সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওসি প্রদীপের জেল থেকে পালানোর বিভ্রান্তিকর দাবি

সম্প্রতি ওসি প্রদীপ কোথায়, জানে না চট্টগ্রাম নগর পুলিশ! হায়রে রাষ্ট্র রেহ! শীর্ষক শিরোনামে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত হচ্ছে। এই শিরোনামের ফলে মাধ্যমটির ব্যবহারকারীদের অনেকেই বিভ্রান্ত হওয়ার উদাহরণ পাওয়া গেছে। বিভ্রান্তির ফলে-ই কয়েকটি দাবি পাওয়া যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটিতে। 

Screenshot: facebook

ফেসবুকে প্রচারিত এমনকিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এবং এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে। 

দাবি (বিভ্রান্তির নমুনা)

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্যকারীদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ব্যবহারকারী মূল বিষয়টি বুঝতে পারলেও অধিকাংশ মন্তব্যকারী-ই বিভ্রান্ত হয়েছেন। এই বিভ্রান্তির ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কয়েক ধরণের দাবি পাওয়া যায়, যেমনঃ

  • ওসি প্রদীপ বাংলাদেশের কোনো জেলে নেই, বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। 
  • ওসি প্রদীপ পালিয়ে গেছে সেই ঘটনা রাষ্ট্র জানেনা।
  • বিভিন্ন কারণে তাকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে (পরোক্ষভাবে)। 

এছাড়াও এজাতীয় পোস্টের বা সংবাদের প্রেক্ষাপটে আরো বিভিন্ন ধরণের দাবিতে মন্তব্য পাওয়া যায় ।

Image: Collage by Rumor Scanner

শুধু মন্তব্য-ই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সংবাদটি শেয়ার করে ওসি প্রদীপ জেলে নেই এমন দাবি সত্য হিসেবে প্রতিক্রিয়া সম্বলিত ক্যাপশন জুড়ে দেওয়া পোস্টও পাওয়া যায়।

Screenshot: Facebook/Shamsul Alam

যে কারণে বিভ্রান্তি

শুধুমাত্র শিরোনাম পড়ে সংবাদের বিষয়ে ধারণা নেওয়া এই বিভ্রান্তি সৃষ্টির অন্যতম কারণ। এছাড়াও ধারণা করা যায়, মন্তব্যকারীরা ভেবেছেন চট্টগ্রাম বিভাগের ঘটনার কারণে ওসি প্রদীপ বিভাগীয় শহর চট্টগ্রামের জেলে থাকার কথা এবং সে বিষয়ে সেখানকার পুলিশ অবগত থাকার কথা। যেহেতু সেখানকার পুলিশ ওসি প্রদীপের বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য বলতে পারছেনা (শিরোনাম অনুযায়ী) তার মানে তিনি জেলে নেই বা পালিয়ে গেছেন। 

অবশ্য আলোচিত সংবাদটির (মূল সংবাদটি) বিস্তারিত অংশ পড়লে পাওয়া যায় যে, ওসি প্রদীপ বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আছেন। অন্য একটি কেসের বিষয়ে আদালত ওসি প্রদীপের ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ “সে সময় নগর পুলিশে কর্মরত প্রদীপ এখন কোথায় আছেন, তা জানা যাচ্ছে না” লিখে জবাব দেওয়ায় এই বিভ্রান্তির তৈরি হয়েছে।

Screenshot: Prothom Alo

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ওসি প্রদীপ “জেলে নেই” কিংবা পালিয়ে গেছেন শীর্ষক দাবি সত্য নয় বরং ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী ওসি প্রদীপ বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আছেন।

বিভ্রান্তির শুরু যেভাবে

অনুসন্ধানে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলোয় গত ৫ই মার্চ “ওসি প্রদীপ কোথায়, জানে না চট্টগ্রাম নগর পুলিশ” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছে পত্রিকাটির প্রিন্ট সংস্করণেও।

Image: Facebook/Abdul Kader

পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন প্রোফাইল ও পেজ থেকে শুধুমাত্র প্রথম আলোর শিরোনামটুকু পোস্ট করায় বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে শিরোনামের (তথ্যের) সাথে সোর্স হিসেবে প্রথম আলোর নামও জুড়ে দিয়েছে।

অনুসন্ধান

প্রথম আলোর আলোচিত প্রতিবেদনটি বিস্তারিত পড়ে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। প্রতিবেদনের শুরুর দিকেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ওসি প্রদীপ জেলে আছেন। 

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মানলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া কক্সবাজারের টেকনাফ থানার বরখাস্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ আড়াই বছর ধরে কারাগারে আছেন। তিনি বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আছেন। 

Screenshot: Prothom Alo

পাশাপাশি প্রতিবেদনটিতে আরো উল্লেখ করা হয় যে, “ সিনহা হত্যা মামলায় ২০২০ সালের ৬ আগস্ট প্রদীপকে কারাগারে পাঠান আদালত। সেই থেকে তিনি কারাগারে। বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন প্রদীপের আইনজীবী সমীর দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, প্রদীপ এখন কাশিমপুর কারাগারে আছেন।

এছাড়াও, ইন্টারনেটে এবং গণমাধ্যমে ওসি প্রদীপের শাস্তির তথ্য ব্যতীত পালিয়ে যাওয়া বিষয়ক কোনো তথ্য পাওয়া যায়না। অর্থাৎ, ওসি প্রদীপ জেল থেকে পালিয়ে যাননি।

মূলত, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই টেকনাফের বাহারছড়া তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এই হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া কক্সবাজারের টেকনাফ থানার বরখাস্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ আড়াই বছর ধরে কারাগারে আছেন। অন্যদিকে প্রায় ২৪ বছর আগের চট্টগ্রাম চান্দগাঁও থানা এলাকায় ডাকাতের গুলিতে এক ব্যক্তি নিহত হওয়ার মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন চন্দগাও থানায় তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এস আই) আলোচিত ওসি প্রদীপ। মামলায় তাকে সাক্ষ্য দিতে আদালতের হাজির হওয়ার চিঠির জবাবে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ জানিয়েছেন, ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত নথি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। তাই সে সময় নগর পুলিশে কর্মরত প্রদীপ এখন কোথায় আছেন, তা জানা যাচ্ছে না। এই জবাবের উপর ভিত্তি করে প্রথম আলোর প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে।

উল্লেখ্য, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে-ও ইতোপূর্বে বেশকিছু ফ্যাক্ট-চেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।  

সুতরাং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁসির আসামী ওসি প্রদীপ জেলে নেই কিংবা জেল থেকে পালিয়ে গেছেন শীর্ষক মন্তব্য প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img