নিঃশ্বাস আটকে রেখে ফুসফুসের সুরক্ষা পরীক্ষা সংক্রান্ত দাবিটি কি বিজ্ঞানসম্মত?

বেশ কয়েক বছর ধরে শ্বাস আটকে রাখার মাধ্যমে ফুসফুসের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত আছে কিনা তার পরীক্ষা সংক্রান্ত কিছু ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে। 

Screenshot from Facebook

উক্ত ভিডিওগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, একটি রেখার উপর A এবং B চিহ্নিত দুটি পয়েন্ট দাগান্বিত থাকে এবং ভিডিও চালু করলে একটি কাঁটা ধীরে ধীরে বাম থেকে ডানদিকে A এবং B বিন্দুর দিকে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। দাবি করা হয়, “যদি আপনি পয়েন্ট A থেকে পয়েন্ট B পর্যন্ত্য শ্বাস ধরে রাখতে পারেন, তাহলে আপনি সুরক্ষিত আছেন।”

বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এবং এখানে (আর্কাইভ)। 

বিভিন্ন সময়ে ইউটিউবে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাউভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, শ্বাস আটকে রাখার মাধ্যমে ফুসফুসের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা যায় শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয় বরং বৈজ্ঞানিকভাবে ভিত্তিহীন এই দাবিটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই নাকচ করেছে। তাছাড়া, কিছু গবেষণায় নির্দিষ্ট বয়সের ব্যক্তিদের জন্য এই ধরণের শ্বাস আটকে রাখার পরীক্ষা করা গেলেও বয়সভিত্তিক ফুসফুসের অবস্থা একেকরকম থাকে বলে এই ধরণের পদ্ধতির মাধ্যমে ফুসফুসের সামগ্রিক সুরক্ষা পরীক্ষা সম্ভব নয়। 

যেভাবে অনুসন্ধান 

একজন মানুষের ফুসফুসের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে নানা ধরনের পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরী অব মেডিসিন (Medline Plus) এর তথ্যমতে, যে সমস্ত পরীক্ষা দ্বারা ফুসফুসের স্বাস্থ্য পরিমাপ করা যায় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে: স্পিরোমেট্রি, লাং ভলিউম টেস্ট, গ্যাস ডিফিউশন টেস্ট এবং এক্সারসাইজ স্ট্রেস টেস্ট।  

Screenshot source: NIH

তাছাড়া, ব্রিটিশ লাং ইনস্টিটিউট (BLI) এর ওয়েবসাইটে ফুসফুসের স্বাস্থ্য পরিমাপকারী বেশ কিছু পদ্ধতির ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে। পদ্ধতিগুলো হচ্ছে পিক ফ্লো, স্পাইরোমেট্রি, ফুসফুসের ভলিউম টেস্ট, গ্যাস ট্রান্সফার টেস্ট, FeNO টেস্ট, ব্রঙ্কিয়াল চ্যালেঞ্জ টেস্ট, ইমেজিং স্ক্যান, ব্রঙ্কোস্কোপি, ফুসফুসের বায়োপসি, শ্বাস ছাড়ার কার্বন মনোক্সাইড টেস্ট, অক্সিজেন লেভেল টেস্ট, রেসপাইরেটরি মাসল টেস্ট, স্লিপ ব্রেকিং টেস্ট।

এই দুই প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে শ্বাস আটকে রাখার মাধ্যমে ফুসফুসের সুরক্ষা সংক্রান্ত পরীক্ষার বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ পাওয়া যায়নি। 

পরবর্তীতে, একাধিক স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইটে অনুসন্ধান করেও ইন্টারনেটে প্রচারিত ভিডিওগুলোর ন্যায় একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে শ্বাস আটকে রাখার মাধ্যমে ফুসফুসের স্বাস্থ্য পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো পদ্ধতি খুঁজে পায়নি রিউমর স্ক্যানার টিম।  

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে ইন্টারনেটে নিঃশ্বাস আটকে রাখার মাধ্যমে ফুসফুসের স্বাস্থ্য পরীক্ষা সংক্রান্ত কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এই বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। 

সংস্থাটি বিবৃতিতে জানায়, “কোনো রকম অস্বস্তি ছাড়াই যদি আপনি ১০ সেকেন্ড কিংবা এর বেশি সময় আপনার শ্বাস আটকে রাখেন তার অর্থ এই নয় যে আপনি কোভিড ১৯ অথবা অন্য যেকোনো ফুসফুসের রোগ থেকে মুক্ত।”

Screenshot from WHO

অর্থাৎ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে স্পষ্ট বলা হয়েছে, শ্বাস আটকে রাখার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার ফুসফুস সুরক্ষিত আছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারবে না। 

পরবর্তীতে আরো বিস্তর অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘Science Direct’ এর একটি আর্টিকেলে ক্লিনিক্যাল নিউরোলজির একটি পাঠ্যবইয়ের বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, একজন মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের ধরণ ব্যক্তি সাপেক্ষে পরিবর্তিত হয় এবং এটি আমাদের ব্যথা, আবেগ, শরীরের তাপমাত্রা, ঘুম, শারীরিক অবস্থা, দৈহিক কার্যকলাপের পরিমাণ, স্নায়ুতন্ত্রের রোগের উপস্থিতিসহ আরো কিছু ফ্যাক্টর দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।

Screenshot Source: Science Direct

তবে বেশকিছু বৈজ্ঞানিক জার্নালে “Breath Holding Test” নামক একটি পরীক্ষা পদ্ধতির ব্যাপারে উদ্ধৃত হয়েছে যেটি সরাসরি ফুসফুসের স্বাস্থ্য পরীক্ষার সাথে সম্পৃক্ত না হলেও অন্য বেশ কিছু স্বাস্থ্যগত ত্রুটি নির্ণয় করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে বলা হচ্ছে।

এদের মধ্যে একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, সেরিব্রোভাসকুলার রিয়েক্টিভিটি (CVR) নির্ধারনের ক্ষেত্রে “Breath Holding Test” এর বিশেষ উপযোগিতা রয়েছে। এই গবেষণা পরিচালনার ক্ষেত্রে ১৩-১৫ বছর বয়সী ২১ জন কিশোর-কিশোরীকে বেছে নেওয়া হয়, যেখানে বিভিন্ন সময়ে ৩০ সেকেন্ড পর্যন্ত নিশ্বাস আটকে রেখে ট্রান্সক্র্যানিয়াল ডপলার আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে তাদের কার্ডিও সেরিব্রোভাসকুলার রিয়েক্টিভিটি পর্যবেক্ষণ করা হয়। 

Screenshot from Wiley Online Library

গবেষণাটির উপসংহারে বলা হয়, সেরিব্রোভাসকুলার রিয়েক্টিভিটি (CVR) নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিশোর বয়সে “Breath Holding Test” পরিমাপ করা গেলেও তরুণদের ক্ষেত্রে এটিকে অপ্রয়োজনীয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। 

Screenshot from Wiley Online Library

তাছাড়া, গবেষণাগুলোতে “Breath Holding Test” এর কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও তুলে ধরা হয়েছে। 

“Breath Holding Test” সম্পর্কিত এমন আরো কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র দেখুন এখানে, এখানে, এখানে

ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোতে নিঃশ্বাস আটকে রাখার মাধ্যমে ফুসফুসের স্বাস্থ্য পরীক্ষার যে পদ্ধতিটি দেখানো হচ্ছে তার স্বপক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুঁজে না পেলেও Medical News Today, Healthline, American Lung Association এর মতো স্বাস্থ্যবিষয়ক কিছু ওয়েবসাইট থেকে দৈনন্দিন Breath Holding Practice এর মাধ্যমে আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি, মস্তিষ্কে নতুন টিস্যুর রি-জেনারেশন, ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণ প্রতিরোধ, অক্সিজেন লেভেল বৃদ্ধিসহ আরো বেশ কিছু স্বাস্থ্যগত উপকারিতার কথা জানা যায়। 

Screenshot from Healthline
Screenshot from American Lung Association

তাছাড়া, Medical News Today এর তথ্যমতে, একজন সাধারণ মানুষ গড়ে ৩০ থেকে ৯০ সেকেন্ডের জন্য তাদের শ্বাস ধরে রাখতে পারে।

Screenshot from Medical News Today

অর্থাৎ একজন স্বাভাবিক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ৩০-৯০ সেকেন্ড নিশ্বাস আটকে রাখা স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে শারীরিক বিভিন্ন কারণে এই সময়কালের তারতম্য হতে পারে। বলা হয়, একজন মানুষ দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে শ্বাস আটকে রাখার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তার ফুসফুসের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে।

Screenshot from Medical News Today

যেহেতু, একজন মানুষ অনায়াসেই ৩০-৯০ সেকেন্ড নিজের শ্বাস আটকে রাখতে সক্ষম তাই এই সময়টুকুতে শ্বাস আটকে রাখার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়না যে আপনার ফুসফুস সুরক্ষিত রয়েছে। 

মূলত, শ্বাস আটকে রাখার মাধ্যমে ফুসফুসের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত আছে কিনা তার পরীক্ষা সংক্রান্ত কিছু ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসার প্রেক্ষিতে অনুসন্ধানে করে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। বৈজ্ঞানিকভাবে অপ্রমাণিত এই পদ্ধতিটি দ্বারা একজন মানুষের ফুসফুসের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে কখনোই পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। কিছু গবেষণায় নির্দিষ্ট বয়সের ব্যক্তিদের জন্য এই ধরণের শ্বাস আটকে রাখার পরীক্ষার বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও ফুসফুসের অবস্থা বয়সভেদে একেকরকম হওয়ায় এই ধরণের পদ্ধতির মাধ্যমে ফুসফুসের সামগ্রিক সুরক্ষা পরীক্ষা সম্ভব নয়। তবে দৈনন্দিন জীবনে একজন ব্যক্তি নিশ্বাস আটকে রাখার অনুশীলনের মাধ্যমে ফুসফুসের ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ আরো কিছু স্বাস্থ্যগত উপযোগীতা লাভ করার বিষয়ে বলা হয়েছে কিছু গবেষণায়।  

সুতরাং, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শ্বাস আটকে রাখার মাধ্যমে ফুসফুসের স্বাস্থ্য পরীক্ষা সংক্রান্ত একটি দাবি ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে; যা বিভ্রান্তিকর।

তথ্যসূত্র

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img