ইউনেস্কোর চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মেসির দানে চলে শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা

সম্প্রতি, মেসির দান বিষয়ক কিছু তথ্য গণমাধ্যম ও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। 

কী দাবি করা হচ্ছে?

গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে বিভিন্ন দাতব্য কাজে মেসির দান করার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তিনটি দাবি খুঁজে পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার টিম।

দাবি – ১ 
ইউনেস্কোর চারিটেবল ট্রাস্টের ৪৮ শতাংশ চলে মেসির দানে।

দাবি – ২ 
১৭৯টি দেশে মেসির টাকায় চলে ৯ হাজার ৮৪৭টি স্কুল।

দাবি – ৩
মেসি ফোর্বস ম্যাগাজিনের হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বের প্রথম পঞ্চাশ জন দাতার মধ্যে একজন।

উক্ত দাবিগুলো নিয়ে গণমাধ্যমের কিছু প্রতিবেদন দেখুন, ইনকিলাব, মানবজমিন, জুমবাংলা এবং সাম্প্রতিক দেশকাল

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে এখানে, এখানে এবং এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, দাতব্যকাজে মেসির সহায়তা বিষয়ক প্রচারিত তথ্যগুলো সঠিক নয় বরং নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্যসূত্র ছাড়াই উক্ত দাবিগুলো প্রচার করা হচ্ছে। 

ইউনেস্কোর সাথে সম্পর্ক নেই মেসির

ইউনেস্কোর চারিটেবল ট্রাস্টের ৪৮ শতাংশ চলে মেসির দানে শীর্ষক তথ্যের বিষয়ে জানতে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা’র (ইউনেস্কো) ওয়েবসাইটের ‘Donors’ অংশে গিয়ে দেখা যায়, সংস্থাটির সর্বোচ্চ দশ ব্যক্তিগত (Private) ডোনারের তালিকায় মেসির নাম নেই। 

মেসির ‘Leo Messi Foundation’ নামক একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার মাধ্যমে তিনি দাতব্য কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। ইউনেস্কো’র সর্বোচ্চ ডোনার তালিকাতে এই প্রতিষ্ঠানের নামও খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

অধিকতর অনুসন্ধানে ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে মেসি বিষয়ক একটি কন্টেন্টই খুঁজে পাওয়া যায়। ২০১১ সালে বার্সেলোনা ও ইউনেস্কোর যৌথ উদ্যোগে বর্ণবাদ বিষয়ক সচেতনতামূলক একটি ভিডিওতে মেসিকেও দেখা যায়। সেই ভিডিওটিই ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। 

দাবি অনুযায়ী, ইউনেস্কোতে মেসির ৪৮ শতাংশ দানের তথ্য সঠিক হলে ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে উল্লিখিত সর্বোচ্চ দশ ডোনার তালিকায় মেসির নাম থাকত বলেই প্রতীয়মান হয়। সেখানে মেসির নাম না থাকায় তাই দাবিটি সঠিক নয়।

মেসি ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত

অনুসন্ধানে জানা যায়, মেসি জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ‘UNICEF’ এর শুভেচ্ছা দূত হিসেবে ২০১০ সাল থেকে সংস্থাটির সাথে যুক্ত আছেন। সংস্থাটির পক্ষে মেসি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিশুদের জন্য কাজ করতে গিয়েছেন, তহবিল সংগ্রহে প্রচারণা চালিয়েছেন, নিজেও নিয়মিত অর্থ সহায়তা দিচ্ছেন সংস্থাটিকে।

তাছাড়া, মেসি পরিচালিত লিও মেসি ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠানটির চার পার্টনারের একটি হিসেবে উল্লেখ রয়েছে ইউনিসেফের নাম। 

মেসির দানে ৯ হাজার ৮৪৭টি স্কুল চলে?

লিও মেসি ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে নিয়মিতই প্রতিষ্ঠানটির বাৎসরিক হিসাব প্রকাশ করা হয়। গেল ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিস্তারিত হিসাব উল্লেখ রয়েছে ওয়েবসাইটে। সর্বশেষ ২০২১ সালের কাতালান ভাষায় লেখা হিসাবের ফাইলটি অনুবাদ করে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। তবে উক্ত হিসাবে স্কুলের নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা উল্লেখ পায়নি রিউমর স্ক্যানার টিম।

এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন কিওয়ার্ডের মাধ্যমে অধিকতর অনুসন্ধান করে আন্তর্জাতিক একাধিক গণমাধ্যমে (Goal, The Sun, Sportbible, Scmp, Bleacher Report, Marca) বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত মেসির দাতব্য কার্যক্রম বিষয়ক বেশকিছু প্রতিবেদন পড়ে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। 

প্রতিবেদনগুলোতে শিশুদের সাহায্যের বিষয়টি এলেও কতজন শিশু বা কতটি স্কুলে মেসি সহায়তা করছেন সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। 

অর্থাৎ, মেসির দানে ৯ হাজার ৮৪৭টি স্কুল চলে শীর্ষক দাবিটি ভিত্তিহীন। 

ফোর্বস ম্যাগাজিন কি সেরা ৫০ জন দাতার তালিকা করেছে? 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘Forbes’ এর ওয়েবসাইটে অনুসন্ধান করে জানা যায়, সংবাদমাধ্যমটি এখন পর্যন্ত সেরা ৫০জন দাতার কোনো তালিকা প্রকাশ করেনি। তাই সেই তালিকায় মেসির নাম আসার প্রশ্নও আসে না।

তবে ফোর্বসের তিনটি তালিকায় মেসির নাম রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, ২০১৪ সালের  30 Under 30 in Sports,  ২০২০ সালের সেরা ১০০ সেলিব্রেটি এবং ২০২২ সালের সর্বোচ্চ বেতনভুক্ত খেলোয়াড় তালিকা।

অর্থাৎ, মেসি ফোর্বস ম্যাগাজিনের হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বের প্রথম পঞ্চাশ জন দাতার মধ্যে একজন শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা। 

মেসি কোন ধরনের দাতব্য কাজে যুক্ত রয়েছেন?

লিও মেসি ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, মেসি তার এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মূলত খেলা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক দাতব্য কাজের সাথে যুক্ত রয়েছেন। মেসি যে উদ্যোগগুলোকে সমর্থন করেন তা সাধারণত দুর্বল শিশুদের এবং তাদের স্বাস্থ্যসেবার সাথে সম্পর্কিত। ২০০৪ সাল থেকে এই ধরনের শিশুদের জন্য কাজ করার পরে তাকে ২০১০ সালে ইউনিসেফের একজন শুভেচ্ছা দূত হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ইউনিসেফের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং দূর্যোগ কবলিত বিভিন্ন দেশের শিশুদের জন্য নিয়মিত দাতব্য কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন আর্জেন্টাইন সুপারস্টার। ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় আর্জেন্টিনা ও বার্সেলোনার দুইটি হাসপাতালে এক মিলিয়ন ইউরো দান করেন মেসি। 

মূলত, লিওনেল মেসি তার ফুটবল ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই বিভিন্ন দাতব্য কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। নিজের দাতব্য প্রতিষ্ঠান লিও মেসি ফাউন্ডেশন এবং ২০০৭ সালে ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত হওয়ার পর সংস্থাটির পক্ষ থেকে দেশে দেশে শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খেলাধুলা বিষয়ক দাতব্য কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন মেসি। তবে সম্প্রতি ইউনেস্কোর চারিটেবল ট্রাস্টের ৪৮ শতাংশ চলে মেসির দানে, ১৭৯টি দেশে মেসির টাকায় চলে ৯ হাজার ৮৪৭টি স্কুল এবং মেসি ফোর্বস ম্যাগাজিনের হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বের প্রথম পঞ্চাশ জন দাতার মধ্যে একজন শীর্ষক তিনটি দাবি গণমাধ্যম ও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, ইউনেস্কোর দাতব্য কাজের সাথে মেসির সম্পৃক্ততা নেই। তাছাড়া মেসি কতটি স্কুলে সাহায্য করছেন সেই তথ্যেরও নির্ভরযোগ্য সূত্র নেই এবং ফোর্বস ম্যাগাজিন সর্বোচ্চ দাতাদের নিয়ে কোনো তালিকাও প্রকাশ করে না। অর্থাৎ, প্রচারিত দাবিগুলো সঠিক নয়। 

সুতরাং, মেসির দান বিষয়ক সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য গণমাধ্যম ও ফেসবুকে ভিত্তিহীনভাবে প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img