সংসদ ভবনে গণকবর পাওয়ার দাবিটি গুজব 

গত ০৫ আগস্ট সোমবার ছাত্র–জনতার গণ–আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। তার পদত্যাগের পর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে ঢুকে পড়ে অসংখ্য মানুষ। একইভাবে জাতীয় সংসদ ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও লোকজন ঢুকে পড়ে।

সংসদ ভবনে গণকবর দেওয়া হয়েছে এবং লাশের গন্ধে সেখানে ঢুকা যাচ্ছে না—এই দাবিটি সেদিন সন্ধ্যায় ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। একই দাবিতে কিছু মরদেহের ছবিও প্রচার হতে দেখা যায়।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

গণকবর

মরদেহের ছবিসহ একই দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

টিকটকে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।\

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সংসদ ভবন এলাকায় গণকবর পাওয়ার দাবিটি সত্য নয় বরং নির্ভরযোগ্য সূত্র ছাড়া এবং ভিন্ন স্থান থেকে প্রাপ্ত মরদেহের ছবি যুক্ত করে এই দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।

৫ আগস্ট সন্ধ্যায় Samira Islam Afroz নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে দুটি পোস্ট প্রচারিত হয়। প্রথম পোস্টে তিনি দাবি করেন, “সংসদ ভবনে গণকবর, লাশের গন্ধে ঢোকা যাচ্ছে না।” দ্বিতীয় পোস্টে দাবি করেন, “যেসব ছাত্রছাত্রীদের গণকবর দেওয়া হয়েছে, তাদের বই-খাতা সংসদ ভবনে পাওয়া গেছে। নিজের চোখে দেখে আমি হাত-পা কাঁপছিল।”

তবে ওই আইডি থেকে প্রচারিত ভিডিওগুলোতে কোনো লাশ বা গণকবরের দৃশ্য দেখা যায়নি। পোস্টগুলোর কমেন্টে এ বিষয়ে অনেকে মন্তব্য করলে তিনি আরেকটি পোস্টে দাবি করেন, “অতিরিক্ত লাশের গন্ধে লাশের সামনে যেতে পারিনি আর লাশের ভিডিও দিতে পারিনি। এত খারাপ অবস্থা। আমি শুধু তাদের পরিবার-এর কথা ভাবছি। তবে লাশ যখন মাটি থেকে বের করছিল তখন দেখেছি নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে চলে আসি। সংসদ ভবনের পেছনের গেট দিয়ে গেলে এখনো দেখতে পারবেন।”

তার এই ভিডিওগুলোর সূত্র ধরে এই দাবিটি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। সামিরা ইসলাম আফরোজ নামের অ্যাকাউন্টটি ঘুরে ৫ আগস্ট দিবাগত রাত ১২টা ৫৩ মিনিটে প্রচারিত একটি লাইভ ভিডিও পাওয়া যায়। এই ভিডিওতে তিনি জানান, বিকেলে বিজয় উল্লাসের মিছিলে অংশগ্রহণের পর তিনি তার স্বামী এবং মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে সংসদ ভবনের পেছনে যান। সেখানে অনেক লোকের মুখে শোনেন যে, ছাত্রদের গণকবর দেওয়া হয়েছে এবং লাশের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি ও তার পরিবার ভিতরে ঢুকে দেখেন অনেকেই বলছে যে, ছাত্রদের বই-খাতা পাওয়া গেছে এবং প্রচুর গন্ধ রয়েছে। সন্ধ্যা হলে মাটি খুঁড়ে কিছু লাশ বের করার চেষ্টা চলছিল। কেউ বলছিল লাশ পাওয়া গেছে, আবার কেউ বলছিল পাওয়া যায়নি। তিনি তার অভিজ্ঞতা ভিডিও করে ফেসবুকে পোস্ট করেন, যা দ্রুত ভাইরাল হয়। পরে অনেকেই তাকে এটি গুজব বলে জানায়।

এই ভিডিওতে তিনি স্বীকার করেন যে, তিনি নিজ চোখে কিছু দেখেননি, শুধু অন্যদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে এমনটা ভেবেছিলেন। তিনি তার ভুল স্বীকার করে সবার কাছে ক্ষমা চান এবং বলেন যে, তার পোস্টের কারণে সৃষ্ট বিভ্রান্তির জন্য তিনি দুঃখিত।

অর্থাৎ, তিনি সংসদ ভবনে গণকবর পাওয়ার দাবিতে দুটি ভিডিও প্রচার করে পরবর্তীতে সরিয়ে নেন। তবে, তার সরিয়ে নেওয়ার পূর্বেই ভিডিওগুলো ডাউনলোড হয়ে ফেসবুকে ছড়াতে থাকে।

এ বিষয়ে মূলধারার গণমাধ্যম কালবেলার প্রতিবেদক আকরাম হোসাইন একটি ফেসবুক পোস্টে জানান, “যমুনা টিভি, কালবেলাসহ আমরা কয়েকজন সাংবাদিক কিছুক্ষণ আগে সংসদ ভবনের পেছনে গণকবরের সন্ধানে গিয়ে কিছু বই-খাতা পেয়েছি এবং গন্ধ পেয়েছি। বই-খাতাগুলোতে ২/৩ জনের নাম পেয়েছি। তার মধ্যে ১ জনের মোবাইল নম্বর পেয়েছি যার নাম নাইমুর রহমান। নম্বরে কল দিয়ে জানতে পারি তিনি সংসদ ভবনের কর্মচারী তার ছেলের নাম নাইমুর রহমান। তাদের বাসায় ভাংচুর করা হয়েছে এবং ছেলের বই-খাতা সবকিছু নিয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে বই-খাতাগুলো কেউ ফেলে রেখে গেছে। গন্ধ- আমরা একটা গন্ধ পেয়েছি। তবে আমরা কোনো কবরের সন্ধান পাইনি। আর যে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে সেটা নির্দিষ্ট কোনো জায়গা থেকেও আসছে না। ধারণা করা হচ্ছে কোনো মৃত প্রাণীর গন্ধ হতে পারে। সুতরাং সংসদ ভবনে গণকবরের সন্ধান বিষয়টা গুজব।”

এছাড়া, ৬ আগস্ট Shadhin Studio নামের একটি ফেসবুক পেজে প্রচারিত ভিডিওতে সংসদ ভবন এলাকায় মাটি খুঁড়ে কথিত গণকবর খোঁজার দৃশ্য দেখা যায়। তবে এই ভিডিওতেও কোনো গণকবরের অস্তিত্ব দেখা যায়নি।

পরবর্তীতে সংসদ ভবনের কথিত গণকবর থেকে প্রাপ্ত লাশের ছবি দাবিতে কিছু ছবি (, ) ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। প্রচারিত ছবিগুলোর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছড়িয়ে পড়া কিছু ছবি ( ,, ) রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার সামনে পড়ে থাকা মরদেহের। অপর কিছু ছবি (,) ঝিনাইদহ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পোড়াহাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম হিরণের। বিক্ষুব্ধ জনতা তার মরদেহ ঝিনাইদহ শহরের পায়রা চত্বরে এনে ঝুলিয়ে রাখে। এই দৃশ্য দেখিয়ে ফেসবুকে প্রচারিত একটি ভিডিওর সাথে সংসদ ভবনের কথিত গণকবর থেকে প্রাপ্ত লাশ দাবিতে প্রচারিত ছবির মিল পাওয়া যায়।

সুতরাং, সংসদ ভবন এলাকায় গণকবর পাওয়া গেছে দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img