নিউটনের সেই আপেল গাছের চিত্র দাবিতে ছড়াল আসল গাছকে ক্লোন করে তৈরি ভিন্ন গাছের ছবি

সম্প্রতি, ‘এই সেই বিখ্যাত আপেল গাছ যার নিচে স্যার আইজ্যাক নিউটন বসেছিলেন’ শীর্ষক দাবিতে একটি আপেল গাছের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে ( আর্কাইভ)  এবং এখানে ( আর্কাইভ)  

ফ্যাক্টচেক 

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত দাবিতে যে গাছের ছবিটি প্রচার করা হচ্ছে সেটি যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ট্রিনিটি কলেজে অবস্থিত আপেল গাছের ছবি এবং এটি স্যার আইজ্যাক নিউটন যে আপেল গাছের নিচে বসেছিলেন সেই প্রকৃত আপেল গাছ নয়। প্রকৃতপক্ষে এটি আসল আপেল গাছ থেকে কলম করে তৈরি একটি গাছ। এছাড়াও প্রকৃত আপেল গাছটির অবস্থান কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে নয় বরং সেটির অবস্থান ছিল ইংল্যান্ডের লিঙ্কনশায়ারের উলসথর্প মানর গ্রামে আইজ্যাক নিউটনের বাড়ির নিকটে। 

নিউটনের সেই আপেল গাছ কি বেঁচে আছে? গাছটির অবস্থান কোথায়?

স্যার আইজ্যাক নিউটন যে আপেল গাছটির নিচে বসেছিল সেই মাতৃগাছটি সম্পর্কে অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার টিম। অনুসন্ধানে ‘Atlas Obscura’ নামের একটি ওয়েবসাইটে ২০১৮ সালের ২৬ জুন ‘How Isaac Newton’s Apple Tree Spread Across the World‘ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot Source : Atlas Obscura

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইংল্যান্ডের লিঙ্কনশায়ারের উলসথর্প মানর গ্রামে নিউটনের বাড়ির সামনের বাগানে দাঁড়িয়ে থাকা আপেল গাছটিকেই ব্যাপকভাবে নিউটনের বসে থাকা সেই আপেল গাছ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ধারনা করা হয় গাছটি ১৬৫০ সালের দিকে রোপণ করা হয়েছিল এবং ১৮১৬ সালের দিকে ঝড়ের ফলে গাছটি আংশিক ভেঙ্গে গিয়েছিল। কিন্তু গাছটি পুনরায় শিকড় দেয় এবং ৩৫০ বছরের পুরনো এই গাছটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। 

ইংল্যান্ডের  University of York এর ওয়েবসাইটের একটি প্রতিবেদনেও একই তথ্য পাওয়া যায়। সেখান থেকে যা জানা যায় তা হলো, নিউটন কোন গাছ থেকে আপেলের পতন দেখেছেন তা নির্দিষ্ট করেননি, তবে নিউটনের বাগানে একটি মাত্র গাছ জন্মেছিল, তাই সেই গাছটিকেই নিউটনের সেই মধ্যাকর্ষন সূত্রের সাথে সম্পৃক্ত আপেল গাছ চিহ্নিত করা হয়।

এছাড়াও, বিখ্যাত ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান স্নোপস তাদের একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে আইজ্যাক নিউটনের সেই আপেল গাছের বেঁচে থাকার বিষয়টি সত্য হিসেবে নিশ্চিত করেছে। স্নোপস জানায়, ‘আইজ্যাক নিউটন যে গাছ থেকে মাধ্যাকর্ষণ সূত্র নিয়ে এসেছিলেন সেই গাছটি এখনও বেঁচে আছে এবং ইংল্যান্ডের উলস্টর্প ম্যানরে নিউটনের পারিবারিক বাড়িতে ভালোভাবেই রয়েছে।’

দাবিকৃত গাছটি সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে 

এ নিয়ে অনুসন্ধানে কি ওয়াড সার্চ এর মাধ্যমে ‘Atlas Obscura’ নামক ওয়েবসাইটে ‘Newton’s Apple Tree,Triniti College‘ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে উল্লেখিত আপেল গাছটির সাথে ফেসবুক প্রচারিত গাছটির হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Atlas Obscura

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘এ গাছটি যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ট্রিনিটি কলেজের প্রধান ফটকের পাশে অবস্থিত। এই আপেল গাছটি মূলত ইংল্যান্ডের লিঙ্কনশায়ারের উলসথর্প মানর গ্রামে নিউটনের বাড়ির সামনে অবস্থিত আসল মাতৃগাছটি থেকে কলম করে তৈরি করা হয়েছিল। যে মাতৃগাছের নিচে নিউটন বসেছিল সেই গাছটির একটি শাখা এ গাছটি, যা এখন ন্যাশনাল ট্রাস্ট দ্বারা পরিচর্চা করা হয়। মূলত নিউটনের অবদানকে স্মরণ রাখার জন্য ১৯৫৪ সালে এই গাছটি সেখানে রোপণ করা হয়েছিল।

Creating My Cambridge নামের অপর একটি ওয়েবসাইটে ‘Isaac Newton : Newton’s Scientific Discoveries‘ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও আলোচিত গাছটি সম্পর্কে একই তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘স্যার আইজ্যাক নিউটন যে আপেল গাছের নিচে বসেছিল সেই গাছটি থেকে আলোচিত গাছটি কলম করা হয়েছিল। সে গাছটি থেকে মূলত সবুজ আপেল পাওয়া যায়। সরাসরি খাওয়া না গেলেও সেটি রান্না করলে খাওয়ার উপযোগী হয়। আর নিউটন যে মাতৃগাছটির নিচে বসেছিল সেই গাছটিতে লাল আপেল হতো, যা সরাসরি খাওয়া যেত।’

Screenshot Source : Creating My Cambridge’s website 

এছাড়াও, Cambridgeshire Live এর ওয়েবসাইট cambridge-news.co.uk তে একই তথ্যই পাওয়া যায়। 

Screenshot: Cambridgeshire Live

অর্থাৎ যে গাছটিকে স্যার আইজ্যাক নিউটন এর বসে থাকা সেই প্রকৃত আপেল গাছ দাবি করা হচ্ছে সেটি মূলত আসল গাছকে কলম করে তৈরি একটি গাছ। এটি নিউটনের সেই মূল আপেল গাছ নয়।

নিউটনের সেই মাতৃগাছটির ক্লোন আছে আরো

অনুসন্ধানে মাতৃগাছটির আরও ক্লোন সম্পর্কে জানা যায়। কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে ব্রিটিশ গণমাধ্যম ‘বিবিসি নিউজ’ এ ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘ Cambridge University Botanic Garden’s ‘Newton’s apple tree’ falls in storm ‘ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot : BBC NEWS

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির বোটানিক্যাল গার্ডেনে একটি আপেল গাছ রয়েছে যা লিঙ্কনশায়ারের গ্রান্থামের উলসথর্প ম্যানরে অবস্থিত মাতৃগাছটি থেকে ক্লোন করা হয়েছিলো। যেটি ছত্রাকজনিত কারনে দুর্বল হয়ে ঝড়ে গাছটি পরে গিয়েছিল। তবে বোটানিক্যাল গার্ডেন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে তাদের কাছে গাছটির আরো একটি ক্লোন রয়েছে যা খুব শীঘ্রই তারা রোপণ করবে। 

পাশাপাশি ভারতের ইংরেজি দৈনিক ‘ THE TIMES OF INDIA ‘ তে ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই ‘Newton’s apple tree may soon take ‘root’ in India‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot Source: THE TIMES OF INDIA

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, লিঙ্কনশায়ারের গ্রান্থামের উলসথর্প ম্যানরে অবস্থিত মাতৃগাছটি থেকে ক্লোন করা গাছ ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে রোপণ করা হয়েছে। এবং ভারতের পুনের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সেও আনা হয়েছিল এ গাছের চারা।

ক্লোন কি 

ক্লোন হলো কোনো একটি জীবের জেনেটিক কপি যা ক্লোনিং নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরী করা হয়। ক্লোন করা গাছগুলো মূল গাছের সাথে জেনেটিক্যালি অভিন্ন হবে এবং একই হারে বৃদ্ধি পাবে এবং মূল গাছের মতোই কীটপতঙ্গ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকবে। কোনো একটি জীব থেকে অনুরূপ জীব তৈরীতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ক্লোন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখুন এখানে। 

মূলত, সম্প্রতি ফেসবুকে ‘এই সেই বিশ্ব বিখ্যাত আপেল গাছ যার নিচে স্যার আইজ্যাক নিউটন বসেছিল’ দাবিতে ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে অবস্থিত গাছের ছবি প্রচার করা হয়। তবে  অনুসন্ধানে দেখা যায়, যে গাছটিকে নিউটনের সেই আসল গাছ দাবি করা হয়েছে সেটি মূলত ইংল্যান্ডের লিঙ্কনশায়ারের উলসথর্প মানর গ্রামে নিউটনের বাড়ির সামনে অবস্থিত আসল মাতৃগাছ থেকে কলম করে তৈরি একটি গাছ। 

সুতরাং, মূল গাছ থেকে কলম করে তৈরি একটি ক্লোন গাছের ছবিকে ‘এই সেই গাছ যে গাছের নিচে স্যার আইজ্যাক নিউটন বসেছিল’ শিরোনামে প্রচার করে সেটিকে নিউটনের সেই মূল গাছ দাবির বিষয়টি বিভ্রান্তিকর।

তথ্যসূত্র

  • Rumor Scanner’s Analysis 

আরও পড়ুন

spot_img