সম্প্রতি শিশুদের উপর মায়েদের মোবাইল ব্যবহারের প্রভাব সম্পর্কে চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণার উপর ভিত্তি করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উক্ত প্রতিবেদনটিকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশের একাধিক মূলধারার গণমাধ্যম “স্মার্টফোনে আসক্ত মায়েদের সন্তান কথা বলে কম: গবেষণা” শীর্ষক দাবিতে সংবাদ প্রকাশ করেছে। তারা দাবি করে, গবেষণার বরাতে ডেইলি মেইল জানিয়েছে, যেসব মায়েরা স্মার্টফোনে বেশি আসক্ত তাদের সন্তান কথা কম বলে। তাদের শিশু সন্তানের ভাষা ঠিকমতো বিকশিত হয় না। ফলে তারা কথা কম বলে।
উক্ত দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ দেখুন: প্রথম আলো (এক্স), ঢাকা ট্রিবিউন, ডেইলি ক্যাম্পাস, চ্যানেল২৪, দৈনিক আমাদের সময়, সংবাদ প্রকাশ।
উক্ত দাবিতে গণমাধ্যমের ফেসবুক পেজসহ ফেসবুকে প্রচারিত অন্যান্য পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন : এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ডেইলি মেইলের প্রতিবেদন বা গবেষণায় কোথাও বলা হয়নি শিশুরা কথা কম বলে। বরং বলা হয়েছে স্মার্টফোনে আসক্ত থাকা মায়েরা কথা কম বলেন যার ফলশ্রুতিতে তাদের সন্তানের ভাষা বিকাশ বাধাগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷ তাছাড়া, ক্ষতিগ্রস্ত করবেই এমন কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি৷ বরং সম্ভাবনা রয়েছে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের প্রাথমিক পর্যায়ে গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত সংবাদে ‘ডেইলি মেইল’ এর একটি প্রতিবেদনকে তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করতে দেখা যায়।
অনুসন্ধানের পরবর্তী পর্যায়ে, “Mums who are obsessed with their smartphone talk to their children less, study finds – which may hinder their language development” শিরোনামে গত ২৭ জুন তারিখে প্রকাশিত ডেইলি মেইলের উক্ত প্রতিবেদনটি খুঁজে পায় রিউমর স্ক্যানার টিম।
প্রতিবেদনটি পড়ে জানা যায়, চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার বরাতে ডেইলি মেইল জানিয়েছে, নতুন মা হওয়া নারীরা যারা ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইল ব্যবহার করেন তারা সন্তানদের সাথে কথা কম বলেন এবং ফলশ্রুতিতে এটি শিশুর ভাষা বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, যখন মায়েরা মোবাইল ব্যবহার করেন তখন সন্তানদের সাথে সর্বোচ্চ ২৬ শতাংশ পর্যন্ত কথা কম বলেন। গবেষকরা মা-বাবাকে মেসেজ, কল কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ক্রল করার সময় তাদের সন্তানের প্রয়োজনের খোঁজখবর রাখতে উপদেশ দিয়েছেন।
ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের গবেষকরা এজন্য ১৬ জন মা ও তার সন্তানকে নিয়োগ দেন। গড়ে সন্তানদের বয়স ছিল চার মাস এবং তারা ছোট একটি অডিও রেকর্ডার পরিধাণ করছিল এবং তাদের মায়ের মোবাইল স্মার্টফোন লগের দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা হয়। গবেষণাটিতে ব্যবহারের জন্য এক সপ্তাহে সর্বমোট ১৬ হাজার মিনিটেরও বেশি সময়ের মোবাইল ব্যবহার এবং অডিও ডাটার সামঞ্জস্য বা সমাপতিত করা হয়৷ বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, মোবাইল ব্যবহার করার কারণে মায়েরা তাদের সন্তানকে প্রতি মিনিটে ১৬ শতাংশ পরিমাণ শব্দ কম বলেছেন৷ তাছাড়া দেখা যায়, মোবাইল ব্যবহারের পদ্ধতিভেদে এটি ২৬ শতাংশও হতে পারে।
এর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে মেইল অনলাইনে গবেষণাটির একজন গবেষক প্রফেসর কায়া ডে বারবারো জানিয়েছেন, যখন মানুষ লম্বা সময় ধরে মোবাইল ব্যবহার করেন, তারা হয়তো ফোন কল বা ভিডিও কলের জন্য মোবাইল ব্যবহার করছেন যেখানে কথাবার্তা বেশি বলা হয়, এমনটা হওয়ার বেশি সম্ভাবনা থাকে।
এছাড়া, প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, পূর্ববর্তী গবেষণা ইঙ্গিত বা নির্দেশ দিয়েছে, শিশুদের সাথে খুবই কম বয়স থেকেই কথা বলা গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে শিশুদের ভাষা এবং যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
তাছাড়া, গত ২৬ জুন “Mothers speak less to infants during detected real-world phone use” শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণাপত্রটির Abstract পড়লে জানা যায়, মোবাইল ব্যবহার এবং একটা দীর্ঘ সময় ধরে সন্তানদের সাথে মায়ের কথা বলার বাস্তব সময়ের সংযোগ নিয়ে করা গবেষণা এটিই প্রথম। এটিতে ১৬ জন মা ও তার সন্তানকে নিয়ে গবেষণা করা হয় যাদের মধ্যে ৭৫% ছিলেন শ্বেতাঙ্গ। সন্তানদের গড় বয়স ৪.১ মাস (সন্তানদের প্রকৃত বয়স এর চেয়ে ২.৩ মাস কম বা বেশি এর মধ্যে ছিল) যার মধ্যে ৬৩ শতাংশ সন্তান মেয়ে শিশু। গবেষণাটিতে ১৬,৬৭৩ মিনিটের ডাটা ব্যবহার করা হয়। গবেষণাটিতে দেখা যায়, মায়েদের মোবাইল ব্যবহারের ফলে সন্তানরা ১৬% কথা কম শুনতে পায় যা পদ্ধতিভেদে ২৬ শতাংশও হতে পারে।
উল্লেখ্য, মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলো প্রথমে “মায়ের স্মার্টফোন আসক্তি থাকলে সন্তান কথা কম বলে” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করলেও পরবর্তীতে তারা সংবাদটি সংশোধন করে এবং “মায়ের স্মার্টফোন আসক্তি থাকলে শিশুর ভাষার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে” শিরোনামে পরবর্তীতে সংশোধিত সংবাদ প্রকাশ করে।
মূলত, সম্প্রতি শিশুদের উপর মায়েদের মোবাইল ব্যবহারের প্রভাব সম্পর্কে চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণার উপর ভিত্তি করে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উক্ত প্রতিবেদনটিকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশের একাধিক মূলধারার গণমাধ্যম “স্মার্টফোনে আসক্ত মায়েদের সন্তান কথা বলে কম: গবেষণা” দাবিতে সংবাদ প্রকাশ করেছে। তারা দাবি করে, গবেষণার বরাতে ডেইলি মেইল জানিয়েছে, যেসব মায়েরা স্মার্টফোনে বেশি আসক্ত তাদের সন্তান কথা কম বলে। তাদের শিশুসন্তানের ভাষা ঠিকমতো বিকশিত হয় না। ফলে তারা কথা কম বলে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রটির বরাতে ডেইলি মেইল জানায় মোবাইল ব্যবহারের ফলে মায়েরা কথা কম বলে এবং এর ফলে সন্তানদের ভাষা বিকাশ বাধাগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷ গবেষণাটিতে সন্তানরা কতটুকু কথা বলে তার উল্লেখ পাওয়া যায়নি৷ তাছাড়া, শিশুদের ভাষা বিকাশ বাধাগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়েও নিশ্চয়তার সাথে কিছু বলা হয়নি বরং একটি সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে যা সন্তানদের জন্য নেতিবাচক হতে পারে।
সুতরাং, গবেষণায় দেখা গিয়েছে স্মার্টফোনে আসক্ত মায়েদের সন্তান কথা কম বলে মর্মে গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত তথ্যটি বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Daily Mail – Mums who are obsessed with their smartphone talk to their children less, study finds – which may hinder their language development
- Society for Research in Child Development – Mothers speak less to infants during detected real-world phone use
- Rumor Scanner’s own analysis