কেক খেয়ে বাচ্চারা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হচ্ছে দাবিতে মিথ্যা তথ্য প্রচার

সম্প্রতি “বাজারে নতুন কেক এসেছে। লুপো কোম্পানির কোন ট্যাবলেট আছে এতে। যে খাবার খেলে বাচ্চাদের প্যারালাইসিস হয়।” শীর্ষক একটি দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। 

কেক

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত দাবিটি সঠিক নয় বরং লুপো কোনো ঔষধ কোম্পানি নয়, এটি মূলত তুর্কির সোলেন কোম্পানির এক ধরনের কেক। এই কেক বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যায় না এবং এই কেক খেয়ে শিশুদের প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়ার দাবিটিও সত্য নয়।

কেকের ছবি যাচাই

অনুসন্ধানের শুরুতে দাবিকৃত পোস্টগুলোতে দুইটি কেকের ছবি লক্ষ্য করা যায়। উক্ত ছবিগুলোর মূল সূত্র অনুসন্ধানে রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে ইরানের বেসরকারি সংবাদ সংস্থা ‘Fararu’ এর ওয়েবসাইটে ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর “Contaminated Cakes with Pills; Validity and Falsehood of Ongoing News” (স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনূদিত) শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে একটি ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। ছবিটির সাথে দাবিকৃত পোস্টে সংযুক্ত একটি ছবির মিল পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, সেসময় ইরানের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কেকে ট্যাবলেট খুঁজে পায়। ট্যাবলেটযুক্ত কেকের বেশকিছু ছবি এবং ভিডিও সেসময় সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

পরবর্তীতে একই বিষয়ে ডয়েচে ভেলের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। এই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে ইরানের তিনটি প্রদেশের স্কুলে বিতরণ করা কেকে বিভিন্ন ধরনের ট্যাবলেট (ঔষধ) পাওয়া গিয়েছিল। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সেসময় জানিয়েছিল, এর কারণ অনুসন্ধান তাদের ক্ষমতার বাইরে, তবে অনানুষ্ঠানিক রিপোর্ট অনুযায়ী ওই ট্যাবলেটগুলো মাদকজাতীয়, আসক্তিমূলক অথবা বিষাক্ত হতে পারে। এই ঘটনায় কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যা বা বিষক্রিয়ার তথ্য সেসময় জানা যায়নি। 

অর্থাৎ, ২০১৯ সালে ইরানের উক্ত ঘটনার একটি ছবি আলোচ্য দাবির সাথে প্রচার করা হচ্ছে।

শিশুর ছবি যাচাই

দাবিকৃত পোস্টগুলোতে অসুস্থ এক শিশুর ছবি সংযুক্ত থাকতে দেখা যায়। উক্ত শিশুর পরিচয় জানতে বিভিন্ন পদ্ধতিতে অনুসন্ধান চালায় রিউমর স্ক্যানার টিম। কাছাকাছি দাবিতে একই শিশুর ছবি ২০২০ সালের ভারতের একটি ফেসবুক আইডিতে (আর্কাইভ) এবং ২০২১ সালে আফগানিস্তানের একটি ফেসবুক আইডিতে (আর্কাইভ) পোস্ট করা হয়।  তবে শিশুটি কী রোগে আক্রান্ত এবং তার জাতীয়তা কী সে সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য মিলেনি।

লুপো কোম্পানির ট্যাবলেট ও বাজারের নতুন কেক

ওপেন সোর্স অনুসন্ধানে লুপো নামের কোনো ঔষধ কোম্পানির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে বিস্তারিত অনুসন্ধানে, তুর্কির সোলেন (Şölen) কোম্পানির লুপো (Luppo) নামের কেক খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এই কেকে ট্যাবলেট (ঔষধ) পাওয়া এবং তা খেয়ে শিশুদের প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়া সম্পর্কিত কোনো তথ্য ওপেন সোর্সে পাওয়া যায়নি। 

পরবর্তী অনুসন্ধানে দেখা যায়, লুপো কেকটি বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যায় না। রিউমর স্ক্যানার টিম দেশের জনপ্রিয় কয়েকটি সুপারশপ ঘুরেও এই কেক খুঁজে পায়নি।

এছাড়া, ২০২০ সালে ভারতীয় ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা বুম সমজাতীয় একটি দাবি খণ্ডন করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ভারতে একই দাবি কিছুটা ভিন্নভাবে ছড়িয়েছিলো। দাবি করা হচ্ছিলো, “লুপো নামের চায়নিজ কোম্পানি ভারতের বাজারে এক ধরনের কেক ছেড়েছে, যার মধ্যে ট্যাবলেট রয়েছে এবং তা খেয়ে শিশুরা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হচ্ছে।” তবে বুমের অনুসন্ধানে জানা যায়, লুপো কেক চায়নিজ নয় বরং তুর্কির সোলেন (Şölen) কোম্পানির একটি পণ্য। এই কেক ভারতে পাওয়া যায় না এবং এই কেক খেয়ে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়ার দাবিটিও সত্য নয়। 

বুম ছাড়াও সমজাতীয় দাবি খণ্ডন করে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা স্নুপস এবং তুর্কির ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা তেয়িত ফ্যাক্টচেকিং প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। স্নুপের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চিকিৎসাগতভাবে ট্যাবলেটের মাধ্যমে এমনভাবে শিশু কিংবা প্রাপ্তবয়স্কদের প্যারালাইসিস ঘটানো সম্ভব নয়।

মূলত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে “বাজারে নতুন কেক এসেছে। লুপো কোম্পানির কোন ট্যাবলেট আছে এতে। যে খাবার খেলে বাচ্চাদের প্যারালাইসিস হয়।” শীর্ষক একটি দাবি ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রেক্ষিতে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, লুপো নামের কোনো ঔষধ কোম্পানি নেই। লুপো মূলত তুর্কির সোলেন কোম্পানির এক ধরনের কেক। এই কেক বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যায় না এবং এই কেক খেয়ে শিশুদের প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়াও চিকিৎসাগতভাবে সম্ভব না। এছাড়া, দাবিগুলোর সাথে ২০২০ সালে ইরানে ঘটা ভিন্ন এক ঘটনার ছবি প্রচার করা হচ্ছে। 

সুতরাং, “বাজারে নতুন কেক এসেছে। লুপো কোম্পানির কোন ট্যাবলেট আছে এতে। যে খাবার খেলে বাচ্চাদের প্যারালাইসিস হয়।” শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img