাসের বিবরণী থেকে বঙ্গবন্ধুর জানাজার বিভিন্ন বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায়।
যেমন, ১৯৭৫ সালে ঢাকা সেনানিবাসে স্টেশন কমান্ডারের দায়িত্বে থাকা লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল হামিদ পি.এস.সি’র লেখা ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা‘ বইয়ে বঙ্গবন্ধুর জানাজার একটি চিত্র পাওয়া যায়।
এ প্রসঙ্গে বইটিতে আব্দুল হামিদ লিখেন, বঙ্গবন্ধুর মরদেহ ঢাকা থেকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার যোগে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হামলার আশংকায় হেলিকপ্টারটি ছিল অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত। এই হেলিকপ্টার যখন টুঙ্গিপাড়ায় পৌঁছায় তখন আশপাশের লোকজন ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল হামিদ আরও লিখেন, বঙ্গবন্ধুর লাশ বয়ে নিয়ে যাওয়া হেলিকপ্টারটির দায়িত্বে থাকা মেজর মহিউদ্দিন পুলিশের সহায়তায় কোনোক্রমে ১৫/২০ জন লোক জানাজার জন্য জড়ো করতে সক্ষম হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর জানাজার আরেকটি বর্ণনা পাওয়া যায় কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের লেখা ‘আগস্টের একরাত’ বই থেকে। ‘আগস্টের একরাত’ বইটি বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের হত্যাকান্ডের পটভূমিতে রচিত হিউম্যান ট্রাজেডির উপাখ্যান।
এ হত্যাকান্ডের বিচারে ৬১ জন সাক্ষী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। এমনই একজন সাক্ষীর মুখ থেকে বইটিতে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর জানাজার দৃশ্য।
বইটির ২২৪ পৃষ্ঠায় ১৯৭৫ সালে টুঙ্গিপাড়া শেখ সায়রা খাতুন রেডক্রস হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় হিসেবে চাকরি করা আব্দুল হাই নামে এক ব্যক্তির জবানবন্দী খুঁজে পাওয়া যায়।

আব্দুল হাইয়ের জবানবন্দি থেকে বঙ্গবন্ধুর জানাজার যে বিবরণ পাওয়া যায়, সে অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর জানাজা হয় ১৬ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর দাফনকাজ সব পুলিশের সামনেই করা হয়েছে। এসময় বাইরে হাজার হাজার লোক ছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাইরের লোক ভিতরে আসতে বাধা দেয়। ফলে ভিতরে যারা ছিল, তারাই কেবল জানাজায় অংশ নেয়।

আব্দুল হাইয়ের জবানবন্দি থেকে আরও জানা যায়, যে স্থানে বঙ্গবন্ধুর জানাজা হয়েছিল সেখানে আরও ২ হাজারের মতো লোকের জায়গা হতো। তবে সব লোক সংকুলান করা যেত না সেখানে।
বঙ্গবন্ধুর জানাজার আরও বর্ণনা পাওয়া যায় ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর দাফনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তৎকালীন পুলিশ সদস্য (কনস্টেবল) নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কাজী সিরাজুল ইসলামের বর্ণনা থেকে।
২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি তিনি নিজ বাড়িতে সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধুকে গোসল করানোসহ দাফন-কাফনের সেদিনের ঘটনা।
এসময় বঙ্গবন্ধুর জানাজা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জানাজায় ২০-২৫ জন লোক ছিলাম। পুলিশ স্টাফ আর হাসপাতালের লোক জানাজায় অংশ নিলেন। জনসাধারণকে জানাজায় অংশ নিতে দেয়া হয়নি।

এ সকল বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বঙ্গবন্ধুর জানাজায় প্রকৃত অর্থেই অল্প লোকের উপস্থিতি ছিল। একইসাথে সে সময়কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও ছিল ভিন্ন।
মূলত, গত ১৪ আগস্ট রাতে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যুদ্ধাপরাধের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মারা যান। পরবর্তীতে ১৫ আগস্ট পিরোজপুরে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে তার জনপ্রিয়তা বুঝাতে এই জানাজার একটি চিত্রের সাথে বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানের জানাজার দৃশ্য দাবিতে দুইটি চিত্র জুড়ে দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়। তবে এ নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, জিয়াউর রহমানের জানাজার দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ছবিটি প্রকৃতপক্ষে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জানাজার দৃশ্য এবং বঙ্গবন্ধুর জানাজার দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ছবিটি একটি চলচ্চিত্রের অংশ; কোনো বাস্তব দৃশ্য নয়।
উল্লেখ্য, দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যুকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত একাধিক গুজব নিয়ে ফ্যাক্টচেক করেছে রিউমর স্ক্যানার।
এ নিয়ে বিস্তারিত ফ্যাক্টস্টোরি দেখুন-
সাঈদীর মৃত্যু: পুরোনো ছবি-ভিডিও আর ভুল তথ্যে একদিন
সুতরাং, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জনপ্রিয়তা বুঝাতে তার জানাজার ছবির সাথে বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানের জানাজা দশ্যের তুলনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ছবিটি সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Mohin Kholil: মুকুটহীন রাজার রাজকীয় বিদায় । আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জানাজা নামাজের সময়ের দৃশ্য
- Mukto Bangla Channel UK: আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জানাজায় লক্ষ মানুষের ঢল
- Rumor Scanner: এই ছবিটি জিয়াউর রহমানের জানাজার নয়
- RTV: ‘বঙ্গবন্ধুকে ৫৭০ সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে দু চোখে পানি এসে যায়’
- তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল হামিদ পি.এস.সি,
- আগস্টের একরাত, সেলিনা হোসেন