সম্প্রতি ‘তুর্কি বুরসা রাজ্যের আকাশে একটি অদ্ভুত আকারে একটি মেঘ দেখা দিয়েছে, একটি বিরল ঘটনায় যারা এটি দেখেছিল তাদের বিস্ময় এবং কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছিল।‘ শীর্ষক শিরোনামে মেঘাকৃতির কিছু ছবি তুরস্ক, সিরিয়া, ভূমিকম্প (#turkey #seriya #ভূমিকম্প) হ্যাশট্যাগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, তুরস্কের বুর্সা রাজ্যে দেখা যাওয়া অদ্ভুত আকারের মেঘের ছবিগুলো দেশটিতে সাম্প্রতিক সংঘটিত ভূমিকম্প কেন্দ্রিক নয় বরং গত জানুয়ারি মাসে দেশটিতে এমন মেঘ দেখা গিয়েছিল। এছাড়া তুরস্কের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের সাথে এই মেঘের কোনো সম্পর্ক নেই।
মেঘগুলো কখন দেখা গিয়েছিল?
রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে ব্রিটিশ গণমাধ্যম BBC News এ গত ২০ জানুয়ারি ‘UFO-like cloud forms in Turkey‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, তুরস্কের বুরসা পর্বতশ্রেণীতে বিরল গঠনের একটি মেঘ দেখা গিয়েছে। এটির গঠন দেখে সাধারণ দর্শকেরা এটিকে ‘ইউএফও’ ভেবে দৃষ্টিভ্রমের শিকার হচ্ছেন। তবে এই ধরনের মেঘের গঠন লেন্টিকুলার মেঘ নামে পরিচিত।
পাশাপাশি আরেকটি ব্রিটিশ গণমাধ্যম The Guardian এ একইদিনে ‘Bizarre UFO-like cloud hovers over Turkey – video‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়,
তুরস্কের বুরসা শহরে ইউএফও এর মতো দেখতে একটি বৃহৎ আকৃতির লেন্টিকুলার মেঘ দেখা গিয়েছে। এটি সূর্যোদয়ের সময় দেখা গিয়েছিল এবং প্রায় এক ঘন্টা ধরে ওভাবেই ছিল।
প্রতিবেদনটিতে মেঘটির আকৃতি সম্পর্কে বলা হয়, মেঘটি প্রায় বৃত্তাকার এবং মাঝখানে একটি বড় গর্ত ছিল। এই ধরনের মেঘগুলো সাধারণত তাদের বাঁকা, ইউএফও এর মতো চেহারার জন্য পরিচিত। পাশাপাশি এই ধরনের মেঘ সাধারণত ২ থেকে ৫ হাজার মিটার উচ্চতায় দেখা যায়।
এছাড়া অনুসন্ধানে বুরসার এই মেঘটি ছাড়া তুরস্কে ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার আগে বা পরে এমন কোনো মেঘ দেখা যাওয়া প্রসঙ্গে আর কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ, তুরস্কের বুরসার আকাশে অদ্ভুত আকারের মেঘ দেখা যাওয়ার সাথে তুরস্কের সাম্প্রতিক সময়ের ভূমিকম্পের কোনো সম্পর্ক নেই।
লেন্টিকুলার মেঘ কি?
লেন্টিকুলার মেঘের সংজ্ঞায় বিখ্যাত ইংরেজি অভিধান Collins Dictionary বলছে, এই মেঘগুলো মসৃণ, বৃত্তাকার, ডিম্বাকৃতি বা লেন্স-আকৃতির হয়ে থাকে। যা প্রায়শই এককভাবে বা দলীয়ভাবে স্তূপীকৃত আকারে পর্বতশৃঙ্গের কাছে দেখা যায়।
এই মেঘ সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের আবহাওয়া অফিস বলছে, অদ্ভুত-অপ্রাকৃত দেখতে এই মেঘগুলো পাহাড় বা পর্বতমালার নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের মাধ্যমে তৈরি হয়। তবে এমন মেঘ ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে বেশ অস্বাভাবিক তবে মাঝে মাঝে ঘটে। এগুলো দেখতে অনেকটা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর উড়ন্ত সসারের মতো এবং বিশ্বজুড়ে ইউএফও দেখার পেছনে সবচেয়ে সাধারণ ব্যাখ্যা হিসেবে এই মেঘের উপস্থিতিকে দায়ী করা করা হয়।
তুরস্কের ভূমিকম্পের সঙ্গে এই মেঘের কোনো সম্পর্ক আছে?
অনুসন্ধানে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ওয়েবসাইটে ২০২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ‘Fact Check-No evidence linking clouds to earthquakes, contrary to claims following Turkey-Syria quake‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের মৃত্তিকা ও মহাকাশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হ্যারল্ড টোবিন জানান, তুরস্কের ৬ ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ও মেঘ দেখা যাওয়া এলাকা বুরসার মধ্যকার দূরত্ব প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার। ফলে এই মেঘের সাথে ভূমিকম্পের কোনো বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক নেই।
এছাড়া তোবিন তার ব্যাখ্যায় পুরো বিষয়টিকে ভিত্তিহীন উল্লেখ করে বলেন।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাটমস্ফরিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডেইল আর. ড্যুরানও এই বিষয়ে একমত প্রকাশ করে বলেন, বুরসার মেঘের সঙ্গে ভূমিকম্পের কোনো সম্পর্ক নেই।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কর্ণেল ইউনিভার্সিটির মৃত্তিকা ও অ্যাটমস্ফরিক বিজ্ঞান বিভাগের জৈষ্ঠ্য প্রভাষক মার্ক ওয়াইসিকি বলেন, লেন্টিকুলার মেঘ তৈরি হয় মূলত পর্বত বা পাহাড়ের সঙ্গে বাতাসের একটি মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে৷ আর ভূমিকম্প তৈরি হয় ভূস্তরের কম্পনের কারণে৷ এই দুইটি বিষয় কোনোটিই একটি অন্যটির সাথে সম্পর্কযুক্ত না এবং একটির কারণে অন্যটি ঘটে না।
পূর্বেও কি কখনো, কোথাও এমন মেঘ দেখা গিয়েছিল?
তুরস্কেই প্রথম নয়, ইতোপূর্বে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন মেঘ দেখা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। যেমন, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমিতেও এমন মেঘ দেখা গিয়েছিল।
এছাড়া একই বছরের ডিসেম্বরের শুরুতেই দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালার উপরও লেন্টিকুলার মেঘের দৃশ্য দেখা যায়।
মূলত, গত সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ভোরে সিরিয়ার সীমান্তের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের গাজিয়ান্তেপ শহরের কাছে ৭.৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এতে তুরস্ক-সিরিয়া দুইটি দেশই প্রাণহানি সহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি তুরস্ক, সিরিয়া, ভূমিকম্প (#turkey #seriya #ভূমিকম্প) হ্যাশট্যাগে কিছু অদ্ভুতাকৃতির মেঘের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, আলোচিত ছবিগুলো সাম্প্রতিক সময়ের নয়। প্রকৃতপক্ষে গত জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে তুরস্কে এমন মেঘ দেখা গিয়েছিল। এছাড়া কেবল তুরস্কই নয়, পৃথিবীর আরও বিভিন্ন অংশেও বিভিন্ন সময়ে এমন মেঘ দেখা যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। পাশাপাশি অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, এই মেঘ সৃষ্টির সঙ্গে ভূমিকম্প সৃষ্টির কোনো সম্পর্ক নেই। এই দুইটি বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনা।
সুতরাং, তুরস্কে অদ্ভুতাকৃতির মেঘ দেখা যাওয়ার ঘটনাটি সাম্প্রতিক সময়ে নয় এবং তুরস্কে সম্প্রতি সংঘটিত ভূমিকম্পের সাথে উক্ত মেঘের সম্পর্ক নেই। তাই তুরস্কের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পকে কেন্দ্র করে উক্ত মেঘের ছবি প্রচারের বিষয়টি সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- BBC News: UFO-like cloud forms in Turkey
- The Guardian: Bizarre UFO-like cloud hovers over Turkey – video
- Collins Dictionary: Lenticular Cloud Definition
- Met Office UK: Lenticular clouds
- SF Gate: Huge’ UFO-shaped cloud spotted in California desert near Palm Springs
- The Sydney Morning Herald: ‘This one stood out’: Lenticular cloud hovers like a saucer over South American Andes
- Reuters: Fact Check-No evidence linking clouds to earthquakes, contrary to claims following Turkey-Syria quake