সম্প্রতি, সুইস ব্যাংক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ফটোকার্ড পোস্ট করে দাবি করা হয়েছে, সুইস ব্যাংক কখনো গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ করে না।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সুইস ব্যাংক কখনো গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ করে না শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয় বরং ইতোমধ্যে একাধিকবার সুইস ব্যাংক থেকে গ্রাহকদের গোপনীয় তথ্য ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
সুইস ব্যাংক সবচেয়ে সুরক্ষিত ব্যাংকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। গ্রাহকদের পরিচয় এবং তথ্য গোপন রাখার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যাংক এটি। সুইস ব্যাংক একক কোনো ব্যাংক নয়। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোই সুইস ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। ১৭১৩ সালে সুইস সরকার গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ না করতে ব্যাংকগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আইন করে। সেখান থেকেই এই ব্যাংকের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টির উদ্ভব হয়।
১৯৩৪ সালে সুইজারল্যান্ড ব্যাংক ও সেভিংস ব্যাংকগুলো নিয়ে একটি ফেডারেল আইন জারি করে যা দ্য ব্যাংকিং ল অব ১৯৩৪ বা সুইস ব্যাংকিং অ্যাক্ট নামে পরিচিত। আইনটির সবচেয়ে বহুল চর্চিত আর্টিকেল ৪৭-এ গ্রাহকদের তথ্য কারো কাছে প্রকাশ করাকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কোনো অপরাধের অভিযোগ ছাড়া গ্রাহকদের অনুমতি ব্যতীত সরকারের কাছেও এসব তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর ব্যাংকিং গোপনীয়তা আইনগুলোর মধ্যে অন্যতম এই আর্টিকেল ৪৭।
তবে পরবর্তী সময়ে এই ব্যাংকের তথ্য ফাঁস হওয়ার খবর পাওয়া যায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের ওয়েবসাইটে ২০১৮ সালের ০৫ অক্টোবর ‘Era of bank secrecy ends as Swiss start sharing account data’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ট্যাক্স ফাঁকি রোধে সুইস ব্যাংক বিভিন্ন দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে গ্রাহকদের তথ্য শেয়ার করে।
সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান Money Land এর ওয়েবসাইটে ২০২৩ সালের ১১ অক্টোবর ‘Swiss Bank Secrecy Explained’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সুইস ব্যাংকের গোপনীয়তা ২০১৭ সালে ব্যাপক পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়। সে সময় সুইজারল্যান্ড সরকার বিভিন্ন দেশের সরকারের সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যাংক গ্রাহকের তথ্য শেয়ারের চুক্তিতে প্রবেশ করে। এমন অনেক ক্ষেত্রে রয়েছে যেখানে সুইস ব্যাংকের গ্রাহক গোপনীয়তা প্রযোজ্য নয়। ব্যাংকগুলো যদি মানি লন্ডারিং সন্দেহ করে, সেক্ষেত্রে তাদেরকে মানি লন্ডারিং রিপোর্টিং অফিসের সাথে গ্রাহকের তথ্য শেয়ার করার অনুমতি দেওয়া হয়৷
অর্থাৎ, সুইস ব্যাংক গ্রাহকের গোপনীয় তথ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে শেয়ার করে।
এছাড়াও, ২০২২ সালে সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচারের বড় কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম The New York Times এর ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ‘Vast Leak Exposes How Credit Suisse Served Strongmen and Spies’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, একটি সুইস ব্যাংকের ১৮ হাজার অ্যাকাউন্টের তথ্য ফাঁস হয় সে সময়। সুইজারল্যান্ডের বিনিয়োগ ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট সুইসের ওই ১৮ হাজার অ্যাকাউন্টের তথ্য ফাঁস করেছেন একজন হুইসেল ব্লোয়ার।
উক্ত প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ফাঁস হওয়া অ্যাকাউন্টে সম্পদের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। এ অ্যাকাউন্টগুলো ১৯৪০ থেকে ২০১০ এর দশকের মধ্যে খোলা হয়েছে । জার্মানির একটি সংবাদপত্র তথ্যগুলো পাওয়ার পর তা নিউইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান ও লে মুন্ডেসহ ৪৬টি গণমাধ্যমের কাছে সরবরাহ করে।
পরবর্তীতে ব্রিটিশ গণমাধ্যম The Guardian এর ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ‘Revealed: Credit Suisse leak unmasks criminals, fraudsters and corrupt politicians’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকেও এ বিষয়ে একই তথ্য জানা যায়।
মূলত, সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের একাধিক পেজ, গ্রুপ ও ব্যাক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচারিত এক ফটোকার্ডে দাবি করা হয়েছে, সুইস ব্যাংক কখনো গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ করে না। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত দাবিটি সঠিক নয় বরং ইতোমধ্যে একাধিকবার সুইস ব্যাংক থেকে গ্রাহকদের গোপনীয় তথ্য ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
সুতরাং, ‘সুইস ব্যাংক কখনো গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ করে না’ শীর্ষক তথ্যটি বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- India Times: What Are Swiss Banks And Why Do They Maintain Secrecy
- REUTERS: Era of bank secrecy ends as Swiss start sharing account data
- Money Land: Swiss Bank Secrecy Explained
- The New York Times: Vast Leak Exposes How Credit Suisse Served Strongmen and Spies
- The Guardian: Revealed: Credit Suisse leak unmasks criminals, fraudsters and corrupt politicians
- Rumor Scanner’s Own Analysis